নিরাপদ মাতৃত্ব

ময়ূরাক্ষী সেন

পুরো বিশ্বে প্রায় প্রতিদিনই গর্ভকালীন জটিলতা ও প্রসবকালীন সময়ে অনেক মায়ের মৃত্যু হয়। উন্নত দেশে তুলনায় এই মৃত্যুর হার উন্নয়নশীল দেশেই বেশি লক্ষ্য করা যায়। এক হিসাবে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ জন মা মারা যান। বাংলাদেশে বাচ্চা জন্মদানের সময় প্রতিদিন ১৫ জন মা মারা যাচ্ছেন। আগের চেয়ে মায়েদের মৃত্যু অনেক কমে এলেও এখনো সচেতনতার অভাবে অনেক মায়েদের মৃত্যু হচ্ছে। ৪৫% মা মারা যাচ্ছেন প্রসবের ৪২ দিনের মধ্যে। মায়েদের সুরক্ষার জন্য ১৯৯৭ সাল থেকে ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করে আসছে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ উদ্যোগ টেকসই উন্নয়নের অন্তর্ভুক্ত করে। সরকার ও দেশের পক্ষ থেকে মায়ের মৃত্যু কমানোর জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও মাতৃত্বকালিন মৃত্যু কিংবা জটিলতা এড়াতে বাড়তি সচেতন হতে হবে গর্ভবতী মায়ের ও তার পরিবারের।

গর্ভকালীন জটিলতা

গর্ভপাত

অনেকের সন্তান গর্ভে আসার পর বার বার গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ হতে থাকে। যার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি মায়েরা বিষণ্নতায় ভুগে থাকেন। সাধারণত গর্ভের প্রথম তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গর্ভপাত হয়ে থাকে। বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি; যেমন গর্ভধারণের সময় যদি ভ্রুণ অনেক বেশি অথবা একেবারে কম ক্রোমোজোম পায়, তখন ভ্রণ ঠিকমতো তৈরি হয় না। ফলে গর্ভপাত হতে পারে। মায়ের বয়স যদি ৩৫-৩৯ বছরের মধ্যে থাকে, তাহলে প্রতি ১০ জনের মধ্যে দুইজনের মিসক্যারেজের সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া নানা ধরনের হরমোনাল সমস্যা থাকলেও মিসক্যারেজ হতে পারে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস

অনেকের গর্ভে সন্তান আসার আগে থেকে ডায়াবেটিস থাকে আবার অনেকের গর্ভকালীন সময় নতুন করে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে। তাই কোনোভাবেই একে অবহেলা করা যাবে না। বিশেষ করে পরিবারে যদি ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকে তাহলে শুরু থেকে সচেতন থাকতে হবে। মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে সন্তান জন্মের পর পর নানা ধরনের শারিরীক জটিলতার মধ্যে পড়তে পারে। এছাড়া জন্মের পর থেকেই স্নায়ুতন্ত্র এবং হৃৎপিণ্ডের সমস্যার পাশাপাশি আরো কিছু সমস্যা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যাদের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে তাদের সন্তান নেবার আগে চেকআপ করে নিতে হবে যে ডায়াবেটিস কন্টোলে আছে কি না। সন্তান গর্ভে থাকলে চিকিৎসক সে অনুযায়ী ওষুধের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি

শতকরা ১ ভাগ ক্ষেত্রে জরায়ুর ভেতরে সঠিক জায়গায় সন্তান না হয়ে জরায়ুর বাইরে সাধারণত এক ডিম্বনালিতে গর্ভসঞ্চার হয়। এ অবস্থায় মায়ের মৃত্যু ঝুঁকি থাকতে পারে। এক্ষেত্রে অনেক সময় ডিম্বনালি ফেটে গিয়ে পেটের মধ্যে রক্তপাত হতে পারে। প্রেগন্যান্সি পজিটিভ আসার পরেও যখন জরায়ুর ভেতর ভ্রুণের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না তখন এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বলে ধারণা করা হয় ও বাকি পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। দ্রুত চিকিৎসা না করা হলে মায়ের মৃত্যু হতে পারে। এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির সংখ্যা খুব কম হলেও ফেলে দেওয়ার মতো নয়, প্রায় প্রতিদিনই এর ফলে অনেক মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।

উচ্চরক্তচাপ

গর্ভকালের শেষের দিকে অনেক মায়েদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা যায়। উচ্চ রক্তচাপের সঠিক চিকিৎসা না হলে এটি নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

প্রসব পরবর্তী জটিলতা

প্রসবকালীন সময় অনেক মায়েদের মৃত্যু হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রধান কারণ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।  ৫০০ মিলির বেশি রক্তক্ষরণ হলে তাকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হিসেবে ধরা হয়। জরায়ুমুখের কাছে গর্ভফুলের অবস্থান, প্রসব-পরবর্তী সময়ে জরায়ুর সংকোচনে শিথিলতা, গর্ভে শিশুর অস্বাভাবিক অবস্থান, একের অধিক সন্তান প্রসব, প্রসবের পর গর্ভফুল জরায়ুতে আটকে থাকা ইত্যাদি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের প্রধান কারণ। এছাড়া অনেকে অল্প বয়সে গর্ভবতী হয়ে যান। মায়ের বয়স ২০ বছরের নিচে হলে প্রসবকালীন নানা ধরনের জটিলতা হতে পারে।

গর্ভকালীন সময় মায়ের যত্ন

পুষ্টি নিশ্চিত করা

মা যেসব খাবার খায় তার মাধ্যমেই গর্ভে থাকা শিশু পুষ্টি পেয়ে থাকে। তাই মা যাতে সঠিক পুষ্টি পান সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রতিদিন খাবারে জিংকসমৃদ্ধ খাবার থাকতে হবে। যেমন ছোলার ডাল, কাজু, চিনা বাদাম, শিমের বিচি, মুরগির মাংস, মাছ, দুধ ইত্যাদি। এছাড়া প্রতিদিন ক্যালসিয়াম, আয়রন, আয়োডিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি সম্বৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। গর্ভকালীন সময় যতটা সম্ভব ঘরে বানানো পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। বাইরের অতিরিক্ত তেল মসলা জাতীয় খাবার খেলে গ্যাস্ট্রিক, ডায়রিয়া কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্যর মতো নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও অন্যান্য যেকোনো ধরনের জটিলতা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।

নিয়মিত চেকআপ

গর্ভকালীন সময় নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে শারীরিক চেকআপ করিয়ে নেওয়া অনেক বেশি জরুরি। সন্তান ধারণের আগে মায়ের ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি শারীরিক পরীক্ষা করে নেওয়া প্রয়োজন। সেইসাথে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সন্তান ধারণের তিনমাস আগ থেকে নিয়মিত ফলিক অ্যাসিডসহ অন্যান্য ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। ডায়াবেটিসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগের জটিলতা থাকলে বাড়তি সচেতন হতে হবে। গর্ভকালীন সময় অতিরিক্ত সাদা স্রাব কিংবা রক্তপাত দেখলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। একজন গর্ভবতী নারীর প্রায় প্রতি মাসে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো রকম অবহেলা করা যাবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি তথ্য অনুযায়ী, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে অবশ্যই কমপক্ষে চারবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ। এই চারবার হচ্ছে যথাক্রমে ১৬, ২৮, ৩২ ও ৩৬তম সপ্তাহে। এছাড়া কারো যদি শারীরিক জটিলতা থাকে তাহলে নিয়মিত চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে গর্ভকালীন সময়ে আমরা শারীরিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে মনোযোগী হলেও মানসিক অবস্থার কথা তেমন চিন্তা করি না। কিন্তু একজন মায়ের মানসিক অবস্থা যদি খারাপ থাকে এর প্রভাব পড়বে তার শরীর ও গর্ভে থাকা সন্তানের উপর। অনেক নারী গর্ভকালীন সময় বিষণ্নতা ও উদ্বেগের শিকার হন। এছাড়া গর্ভে থাকার সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সেক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তার মানসিক অবস্থার খেয়াল রাখতে হবে। অনেকে গর্ভকালীন সময় নিজেকে পুরোপুরি ঘরে আবদ্ধ করে ফেলেন তা না করে নিজের প্রিয় কাজ করে সময় কাটানো যেতে পারে। প্রার্থনা করা, গান শোনা, হালকা ব্যায়াম করা, বই পড়া, টেলিভিশন দেখা ইত্যাদি মনকে প্রফুল্ল রাখতে সাহায্য করে। ঝুঁকি নেই এমন স্থানে মাঝেমধ্যে বেড়াতে গেলে ও প্রিয় মানুষের সাথে গল্প করেও মানসিক অবস্থা ভালো রাখা যায়। গর্ভকালীন সময়ে অতিরিক্ত বিষণ্নতায় আক্রান্ত হলে বিশেষজ্ঞর শরণাপন্ন হয়ে কাউন্সিলিং নিতে হবে।

পরিবারের সহযোগিতা

একজন নারীর জীবনে এ সময় কাম্য থাকে তার পরিবারের সহযোগিতা এবং সে আশা করে তার পরিবারের প্রত্যেকটি ব্যক্তি তার পাশে থাকবে। নানা কারণে একজন গর্ভবতী নারী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে ও মানসিকভাবে দুর্বল থাকে। পরিবার এবং স্বামীকে পাশে পেলে সে সাহস অনুভব করে। একজন গর্ভবতী নারীর পরিবারের সদস্যদের উচিত তার পাশে থাকা এবং তার বাড়তি যত্ন করা। গর্ভবতী মাকে দিয়ে কোনো ভারী কাজ করানো যাবে না এবং তার সব ধরনের কাজে পরিবারের সাহায্য করতে হবে।

প্রসব পরবর্তী যত্ন

প্রসবের পর সবাই নবজাতক সন্তানকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু সেসময় মায়েরও চাই বাড়তি যত্ন। প্রসবের পরেও চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চেকআপ করাতে হবে। এ সময় রক্তচাপ, পালস, তাপমাত্রা ও প্রস্রাবের পরিমাণ ঠিক আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। অনেকের সন্তান জন্মের পর ডায়বেটিস ও নানা ধরনের হরমোনাল সমস্যা দেখা দিতে পারে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 + 5 =