পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের লুট উৎসব

মাহবুব আলম

আর কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হচ্ছে রমজান মাস। পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইবাদত-বন্দেগী করাসহ রমজানের উদ্দেশ্যে অর্জন ও ফজিলত লাভের জন্য নানামুখী প্রস্তুতি শুরু করেছে। সেই সাথে আছে ঈদের আগমনের প্রস্তুতি। অন্যদিকে, একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা অতীতের মতো এবারও রমজান ও ঈদকে পুঁজি করে অতিরিক্ত মুনাফা, বেপরোয়া মুনাফা, লাগাম ছাড়া মুনাফা অর্জনের জন্য ক্রেতা সাধারণের গলা কাটার জন্য ছুরিতে শান দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, সরকারের কাছে এসব ব্যবসায়ীদের একের পর এক আবদারেরও শেষ নাই। এই আবদারের মধ্যে রয়েছে, রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে সেই সব পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস। এর মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, তেল, ডাল, চিনি, খেজুর ইত্যাদি। সরকার ইতিমধ্যেই এই ব্যবসায়ীদের আবদার অনুযায়ী এসব পণ্যের শুল্ক অনেকটাই হ্রাস করেছে। এর মধ্যে রয়েছে খেজুর আমদানিতে শতকরা ১৫ ভাগ শুল্ক হ্রাস। সেইসাথে সরকার ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অতিরিক্ত চিনি, পেঁয়াজ ও ডাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। একই সাথে সরকার ভোজ্য তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বেশকিছু পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক অতীতের মতো এবারও সরকারের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে পণ্যের মূল্য হ্রাস তো দূরের কথা ওরা সকল পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছে।

এর জন্য একটি উদাহরণই যথেষ্ট। তা হচ্ছে, সরকার ১ মার্চ থেকে বাজারে বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করেছে ১৬৫ টাকা। কিন্তু ঐদিন থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় বোতলজাত তেল বিক্রি হয়েছে ১৭৩ টাকায়। একইভাবে খোলা তেল এক লিটারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪৯ টাকা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬২ টাকা। শুধু তাই নয়, রমজান শুরু হবার আগেই গরুর মাংসের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৫০ টাকা। গরুর মাংসের সাথে সাথে খাসির মাংস ও ব্রয়লার মুরগির দামও বেড়েছে। আর পেঁয়াজের দাম সেঞ্চুরি পার হয়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারির শেষে ও মার্চের শুরুতে সব ধরনের ডালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে প্রায় সব ধরনের ডালের দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। এই বর্ধিত দাম অনুযায়ী ১ মার্চ থেকে বাজারে মসুরির ডাল কেজিপ্রতি ১৪০ টাকা, মটর ডাল ১১০ টাকা, মুগের ডাল ১৭৫ টাকা, খেসারি ১১০ টাকা এবং ছোলা ১১০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। রমজান এখনো আসেনি। বেশ কদিন বাকি আছে। এরই মধ্যে এই অবস্থা। রমজান শুরু হলে কি অবস্থা হবে তা খুব সহজেই অনুমেয়।

আমাদের দেশে এই চিত্র নতুন নয়। প্রতিবছর এভাবে ব্যবসায়ীরা ক্রেতা সাধারণের গলা কেটে অতিরিক্ত মুনাফার নামে কার্যত ক্রেতাদের থেকে, বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে। এতে করে পবিত্র রমজান এক শ্রেণি ব্যবসায়ীদের কাছে লুটের রাজ্যে পরিণত হয়। শুধু রমজান নয় ঈদও ব্যবসায়ীদের কাছে লুট উৎসব। তাইতো এরা ১০ টাকার পণ্য ২০০, ৩০০ এমনকি ৫০০ টাকায় বিক্রি করে। এক্ষেত্রে ব্যবসার নিয়মনীতির কোনো ধার ধারে না। এমনকি দাড়ি-টুপিধারিরা, বারবার হজ করা হাজিরাও সমানতালে লুট উৎসবে মত্ত হয়। একথা এজন্য বলছি এটা আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে ঢাকার ইমামগঞ্জ ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সিংহভাগই হজ করেছেন এবং তাদের মুখে দাড়ি ও মাথায় টুপি দেখছি। এতে করে একদিকে রমজানের পবিত্রতা নস্যাৎ হয়, অন্যদিকে, ক্রেতা সাধারণ বিপাকে পড়ে হাঁসফাঁস করে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রী সন্তানকে চাহিদা মতো ইফতার সামগ্রীর যোগান দিতে পারে না। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রী কন্যা পুত্রদের পছন্দমত জামাকাপড় দিতে পারে না। এতে করে এক ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়। এই সমস্যা তৈরি করে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা। অথচ এর দায় নিতে হয় ক্ষমতাসীন সরকারকে। অথচ সরকার ব্যবসায়ীদের শুল্ক হ্রাস থেকে শুরু করে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দেয়। কিন্তু সেই সুবিধার ছিটেফোটাও পৌঁছায় না ক্রেতাদের কাছে। এর পুরোটাই আত্মসাৎ করে ব্যবসায়ী নামধারী এক শ্রেণির চোট্টারা। এদেরকে মুনাফাখোর না বলে কেউ যদি হারামখোর বলে তাহলে মোটেও বেশি বলা হবে না। এক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ যথেষ্ট তা হলো কৃষক সাগরকলা উৎপাদন করে বিক্রি করে গড়ে প্রতিটি কলা ২ টাকায়। অথচ এই কলা বাজারে বিক্রি হয় ১০ থেকে ১২ টাকায়। অর্থাৎ ক্রয়মূল্যের বহু গুণ দামে বিক্রি হয় প্রতিটি কলা। যা কি না কোনোভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্যের নীতির মধ্যে পড়ে না। একইভাবে জানা গেছে, গড়ে ৯০ টাকার খেজুর আমাদের দেশের বাজারে বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দরে। এখানে বলার দরকার পবিত্র রমজান উপলক্ষ্যে সৌদি সরকার তার দেশে ১০ হাজার পণ্যের মূল্য হ্রাসের ঘোষণা দিয়েছে। শুধু সৌদি সরকার নয়, আরব আমিরাতও রমজান উপলক্ষ্যে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য হ্রাসের ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে আমিরাত ও কুয়েত খেজুরের মূল্য শতকরা ৪০ ভাগ হ্রাসের ঘোষণা দিয়েছে।

সৌদি আরব, আরব আমিরাত বা কুয়েত শুধু নয়, সারা দুনিয়ায় উৎসবের সময় পণ্যমূল্য হ্রাস করা হয়। সেল সেল বলে বিভিন্ন বিপণি বিতানে পোস্টার লাগানো হয়। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালেও ঈদ, বড়দিন ও পূজার সময় প্রায় প্রতিটি বিপণি বিতানে সেল সেল বলে পোস্টার ব্যানার টানিয়ে চিৎকার করে। এই সেল সেল দৃষ্টি আকর্ষণী ব্যানার পোস্টারে আমি নিজে দেখেছি ১০ থেকে ৪০-৫০% পর্যন্ত মূল্য হ্রাসের ঘোষণা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক আমাদের দেশে জন্ম থেকে দেখেছি এর বিপরীত চিত্র। তবে আশার কথা চেইন শপ স্বপ্ন এবার মাত্র দুদিনের জন্য হলেও রমজান উপলক্ষ্যে ২০ পার্সেন্ট মূল্য হ্রাস ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে। অবশ্য, এই দুদিন পার হয়ে গেছে। এই দুই দিন ছিল ১ ও ২ মার্চ। স্বপ্নের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আশা করি ভবিষ্যতে বিশেষ করে রমজান শুরুর পর ও ঈদ উপলক্ষ্যে স্বপ্ন আবারও এই মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এদেশে নিজেদের অন্যের সাথে পার্থক্য করবে। সেইসাথে আশা করি অতিরিক্ত মুনাফার নামে ব্যবসায়ীরা যে লুট করছে সেই লুট উৎসব থেকে নিজেদের বিরত রাখবে। সবশেষে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন ব্যবসায়ীদের আবদার না মিটিয়ে ক্রেতা সাধারণের দাবি মেটান। এতেই মঙ্গল। দিনশেষে ক্রেতারাই আপনাকে রক্ষা করবে। আর ব্যবসায়ীরা বিপদ দেখলেই কেটে পড়বে। এটাই প্রমাণিত সত্য।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seventeen − three =