পরিযায়ী পাখি দিবস

রোজ অ্যাডেনিয়াম

বছরে দুইবার পরিযায়ী পাখি দিবস পালন করা হয়। পরিযায়ী পাখির আবাসস্থলকে নিরাপদ রাখা ও পাখিদের বিচরণস্থল সংরক্ষণে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রতিবছর মে ও অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শনিবার বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালিত হয়। সেই হিসাব অনুযায়ি এ বছর পরিযায়ী পাখি দিবস হচ্ছে ১১ মে ২০২৪ শনিবার। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে পাখি। কথা হবে সেই পাখিদের পরিযান বিষয়ে।

পরিযান কী

উইকিপিডিয়া বলছে, পাখি পরিযান বলতে নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু পাখির প্রতি বছর বা কয়েক বছর পর পর একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে বা সময়ে কম করে দু’টি অঞ্চলের মধ্যে আসা-যাওয়াকেই বোঝায়। জীবজন্তুর ক্ষেত্রে মাইগ্রেশনের সঠিক পরিভাষা হচ্ছে সাংবাৎসরিক পরিযান। যেসব প্রজাতির পাখি পরিযানে অংশ নেয়, তাদেরকে পরিযায়ী পাখি বলে। এ পাখিরা প্রায় প্রতিবছর পৃথিবীর কোনো এক বা একাধিক দেশ বা অঞ্চল থেকে বিশ্বের অন্য কোনো অঞ্চলে চলে যায় কোনো একটি বিশেষ ঋতুতে। সে ঋতু শেষে সেগুলো আবার ফিরে যায় যেখান থেকে এসেছিল সেখানে। এমন আসা যাওয়া কখনো এক বছরে সীমিত থাকে না। এ ঘটনা ঘটতে থাকে প্রতি বছর এবং কমবেশি একই সময়ে।

বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবসের তাৎপর্য

বিশ্বব্যাপী প্রচারাভিযান যা পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য পরিযায়ী পাখি দিবস পালন করা হয়। বর্তমান বিশ্বে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে পাখিদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একারণে পরিযায়ী পাখিরা মারাত্মক খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়েছে। এই অবস্থা দূরীকরণই এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য। পরিযায়ী পাখিদের সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা বাড়াতে ২০০৬ সাল থেকে এই দিবস পালন শুরু করা হয়। ২০০৮ সালে এ দিবসের সেøাগান ছিল ‘পরিযায়ী পাখি: জীব বৈচিত্র্যের দূত’। পরিযায়ী পাখিদেরকে আগে অতিথি পাখি বলা হতো। কিন্তু নিবিড় গবেষণায় দেখা গেছে যে এরা অতিথি নয়। বরং যে দেশে যায় সেখানে তারা ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের হওয়া পর্যন্ত বাস করে। অর্থাৎ বৎসরের বেশ কয়েক মাস তারা ভিনদেশে বাস করে। বরং তারা নিজ দেশে বাস করে স্বল্প সময়ের জন্য।

পরিযায়ী পাখির পরিযানের কারণ

কিছু প্রজাতির মাছ, স্তন্যপায়ী প্রাণী, এমনকি পোকামাকড় ও ফি-বছর পরিযান ঘটায়। তবে পাখির মতো এতো ব্যাপক আর বিস্তৃতভাবে কেউই পরিযানে অংশ নেয় না। পৃথিবীর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতিই (প্রায় ১৯%) পরিযায়ী। পাখি পরিযানের অন্যতম দু’টি কারণ হচ্ছে খাদ্যের সহজলভ্যতা আর বংশবৃদ্ধি। উত্তর গোলার্ধের অধিকাংশ পরিযায়ী পাখি বসন্তকালে দক্ষিণে আসে পোকামাকড় আর নতুন জন্ম নেওয়া উদ্ভিদ ও উদ্ভিদাংশ খাওয়ার লোভে। এ সময় খাদ্যের প্রাচুর্যের কারণে এরা বাসা করে বংশবৃদ্ধি ঘটায়। শীতকালে বা অন্য যেকোনো সময়ে খাবারের অভাব দেখা দিলে এরা দক্ষিণে রওনা হয়। আবহাওয়াকে পাখি পরিযানের অন্য আরেকটি কারণ হিসেবে ধরা হয়। শীতের প্রকোপে অনেক পাখিই পরিযায়ী হয়। হামিংবার্ডও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে খাবারের প্রাচুর্য থাকলে প্রচণ্ড শীতেও এরা বাসস্থান ছেড়ে নড়ে না। আলোর তীব্রতাও এদের পরিযানের অন্যতম কারণ।

পরিযানের প্রকার

পাখিদের মধ্যে সাধারণত তিন ধরনের পরিযান লক্ষ্য করা যায়। পরিযানের প্রকারগুলো হলো

স্বল্পদৈর্ঘ্য পরিযান: এ ধরনের পরিযায়ী পাখিগুলো প্রধানত স্থায়ী। তবে খাদ্যাভাব দেখা দিলে এরা তাদের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্রের আশেপাশে অন্য অঞ্চলে গমন করে। এদের পরিযান অনিয়মিত। চাতক, পাপিয়া, খয়েরিডানা পাপিয়া স্বল্পদৈর্ঘ্যরে পরিযায়ী পাখি।

মধ্যদৈর্ঘ্য পরিযান: এ প্রজাতির পাখিরা প্রায়শ পরিযান ঘটায়, তবে পরিযানের বিস্তার স্বল্পদৈর্ঘ্যরে পরিযায়ী পাখিদের তুলনায় অনেক বেশি হয়।

দীর্ঘদৈর্ঘ্য পরিযান: এ প্রজাতির পাখিদের পরিযান এক বিশাল এলাকা জুড়ে ঘটে। এ ধরনের পাখিদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে এক বা একাধিক সপ্তাহ লাগে। এসময় এরা হাজার হাজার মাইল দূরত্ব পাড়ি দেয়। নীলশির, লালশির, কালো হাঁস, লেন্জা হাঁস, ক্ষুদে গাংচিল দীর্ঘদৈর্ঘ্যরে পরিযায়ী পাখি।

পাখিরা কীভাবে পথ চেনে

দীর্ঘ যাত্রায় পাখিরা কীভাবে পথ চেনে, সে এক রহস্য। দেখা গেছে, পথ চেনাতে অভিজ্ঞ পাখিরাই ঝাঁকের সামনের দিকে থাকে। নতুনরা থাকে পেছনে। এ ক্ষেত্রে পাখিরা উপকূলরেখা, পাহাড় শ্রেণি, নদী, সূর্য, চাঁদ, তারা ইত্যাদির মাধ্যমেই পথ খুঁজে নেয় বলে ধারণা করা হয়। যেসব পাখি একা ভ্রমণ করে, তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জীবনে প্রথমবার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেও তারা গন্তব্যে পৌঁছে যায়। এ জন্য বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রই পাখিদের পথ চেনায়।

পরিযায়ী ও অতিথি পাখির পার্থক্য

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, টেলিভিশনে, বই-পুস্তকে অনেকে পরিযায়ী পাখিদেরকে অজ্ঞতাবশত অতিথি পাখি, গেস্ট বার্ড, ভিনদেশি পাখি বা বিদেশি পাখি হিসেবে অভিহিত করে। আবার বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি বললেই ধরে নেওয়া হয় কেবল শীতকালে আসা হাঁস আর রাজহাঁসকে। এ হিসেবে কালেম, ডাহুক বা পাতি সরালিকেও শীতের পাখি হিসেবে অভিহিত করা হয়, যদিও এরা বাংলাদেশের নির্ভেজাল স্থানীয় বাসিন্দা প্রজাতির পাখি। পরিযায়ী পাখিমাত্রই যে হাঁসজাতীয় ও জলচর পাখি, এমনটা নয়। পরিযায়ী পাখির এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে খঞ্জনা, চটক, মাঠ চড়ুই, কসাই পাখি, গাঙচিল, বিভিন্ন শিকারি পাখি ইত্যাদি। তাছাড়া পরিযায়ী পাখি বসন্তে বা শরৎকালেও আসতে-যেতে পারে।

বাংলাদেশে যেসব পাখি পরিযানে আসে

পৃথিবীতে প্রায় ১২ হাজার প্রজাতির পাখি আছে, তার এক-তৃতীয়াংশই পরিযায়ী পাখি। বাংলাদেশে ৭০০ এর অধিক প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখিদের একটি বড় অংশ ঘাসবনের পাখি। এরা সাধারণত রাতের বেলা অন্ধকারে দলবেঁধে পরিযায়ন করে। পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, এরা মূলত শিকারি পাখিদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে রাতের অন্ধকারে পরিযায়ন করে। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস। এদের মধ্যে বাংলাদেশে ১৭ প্রজাতির হাঁস পরিযায়ন করে। পরিযায়ী পাখিগুলো আমাদের দেশে বিল, ঝিল, হাওড়, বাওড়, হ্রদ, নদ, নদী, নালা, সাগর ও জলাভূমিতে বাস করে থাকে। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের ধারণা, পরিযায়ী পাখি মূলত মাছ খেয়ে জীবনধারণ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরিযায়ী পাখিরা ভাসমান জলজ উদ্ভিদ, ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ ও পোকামাকড়, শামুক, ব্যাঙাচি, জলজগুল্ম, শ্যাওলা ইত্যাদি খেয়েও জীবনধারণ করে। কিছু পরিযায়ী পাখি ছোট মাছ খেয়ে থাকে।

শিকার করলে দুই লাখ টাকা দণ্ড

পরিযায়ী পাখিরা শুধুমাত্র নিজেদের প্রশান্তির জন্যই আমাদের দেশে আসে না। আমাদের দেশে অতিথি হয়ে আসা এসব পাখি নানাভাবে আমাদের উপকারও করে চলেছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এ দেশের একশ্রেণির মানুষ অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা ও আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য পরিযায়ী পাখি শিকার করে। অনেকে বাজারে বিক্রির জন্য বিষটোপ, বাটুল, জালের ফাঁদ ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করে পরিযায়ী পাখি শিকার করে থাকে। শৌখিন শিকারিদের উদ্দেশ্যে মাংস খাওয়া এবং ক্ষমতা ও আভিজাত্যর বহিঃপ্রকাশ আর অন্যান্য শিকারিদের উদ্দেশ্যে বাজারজাত করে স্বল্প পরিশ্রমে বেশি আয় করা। বাংলাদেশ সরকার পরিযায়ী পাখি/বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ প্রণয়ন করেছে। সেই আইনের ধারা ৩৮ এর (১ ও ২) অনুযায়ী পরিযায়ী পাখিকে আঘাত করা, দখলে রাখা, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, মাংস ভক্ষণ, এয়ারগান দিয়ে শিকার, বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ধরা, প্রজননের সময় বিরক্ত, ডিম নষ্ট ও হত্যা করা ইত্যাদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার সর্বোচ্চ শাস্তি ২ বছর কারাদণ্ড অথবা ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

পরিযায়ী পাখির উপকারি দিক

আমরা গভীরভাবে কখনোই উপলব্ধি করি না, কিন্তু পরিযায়ী পাখি পরিবেশকে সুস্থ রাখার জন্য অনবদ্য অবদান রেখে চলছে প্রতিনিয়ত। পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড় নিধন করে। পরিযায়ী পাখি ফুল ও শস্যের পরাগায়ন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শীতের সময় ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখির আগমনে নৈসর্গিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। পরিযায়ী পাখির বিষ্ঠা জমিতে পড়ার ফলে জমির উর্বর শক্তি বৃদ্ধি পায়। জমিতে নাইট্রোজেনের আবির্ভাব ঘটিয়ে জমির উর্বর শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পরিযায়ী পাখি পানিতে সাঁতরানোর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। পরিযায়ী পাখির বিষ্ঠায় মাছের খাবার তৈরি হয়, ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া, পরিযায়ী পাখির দৈহিক সৌন্দর্য, আকাশে উড়ার দৃশ্য, বৈচিত্র্যময় জীবনাচরণ মানুষকে বিনোদন দেয়।

পরিযায়ী পাখির ক্ষতিকর দিক

পরিযায়ী পাখিরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিপজ্জনক রোগের জীবাণু বহন করার জন্য অনেকাংশে দায়ী। এ পাখিরা বহু বছর ধরে নির্দিষ্ট কিছু জীবাণু বহন করে বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঐ জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। ফলে এরা অনেকটা ঐ জীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে এবং অন্যত্র জীবাণু ছড়িয়ে দেয়। প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন কোনো প্রজাতি পরিযায়ী প্রজাতির সংস্পর্শে আসলে সাথে সাথে আক্রান্ত হয়। পশ্চিম নীল ভাইরাস এবং এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস (যার জন্য বার্ড ফ্লু রোগ হয়) এমনই দু’টি জীবাণু। সিট্টাকোসিস পরিযায়ী পাখিবাহিত একটি রোগ।

শেষ কথা

পরিযায়ী পাখিরা আমাদের মেহমান। তাদের হত্যা না করে সবার ভালোবাসা উচিৎ। এই দিবসটির তাৎপর্য ছড়িয়ে যাক সবার মাঝে। তাহলেই বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস উদযাপন সার্থক হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 × three =