নায়ক ফারুককে হারিয়ে কাঁদছে ঢালিউড

রোজ অ্যাডেনিয়াম
একে একে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা সিনেমার কিংবদন্তিরা। জসিম, ওয়াসিম, বুলবুল আহমেদ, সালমান শাহ, নায়ক রাজ রাজ্জাক, মান্নার মতো অনেক নন্দিত সিনেমার নায়ককে হারিয়েছি আমরা। সেই মিছিলে নাম লেখালেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের মিয়া ভাই খ্যাত কিংবদন্তি নায়ক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা, সংসদ সদস্য চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। সবার প্রিয় এই নায়ক না ফেরার দেশে চলে গেছেন ২০২৩ সালের ১৫ মে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নায়ক ফারুক।

গেলেন জীবিত, ফিরলেন মৃত
এক সময় একের পর এক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ‘সারেং বৌ’, ‘লাঠিয়াল’, ‘সুজন সখী’, ‘নয়নমনি’, ‘মিয়া ভাই’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সাহেব’, ‘আলোর মিছিল’, ‘দিন যায় কথা থাকে’ এর মতো সিনেমা উপহার দিয়েছেন। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শেষ জীবনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা ১৭ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সেই মানুষটিই বেশ ক’বছর ধরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছেন। অবশেষে হার মানলেন মৃত্যুর কাছে। আট বছর ধরে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন এই অভিনয়শিল্পী ও রাজনীতিবিদ। অসুস্থ হয়েছেন আবার চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়িতেও ফিরেছেন। কিন্তু সম্প্রতি ঘটলো ব্যতিক্রম। বাড়ি থেকে গেলেন জীবিত কিন্তু ফিরলেন নিথর হয়ে প্রাণহীন অবস্থায়। নায়ক ফারুক সর্বশেষ ২০২১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুরে যান। পরীক্ষায় রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর থেকেই অসুস্থ ছিলেন। নিয়মিত চিকিৎসা নিতেন। দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত ১৫ মে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। আর ১৬ মে মঙ্গলবার ভোরের ফ্লাইটে ঢাকায় আনা হয় তার মরদেহ।

শহীদ মিনারে ফুলেল বিদায়
১৬ মে পৌনে ১২টার দিকে ফারুকের মরদেহ নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানেই মিয়া ভাই খ্যাত এই নায়ককে শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে সেই অনুষ্ঠানে প্রথমেই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও স্পিকারের পক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংসদ সদস্য ফারুককে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এই আনুষ্ঠানিকতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

প্রাণের এফডিসিতে শেষবার
অসুস্থ হওয়ার আগে নিয়মিত এফডিসিতে আসতেন ফারুক। প্রাণ ভরে আড্ডাও দিতেন এফডিসিতে। সুস্থ হয়ে আর এফডিসিতে আসা হলো না তার। আসলেন লাশবাহী গাড়িতে চড়ে। ১৬ মে দুপুর ১টার দিকে এফডিসিতে নিয়ে আসা হয় তার মরদেহ। এসময় এফডিসিতে উপস্থিত ছিলেন শিল্পী সমিতি, পরিচালক সমিতির নেতৃবৃন্দসহ নতুন ও পুরনো প্রজন্মের নির্মাতা, অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা। তাকে একনজর দেখতে, শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অসংখ্য মানুষ। ছিলেন নায়ক ফারুকের পরিবারের সদস্যরাও। ছিলেন অভিনেত্রী সুজাতা, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, নাঈম, সুচন্দা, রোজিনা, অঞ্জনা, মিশা সওদাগর, নিপুণ, ফেরদৌস, ওমর সানী, বাপ্পী, পরিচালক কাজী হায়াৎ, শাহীন সুমন, এস এ হক অলিক, অনিমেষ আইচ, প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরুসহ অনেকেই। সবার চোখ ছলো ছলো। এফডিসিতে চিত্রনায়ক ফারুকের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। এছাড়া চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এফডিসিতে নায়ক ফারুকের জানাজা সম্পন্ন হয় দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চ্যানেল আই ভবনে। সেখানে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন শাকিব খান, ফেরদৌস, আফসানা মিমি, মিশা সওদাগরসহ অনেকেই। এখানে আরেকটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয় দুপুর ৩টা ৩০ মিনিটে।

আজাদ মসজিদ টু কালিগঞ্জ
চ্যানেল আই ভবনে জানাজা শেষে সেখান থেকে মিয়া ভাইকে নেওয়া হয় গুলশান আজাদ মসজিদে। সেখানে বিকেলে আরেক দফা নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ওইদিন সন্ধ্যা ৭টায় তাকে গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জে নেওয়া হয়। সেখানে দখিন সোম টিওরী জামে মসজিদে জানাজা শেষে পাঠান বাড়ি পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়।
যদি মনে পড়ে
বাবার পাশেই চিরনিদ্রায় আছেন ফারুক। তার কথা মনে পড়লে তার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন। পায়ের শব্দ ঠিক শুনতে পাবেন তিনি। এখন আমরা তাকে মনে রাখতে পারি। তার জন্য প্রার্থনা করতে পারে। আমাদের কাছে এটুকুই তার চাওয়া। কোনো গুণী মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে তার জন্য কাঁদে সবাই। নায়ক ফারুকের মৃত্যুতে শোকাহত এক বাংলার চিত্র দেখেছি আমরা। সোশ্যাল মিডিয়াও হয়ে উঠেছিল এক শোক বই।

শোকাহত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী
সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের মৃত্যুতে শোকের সাগর হয়েছিল পুরো বাংলাদেশ। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৫ মে এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, চিত্রনায়ক ফারুকের মৃত্যু দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তার অভিনীত চলচ্চিত্র দেশের সমাজ ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। চলচ্চিত্র অঙ্গনে তার অবদান দেশের মানুষ আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। ফারুকের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন রাষ্ট্রপতি। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, এ দেশের চলচ্চিত্রে নায়ক ফারুক এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনীতি ও সংস্কৃতি অঙ্গনে তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
ববিতা
ফারুকের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় খ্যাতিমান চিত্রনায়িকা ববিতা লিখেছেন, ‘ফারুক ভাই মানুষ হিসেবেও অসাধারণ ছিলেন। কী বলবো! কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। ভাবতেই পারিনি তিনি চলে যাবেন। আমার মনে বিশ্বাস ছিল, চিকিৎসা নিচ্ছেন, ঠিকই তিনি ফিরে আসবেন। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল! শরীরের ব্যাপারে আসলে কেউ তো কিছু বলতে পারে না। কখন কী হয়!’
শাকিব খান
শীর্ষ নায়ক শাকিব খান সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখেছেন, ‘চলে গেলেন আমাদের প্রিয় মিয়া ভাই (আকবর পাঠান ফারুক)। যত দিন তিনি সুস্থ সবল ছিলেন, তত দিন আমাকে স্নেহে আগলে রেখেছিলেন। আমার যে কোনো ভালো কাজ এবং ছবির পোস্টার কিংবা ট্রেলার রিলিজ দেখে তিনি নিজ থেকে অ্যাপ্রিশিয়েট করে গর্বিত হতেন। আমার কাছে শ্রদ্ধাভাজন এই মানুষটি ছিলেন চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রাজ্ঞজনদের একজন। কাজে কিংবা কাজের বাইরে এই মহান মানুষটির সঙ্গে আমার অসংখ্য স্মৃতি। তার প্রয়াণে প্রিয় অভিনেতা হারানোর পাশাপাশি একজন অভিভাবক হারানোর শোক অনুভব করছি। ওপারে অনেক শান্তিতে থাকবেন।’
মিশা সওদাগর
অভিনেতা মিশা সওদাগর শোকবার্তায় লিখেছেন, “বিদায় মিয়া ভাই’। আজ সকাল ৮:৩০ মিনিটে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিয়াভাই’ খ্যাত নায়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা ১৭ (গুলশান-বনানী) আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান (ফারুক) ভাই (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।”
অনন্ত জলিল
চিত্রনায়ক অনন্ত জলিল লিখেছেন, ‘প্রায় পাঁচ দশক ঢালিউডে অবদান রাখা ঢাকাই সিনেমার কিংবদন্তি-চিত্রনায়ক ও ঢাকা ১৭ আসনের সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান ফারুক (আমাদের ফারুক ভাই)। এই কীর্তিমান মহান মানুষটির প্রয়াণে গভীর শোক ও বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।’
ফজলুর রহমান বাবু, চঞ্চল চৌধুরী
জনপ্রিয় অভিনেতা ও গায়ক ফজলুর রহমান বাবু লিখেছেন, ‘শোকাহত। চলে গেলেন চলচ্চিত্রের সারেং।’ চঞ্চল চৌধুরী লিখেছেন, ‘বিদায় নায়ক ফারুক। বিনম্র শ্রদ্ধা, আপনার আত্মার শান্তি হোক।’
জাহারা মিতু
চিত্রনায়িকা জাহারা মিতু লিখেছেন, ‘বিটিভিতে আপনার ছবি দেখে বড় হয়েছি। গ্রাম্য ছেলের ভূমিকায় কি অনবদ্য আপনি। আল্লাহ আপনাকে বেহেশত নসিব করুক। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’
জাকির হোসেন রাজু
চলচ্চিত্র পরিচালক জাকির হোসেন রাজু লিখেছেন, ‘বাংলা চলচ্চিত্রের মিয়া ভাই খ্যাত, তুমুল জনপ্রিয় নায়ক ফারুক ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। মৃত্যু অনিবার্য, তবু মৃত্যু আমার ভালো লাগে না। এই সংবাদটি শুনলেই মন বিবশ হয়ে যায়। যে মানুষটি মৃত্যুবরণ করেন, হাজার চেষ্টা করলেও তার সঙ্গে আর কোনদিন কথা বলা যাবে না, পৃথিবীর কোনো প্রযুক্তির মাধ্যমেও আর জানা যাবে না, মানুষটি কেমন আছেন! কী ভীষণ অসহায় আমরা মৃত্যুর কাছে।’ রাজুর প্রথম দুটি সিনেমাতেই অভিনয় করেছিলেন ফারুক। নিজের চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের একটি ছবি দিয়ে সেই স্মৃতি স্মরণ করে রাজু লিখেছেন, আমার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘জীবন সংসার’ দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘এ জীবন তোমার আমার’ এর নায়ক ফারুক ভাই। শত শত মধুর স্মৃতি তাঁর সঙ্গে। যেসব স্মৃতি সিনেমার গল্পের চেয়েও মধুর।
জায়েদ খান
চিত্রনায়ক জায়েদ খানও ফারুকের সঙ্গে নিজের একটি ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘এতক্ষণ কিছু লিখিনি, কারণ মনে হয়েছে আপনি বেঁচে আছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। এটা তো কথা ছিল না। বলেছিলেন, জায়েদ আসতেছি, আড্ডা হবে। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি নাই।’
নিরব
চিত্রনায়ক নিরব লিখেছেন, ‘সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিয়া ভাই’ খ্যাত নায়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা ১৭ (গুলশান-বনানী) আসনের সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান (ফারুক)। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’
এমন আরও অনেক তারকাই শোক জানিয়েছেন ফারুকের মৃত্যুতে। আর ভক্তকুলরাও কেঁদেছেন। এমন একজন মানুষের জন্য মানুষ তো কাঁদবেই। সবার প্রার্থনা একটাই। ওপারে ভালো থাকুন নায়ক।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মৃতিচারণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

2 × 4 =