মুশফিকুর রহমান
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ১ অক্টোবর ২০২৪ থেকে প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের নির্দেশনা দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম ধাপে শহরাঞ্চলের সুপার সপসমূহে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন গণজমায়েত, সুপার সপ, বাজার ঘুরে মানুষকে সচেতন ও উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন। পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিন (টিস্যু ব্যাগ) ব্যাগ (শপিং ব্যাগ) ব্যবহারের কারণে পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য নানামুখী ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতি থেকে বাঁচতে পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগের ব্যবহার থেকে আমাদের দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। ১ নভেম্বর ২০২৪ থেকে কাঁচাবাজারেও পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হবে। ভোক্তা বাজারে পলিথিন ব্যাগের চাহিদা সঙ্কুচিত হলে সরবরাহও সঙ্কুচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পলিথিন এবং প্লাস্টিক ব্যাপক ব্যবহৃত উপাদান। বাজারের ব্যাগ, আবর্জনা সংগ্রহের ব্যাগ, নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মোড়ক, তৈজসপত্র, পানির বোতল, তেলের বোতল, খাদ্য সামগ্রীর মোড়ক, ঔষধের বোতল, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, শিশুদের খেলনা, ঘর গেরস্থালির অসংখ্য উপাদান, জুতা, স্যান্ডেল চেয়ার, টেবিল, বালতি, মগ, কাপ-গ্লাস, প্লেট, কার্পেট, কৃষিকাজের নানা উপাদান এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্লাস্টিক, পলিথিন, পলিপ্রপাইলিন দিয়ে তৈরি। সহজলভ্য, সস্তা, টেকসই এবং ব্যবহার উপযোগিতা ও স্বাচ্ছন্দ্যের কারণে মানুষ ব্যাপকভাবে পলিথিন এবং প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়েছে।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ, ৪৮ হাজার কোটি পানীয় সংরক্ষণের বোতল উৎপাদিত হয় এবং প্রতি মিনিটে প্রায় ১০ লক্ষ প্লাস্টিক বোতল বিক্রি হয়। বাংলাদেশেও প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা মূল্যের প্লাস্টিক কাঁচামাল আমদানি হয় এবং কোটি কোটি প্লাস্টিক বোতল, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়।
জীবাশ্ম জ¦ালানি তেল বা পেট্রোলিয়াম থেকে তৈরি রাসায়নিক পলিমার নির্ভর প্লাস্টিক ব্যবহারে বিভিন্ন সুবিধার কারণে এর ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। একই সাথে পরিবেশে প্লাস্টিক পণ্যের বর্জ্যও বাড়ছে। অপচনশীল হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে বর্জ হিসেবে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক দ্রব্য এবং এর ক্ষুদ্র কণা বাতাসে, জলে, স্থলে এমনকি পর্বতচুড়ায়ও অবাধে বিচরণ করছে। প্লাস্টিক বর্জ্য ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হয়ে যেতে দীর্ঘ সময় দরকার হয়। পুড়িয়ে প্লাস্টিক ধ্বংস করলে মারাত্মক ক্ষতিকর গ্যাস পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। অব্যাহতভাবে ব্যবহার বেড়ে চলা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের চারপাশের জমি, খাল-নালা-নদ-নদী-সমুদ্র সবখানেই প্লাস্টিক বর্জ্য জমছে। বর্জ্য প্লাস্টিক ও পলিথিনের উল্লেখযোগ্য অংশ জলাধার, নদ-নদী এবং সমুদ্রে গিয়ে জমা হয়। ফলে, সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য প্রাণী, অণুযজীব প্লাস্টিকের দূষণে আক্রান্ত হচ্ছে। নদী, জলাশয়, সমুদ্রে বসবাসকারী জলজ প্রাণী, মাছ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া পলিথিন বা প্লাস্টিকে আটকে মারা যাচ্ছে। খাদ্য হিসেবে খেয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। সেই মাছ বা প্রাণী মানুষের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। খাদ্য চক্রে প্লাস্টিক দূষণ বিস্তৃত হওয়ায় জলজ প্রাণী, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, এবং মানুষ প্লাস্টিক দূষণে আক্রান্ত হচ্ছে। পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদে সঞ্চিত হয়ে থাকা পলিথিন নানারকম রোগ বালাই ছড়াচ্ছে এবং মানুষের সুস্থভাবে বসবাসের পরিবেশ বিপন্ন করছে।
খাদ্য, পানীয় এবং স্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মানুষের শরীরে নানাভাবে প্লাস্টিকের অণুবীক্ষণিক কণা বা মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করে ফুসফুস, যকৃৎ, প্লীহা এবং কিডনিতে গিয়ে জমা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা মায়ের বুকের দুধ, মানুষের মস্তিষ্ক, প্লাসেন্টাতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন। খনিজ তেল থেকে উৎপাদিত প্লাস্টিকের উপাদান বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক যৌগ যেমন মিথাইল, বিসফেনল এ, থালেটস, পারদ, পিসিবি, পিএএইচ, বিভিন্ন ভারী ধাতু মানুষের শরীরে প্রবেশ করায় কোষ ও হরমোনের পরিবর্তন, আচরণগত পরিবর্তন, হৃদরোগ, বিকাশজনিত ব্যাধি, প্রজনন অস্বাভাবিকতা সহ ক্যান্সার সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরী করছে। পরিবেশে যত বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়াচ্ছে, জানা এবং এখনও অজানা অসংখ্য রোগবালাইয়ে মানুষের আক্রান্ত হবার ঝুঁকি তত বাড়ছে।
তাছাড়া জমির উর্বরতা হ্রাস, জলাভূমি ভরাট হয়ে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রাণ ধারণ ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা, স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশন বাধা দেওয়াসহ পরিবেশে রোগবালাই ছড়িয়ে দেবার জন্য প্লাস্টিক বর্জ্য অনেকাংশে দায়ী।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মোট উৎপাদিত প্লাস্টিক উপাদানের প্রায় অর্ধেক একবার ব্যবহারের উদ্যেশ্যে তৈরি করা হচ্ছে এবং ব্যবহারের পর তা বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়। আমাদের প্রতিদিনের উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যরে উল্লেখযোগ্য অংশ প্লাস্টিক ও পলিথিন জাতীয় পণ্য। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়নের সম্প্রসারণ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুষঙ্গ হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ৪৭,০০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হবে এবং এই বর্জ্যরে প্রায় ১০% হবে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য। এখন পর্যন্ত বিভিন্নভাবে বর্জ্য থেকে প্লাস্টিক ও পলিথিন সংগ্রহ ও তা পুনঃচক্রায়নে সর্বোচ্চ এক তৃতীয়াংশ মাত্র প্লাস্টিক বর্জ্যর ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হয়েছে ।
দেশে প্লাস্টিক ও পলিইথিলিন শিল্প স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান এবং রপ্তানি আয়েরও গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সে পটভূমিতে প্লাস্টিক শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে প্লাস্টিক বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। ইতিপূর্বে হাইকোর্ট পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রেেণ দেশে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বহন ও ব্যবহার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেছেন। বিশেষত দেশের উপকূলীয় এলাকার হোটেল, মোটেল এবং রেস্টুরেন্টগুলোতে একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আমি পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদকে জিজ্ঞাস৭ করেছিলাম যে অক্টোবর মাসের প্রথম দিন থেকে শহরাঞ্চলের সুপার শপগুলোতে পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ নিষিদ্ধ করার যে তৎপরতা শুরু হয়েছে তা ২০০২ সালে নেওয়া সরকারের সিদ্ধান্তের ধারাবাহিক বাস্তবায়ন, নাকি বর্তমানে শুরু করা উদ্যোগ নতুন কর্মসূচি?
তিনি আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে সরকারের ইতিপূর্বে ২০০২ সালে নেওয়া পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের ধারাবাহিক বাস্তবায়ন হিসেবেই বর্তমানে নেওয়া কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। তিনি আশা করছেন যে সুপার শপ এবং কাঁচা বাজারে পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ ব্যবহার রোধ করা গেলে এ সকল পণ্যের চাহিদা হ্রাস পাবে এবং উৎপাদক ও সরবরাহকারীরা নিরুৎসাহিত হবে।
ভোক্তা পর্যায়ে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করতে এর ‘চাহিদা ও সরবরাহ’ ব্যবস্থার দুদিকেই কার্যকর নিয়ন্ত্রণ দরকার হবে। সেই সাথে পলিথিন ব্যাগের উপযুক্ত, সহজ ও টেকসই বিকল্প পণ্য ব্যবহারকারীদের জন্য হাজির করতে পাট ও বস্ত্র শিল্পের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। সরকারের পক্ষ থেকে পাট, কাগজ ও কাপড়ের ব্যবহার উপযোগী বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ উৎপাদন ও সরবরাহের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সুপার শপগুলো ইতিমধ্যে তাদের আউটলেটগুলোতে সুদৃশ্য ও সহজে বহুবার ব্যবহার উপযোগী পাট, কাগজ ও কাপড়ের ব্যাগের সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রতিদিন দেশে যে বিপুল পরিমাণ পলিথিন ব্যাগ এবং অন্যান্য প্লাস্টিক উপাদান বর্জ্য হিসেবে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে তা পুনঃচক্রায়ন বা রি-সাইক্লিংয়ের কিছু উদ্যোগ আগে থেকেই চালু আছে। তবে প্রতিদিন উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্যরে বিবেচনায় তা সর্বোচ্চ এক তৃতীয়াংশ মাত্র হতে পারে।
পলিথিন ও প্লাস্টিক সহজে পচে না। এর পুনঃব্যবহার সম্ভব কিন্তু চারপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্যরে অতি সামান্য অংশ সংগ্রহ করে তা পুনঃব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের দেশেও এখন প্লাস্টিক পণ্যের রি-সাইক্লিং ও লাভজনকভাবে পুনঃব্যবহার শুরু হয়েছে। দেশে ইতিমধ্যে কিছু আধুনিক প্লাস্টিক বর্জ্য পুনঃচক্রায়ন করার কারখানাও চালু হয়েছে।
দূষণের বিস্তৃতি ও তার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে ভালো পন্থা তা উৎসে ঠেকানো। সে কারণে পলিথিন উৎপাদন, বিতরণ ও বিপণন রোধ করা এবং ভোক্তা পর্যায়ে তা পৌঁছানো রোধ করার চেষ্টা করা জরুরি। এজন্য মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন প্রয়োজন। একই সাথে মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করতে পলিথিন ব্যাগের টেকসই ও সহজ পরিবেশবান্ধব বিকল্প অনুসন্ধানও গুরুত্বপূর্ণ। দেশীয় সম্পদ ব্যবহার করে তেমন উপযুক্ত বিকল্প তৈরি করা গেলে সবচেয়ে ভালো বিকল্প হতে পারে। পাট ও কাপড় থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন ব্যাগ সহজেই মানুষ ব্যবহার করতে পারে, যা বহুবার ব্যবহার উপযোগী ও পরিবেশবান্ধব। পাট থেকে উৎপাদিত সেলুলোজ প্রক্রিয়াজাত করে দেশের বিজ্ঞানিরা উদ্ভাবন করেছেন কম্পোস্টেবল বা পচনশীল পলিথিনের মতোই সহজে ব্যবহারযোগ্য ‘সোনালি ব্যাগ’। সীমিত পরিসরে সোনালি ব্যাগের উৎপাদন এবং বিপণন শুরু হয়েছে। ২০২৫ সাল থেকে পরিবেশবান্ধব সোনালি ব্যাগ বড় পরিসরে উৎপাদন ও বাজারজাত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিজেএমসি।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ