সীমান্ত খান
আমাদের সকলের পছন্দের বিভিন্ন রঙ আছে। তবে অনেকেই আমাদের পছন্দের রঙ সম্পর্কে তেমন জানি না। আজ আমরা জানবো নীল রঙ সম্পর্কে জানা অজানা তথ্য।
নীল রঙের সাইকোলজি
রঙ মানুষের ব্যবহার ও আচরণকে প্রভাবিত করে, প্রত্যেকটি রঙ ভিন্ন ধরনের প্রকাশ ঘটায়। নীল রঙকে প্রশান্তি, স্থিতিশীলতা, অনুপ্রেরণা, প্রজ্ঞা বা স্বাস্থ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। এটি শান্ত এবং নির্ভরযোগ্যতারও প্রতীক। পাশাপাশি নীল রঙ যারা পছন্দ করেন তারা বেশ আবেগপ্রবণ হন।
আকাশ কেন নীল হয়
দিনের বেলা নীল আকাশকে আমরা সবসময় দেখতে পাই। খোলা মাঠে প্রকৃতির সঙ্গে নীল আকাশ দেখতে আমাদের সকলের বেশ ভালো লাগে। অনেকেই নীল আকাশ ছুঁয়ে দেখতে চায়। তবে আমরা কখনও কী ভেবে দেখেছি আকাশের রঙ কেন নীল হয়? আকাশ নীল হওয়ার জন্য দায়ী সূর্য। আমরা খালি চোখে সূর্যের আলোকে সাদা দেখতে পাই। কিন্তু সূর্যের আলো রঙধনুর সব কয়টি রঙ দিয়ে তৈরি। যেহেতু আলো তরঙ্গ আকারে চলে। তাই এর প্রতিটি রঙের নিজস্ব তরঙ্গদৈর্ঘ্য আছে। কিছু রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট, তবে অনেক রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড়। দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে রঙের চেয়ে স্বল্প তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে রঙ আমাদের চোখে বেশি ধরা পড়ে। তাই আমরা আকাশকে নীল দেখতে পাই।
ইস্তান্বুলের নীল মসজিদ
ঢাকাকে যেমন বলা হয় মসজিদের শহর তেমনি ইউরোপে তুরস্কের ইস্তান্বুলকে বলা হয় মসজিদের শহর। আন্তঃমহাদেশীয় শহর হওয়ায় দেশটি ইউরেশিয়ার শিল্প, সাহিত্য ও ইতিহাসের অন্যতম প্রধান মিলনস্থল। ইস্তান্বুলের বিখ্যাত ও নয়নাভিরাম বসফরাস প্রণালীর তীর ঘেঁষে মুসলিম ঐতিহ্যের নিদর্শন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘সুলতান আহমেদ মসজিদ’ বা ‘ব্লু মস্ক’। দৃষ্টিনন্দন নীল গম্বুজ ও মসজিদের দেয়ালের নীল রঙের টাইলসের কারণে এটি ‘নীল মসজিদ’ নামে পরিচিত। ১৬০৯ থেকে ১৬১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ওসমানি সুলতান প্রথম আহমেদের অর্থায়নে তৎকালীন প্রখ্যাত প্রযুক্তি ও স্থাপত্যবিদ সেদেফকার মুহাম্মদ আগা মসজিদটি নির্মাণ করেন।
মরক্কোর নীল শহর
আমরা মসজিদের শহর, দ্বীপের শহর সম্পর্কে অনেকেই শুনেছি। তবে কখনো কী নীল রঙের শহরের কথা শুনেছি? শুনতে কাল্পনিক কিছু মনে হলেও বাস্তবে এমন একটি শহর রয়েছে। মরক্কোর শেফশেওয়েন হলো সেই শহর। দরজা-জানালা, রাস্তা, সিঁড়ি, দেয়াল; সবই নীল রঙে মোড়া। তবে পুরো শহর নীল রঙে এমনিই রাঙানো হয়নি, এর পেছনে রয়েছে ইতিহাস। ১৪৭১ সালে গড়ে ওঠা শেফশেওয়েন শহরে এক সময় নানান ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বাস করত। ৩০-এর দশকে হিটলারের ভয়ে ইহুদিরা পালিয়ে আশ্রয় নেয় মরক্কোর এ শহরে। সে সময়ই ইহুদি শরণার্থীরা নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে পুরো শহর নীল রঙে ঢেকে ফেলে। কারণ তাদের কাছে নীল রঙটি ছিল আকাশ আর স্বর্গের প্রতীক। তাই শহরজুড়ে নীল রঙ করা হয়। তবে ১৯৪৮ সালে বেশির ভাগ ইহুদি ইসরায়েল চলে গেলেও শহরের নীল রঙটি রয়েই যায়। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবছর বসন্তের সময় শহরের বাসিন্দারা একবার করে পুরো শহরে নীল রঙের প্রলেপ দেয়। স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকেও শহরের পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখার সব রকম চেষ্টা করা হয়।
চোখ কেন নীল হয়
আমরা চোখের রঙ বলতে সাধারণত সাদা এবং কালো এই দুইটি রঙের সঙ্গেই পরিচিত। তবে কিছু কিছু মানুষের চোখের রঙ কালোর পরিবর্তে বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে। যেমন কারও নীল, কারও সবুজ, কারও বাদামি আবার কারও ঘোলাটে। তবে আজ আমরা জানবো নীল চোখ সম্পর্কে। চোখ কেন নীল হয় তা জানতে হলে বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হবে। সাধারণত চোখের আইরিশে মেলানিনের পরিমাণ, প্রোটিনের ঘনত্ব এবং আইরিশে স্ট্রোমার অস্বচ্ছ অংশে আলো কতটা বিচ্ছুরিত হচ্ছে ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে চোখের রঙ নির্ধারিত হয়। মেলানিন অতিরিক্ত বেশি হলে চোখ ধূসর রঙের হবে। আর মেলানিন অতিরিক্ত কম হলে চোখ হবে সবুজ রঙের। তবে নীল রঙের চোখের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিছুটা ভিন্ন। যাদের নীল চোখ, তাদের স্ট্রোমাতে কোনো রঙ নেই। তাদের কোনো পিগমেন্টও নেই। পিগমেন্ট না থাকার কারণে চোখ বিভিন্ন রঙের আলো শুষে নিতে পারে না। নীল চোখে সাধারণত কোনো কোলাজেন ডিপোজিটও থাকে না। যার ফলে নীল চোখের মণিতে সূর্যের আলো পড়ে বহু রঙের আলোর প্রতিফলন ঘটলেও যিনি দেখেন তার কাছে শুধু নীল রঙই পৌঁছায়। এজন্য তাদের চোখ দেখতে নীল রঙের হয়।
নীল প্রজাতির পিঁপড়া
আমরা লাল এবং কালো রঙের পিঁপড়ার কথা শুনেছি ও দেখেছি। কিন্তু কখনও কী নীল রঙের পিঁপড়ার কথা শুনেছি? অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমন এক প্রজাতির পিঁপড়া আছে। পিঁপড়াটির দেখা পেতে হলে যেতে হবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের হিমালয়ের পাদদেশে। ক্ষুদ্র এই প্রাণীটির নাম প্যারাপারত্রেচিনা নীলা। গঠনের দিক থেকে নীল পিঁপড়াটি অন্যদের থেকে ভিন্ন। এই পিঁপড়ার দৈর্ঘ্য ২ মিলিমিটারের কম। এদের মাথা গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির হয়ে থাকে। এছাড়াও পিঁপড়াটির মাথার দুই পাশে দুটি বড় চোখ আছে। এই বড় চোখগুলো পিঁপড়াকে চারপাশ আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে। এই পিঁপড়ার মাথার নিচের অংশে পাঁচটি তীক্ষ্ণ দাঁত রয়েছে। এই দাঁতগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী। এই শক্তিশালী চোয়াল ও দাঁত শিকার ধরতে এবং খাবার কাটতে সাহায্য করে।
রহস্যময় নীল আলো
সমুদ্রে নীল আলো জ্বলজ্বল করছে, এমন দৃশ্য আমরা প্রায়শই ইন্টারনেটে দেখতে পাই। অনেকেই এই দৃশ্যগুলোকে কাল্পনিক মনে করেন। তবে এই দৃশ্যগুলো কাল্পনিক নয় এমন দৃশ্য বাস্তবেও আছে। তবে তা দেখতে হলে যেতে হবে মালদ্বীপের গ্লোয়িং বিচে। আসলে এই উজ্জ্বল নীল আলো এক ধরনের সামুদ্রিক ফাইটোপ্লাংকটন যার নাম ডিনোফ্লাজেলাটিস। এসব ফাইটোপ্লাংকটনে থাকে লুসিফেরাস নামক রাসায়নিক উপাদান যা আলো সৃষ্টি করে। মূলত নিজেদের আত্মরক্ষা করার জন্যই এসব ফাইটোপ্লাংকটন এমন আলো নির্গত করে। শুধুমাত্র এই ফাইটোপ্লাংকটন নয় জোনাকি, জেলিফিশের মতো অনেক জীব আছে যারা এমন আলো তৈরির করার ক্ষমতা রাখে। জীবের আলো তৈরি করার এই ক্ষমতাকে বলে বায়োলুমিনেসেন্স।
এক পরিবারের সবার শরীরই নীল
পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে যা আমাদের চিন্তা-ভাবনার বাইরে ও অজানা। জানলে অবাক হবেন, পৃথিবীতে এমন একটি পরিবার আছে যাদের সবার শরীর নীল। এমন বিচিত্র ঘটনা দেখা যায় লেক্সিংটনে। ১৯৭৫ সালে হাসপাতালে এমন এক শিশুর জন্ম হয়। যা দেখে চিকিৎসকরাও অবাক হয়ে যান। কারণ শিশুটি দেখতে স্বাভাবিক হলেও তার শরীরের রঙ অবাক করে দেয় পুরো বিশ্বকে। শিশুটির পুরো শরীরই ছিল নীল রঙের। যার কারণে শিশুটির জন্মের পর চারদিকে আলোচনা সৃষ্টি হয়। প্রথমে চিকিৎসকগণ ভেবেছিলেন কোনো বিরল রোগের কারণে হয়তোবা শিশুটির শরীর নীল, তাই দ্রুত লেক্সিংটনে অপেক্ষাকৃত ভালো একটি হাসপাতালে শিশুটিকে হস্তান্তর করা হয়। হাজারো মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পরেও কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে শিশুটির বাবা জানান, তার দাদির শরীরের রঙ ঠিক এমন নীল ছিল। তিনি মৃত্যু অবধি অন্য সব মানুষের মতোই সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবেই বেঁচে ছিলেন।
সমুদ্রে কেন নীল হয়
আমরা কখনও কী চিন্তা করেছি কেন সমুদ্রের পানি নীল হয়। আসলে পানির রঙ সাদা। কিন্তু সূর্যের আলো যখন পানিতে পড়ে তখন আলোর বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে লাল, কমলা, সবুজ প্রভৃতি রশ্মি সমুদ্রের পানিতে বেশি শোষিত হয়। আর কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে নীল রশ্মি সবচেয়ে কম শোষিত হয়ে বেশ কিছুটা নীল রঙ ফেরত আসে। সমুদ্রের পানিতে প্রতিফলিত ও বিচ্ছুরিত হয়ে আমাদের চোখে নীল রঙটি পৌঁছায় বলে সমুদ্রের পানি নীল দেখায়। আকাশও নীল দেখায় ঠিক একই কারণে। কিন্তু অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে নদীর পানি কেন নীল দেখায় না বরং অনেকটা সাদা বা একটু ছাইরঙা হয়। নদীর পানি সাদা হওয়ার কারণ সমুদ্রের তুলনায় নদীর পানির পরিমাণ কম হওয়া। যে কারণে নদীর পানিতে নীল রঙের বিচ্ছুরণ ঘটে না।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা