গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত
আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড। ভৌগলিকভাবে উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত হলেও, প্রশাসনিকভাবে দ্বীপটি ইউরোপের অন্তর্ভুক্ত। গ্রিনল্যান্ডের সিংহভাগ অঞ্চল বরফে ঢাকা এবং কোথাও এই বরফের পুরুত্ব ৩ কিলোমিটারেরও বেশি। ২০২০ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী গ্রিনল্যান্ডের জনসংখ্যা ৫৬,০৮১। গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের স্ব-নিয়ন্ত্রিত একটি অংশ হিসেবে পরিচিত। মেরু ভালুক বা পোলার বিয়ারের দেখা শুধুমাত্র গ্রিনল্যান্ডেই পাওয়া যায়।
মানুষের বসবাস ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে
২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে গ্রিনল্যান্ডে বসবাস শুরু হয় ও এই সময় ইনুইটরা এখানে আসে বলে ধারণা করা হয়। এরপর এ অঞ্চলে বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এসে বসবাস শুরু করে। ধারণা করা হয় এরিক দ্যা রেড নামের এক ব্যক্তি এই দ্বীপের নামকরণ করেন।
বাংলাদেশের চেয়ে ১৫ গুণ বড়
গ্রিনল্যান্ড দ্বীপের আয়তন ২১,৬৬,০৮৬ বর্গ কিলোমিটার বা ৮,৩৬,৩৩০ বর্গমাইল। বাংলাদেশের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে ১৫ গুণ বড় এই দ্বীপ। আয়তনের দিক হতে গ্রিনল্যান্ডকে পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ বলা হয়। এই দ্বীপটি যা ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, স্পেন, ইতালি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের সমান। তবে দেশটির প্রায় ১৮,০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল বরফে ঢাকা। অর্থাৎ দ্বীপটির চার ভাগের তিন ভাগই বরফে আচ্ছাদিত। গ্রিনল্যান্ডের শহরগুলো আটলান্টিক এবং আর্কটিক মহাসাগরের উপকূল ঘেঁষা। কারণ, এই অঞ্চলগুলোই (প্রায় ৩,৪১,৭০০ কিলোমিটার) কেবল বরফমুক্ত। যা নরওয়ের চেয়ে বড় এবং ডেনমার্কের দশ গুণ। দেশটির উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলের দূরত্ব ২৬৭০ কিলোমিটার।
দিনে সূর্যের দেখা মিলে ৩ ঘণ্টা
গ্রিনল্যান্ড দ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান মেরু অঞ্চলে হওয়ায় সেখানে সূর্যের দেখা পাওয়া যায় মাত্র ৩ ঘণ্টা বা তার একটু বেশি কিংবা কম সময়। ফলে সেখানকার শীতকাল খুব দীর্ঘ সময় হয়ে থাকে। প্রচণ্ড ঠান্ডা ও অন্ধকারাচ্ছন্ন এক পরিবেশ থাকে গোটা গ্রিনল্যান্ডে। তবে এই ঠান্ডা অন্ধকারাচ্ছন্ন দ্বীপেও লুকিয়ে রয়েছে বিচিত্র সব সৌন্দর্য। শুনে অনেকেই অবাক হতে পারেন যে, এই দেশে গ্রীষ্মকালে সূর্য অস্ত যায় না। স্থানীয় সময় অনুযায়ী মধ্যরাতেও গ্রিনল্যান্ডে সূর্যের দেখা পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও এখানে তাপমাত্রা শূন্য থেকে চার ডিগ্রির মধ্যে থাকে। শীতকালে আকাশে বিভিন্ন রঙের আলো দেখা যায়, একে বলা হয় মেরুজ্যোতি।
আকাশপথে ৫ ঘণ্টায় পৌঁছান সম্ভব
অন্য দেশ থেকে গ্রিনল্যান্ডে সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে কেবল ৪টি বিমানবন্দরই ভরসা। এদের মধ্যে ৩টিই ইউরোপের আইসল্যান্ডে অবস্থিত। আইসল্যান্ডের বিমানবন্দর ৩টি – রেইকভিক, কেফ্লাভিক এবং আকুরেরি। আর চতুর্থ বিমানবন্দরটি অবস্থিত ইউরোপের আরেকটি দেশ ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে। এই বিমানবন্দর থেকে এয়ার গ্রিনল্যান্ডের ফ্লাইটে চড়ে ৫ ঘণ্টায় গ্রিনল্যান্ড পৌঁছানো সম্ভব। এ ছাড়া কানাডিয়ান আর্কটিক ও নরওয়ের সভালবার্ড থেকে সমুদ্রপথে জাহাজে চড়ে আইসল্যান্ডে পৌঁছানো যায় এবং আইসল্যান্ড থেকে গ্রিনল্যান্ড। গ্রিনল্যান্ডের অভ্যন্তরে রয়েছে ১৬টি বড় শহর। কিন্তু একটি শহর থেকে আরেকটি শহরে যাতায়াতের সু-ব্যবস্থা নেই। যদিও কিছু শহরের দূরত্ব খুবই কম।
যাতায়াতে ব্যবহার হয় কুকুর
এটি বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে কোনও রেল ব্যবস্থা নেই। বরফের রাজ্য গ্রিনল্যান্ডে যাতায়াত ব্যবস্থা সুবিধাজনক নয়। অন্য দেশ থেকে গ্রিনল্যান্ডে সরাসরি যাতায়াতের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠে দেশটির অবস্থান হলেও নেই আন্তর্জাতিক ফেরি সার্ভিস। এখানে সাধারণ গাড়ির চেয়ে নৌকা বা হেলিকপ্টার বেশি চলে। বেশিরভাগ মানুষই এখানে হেলিকপ্টার বা কুকুরে টানা স্লেজ গাড়িতে ভ্রমণ করেন। ৪-৫টি কুকুরের সঙ্গে একটা সেøজ গাড়ি জুড়ে যানবাহন তৈরি করা হয়।
৯৫ শতাংশ ইনুইট খ্রিষ্টান ধর্মানুসারী
গ্রিনল্যান্ডে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের বসবাস। এটি বিশ্বের সর্বনিম্ন জনসংখ্যার দেশ। গ্রিনল্যান্ডে দুটি প্রাথমিক ভাষা রয়েছে গ্রিনল্যান্ডিক এবং ড্যানিশ। গ্রিনল্যান্ডিক ভাষায় গ্রিনল্যান্ডকে কালালিত নুনাত (জনগণের ভূমি) বলা হয়। এখানকার অধিবাসীরা ইনুইট নামেই পরিচিত। ইনুইট শব্দের অর্থ ‘মানুষ’। বিদেশিরা ইনুইটদের এস্কিমো বলে ভুল করে থাকে। যা স্থানীয় বাসিন্দার জন্য বেশ আপত্তিকর। তারা নিজেদের এস্কিমোর বদলে ইনুইট পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। গ্রিনল্যান্ডে প্রায় ৮৮ শতাংশ ইনুইটের বসবাস। বাকি ১২ শতাংশ আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ফিলিপাইন, সুইডেন, নরওয়ে, জার্মানি এবং ড্যানিশ বা ডাচদের উত্তরসূরি (অর্থাৎ মিশ্র ইনুইট)। প্রায় ৯০ শতাংশ ইনুইট দেশটির ১৬টি শহরে বাস করে। গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী নুক-এ প্রায় ১৮ হাজার ইনুইট বসবাস করে। বাকি ১০ শতাংশ ইনুইন সম্পূর্ণ বরফের তৈরি ছোট ছোট বসতিতে বসবাস করে। ইনুইটরা দেখতে সাধারণত বেঁটে ও স্বাস্থ্যবান গড়নের হয়ে থাকে। তাদের নাক থাকে চ্যাপ্টা, চুল কালো ও খাড়া। গ্রিনল্যান্ডে বসবাসরত পুরুষ ও নারীর গড় আয়ু যথাক্রমে ৬৯ এবং ৭৪ বছর।
গ্রিনল্যান্ডের নিজস্ব মুদ্রা নেই
গ্রিনল্যান্ড এমন একটি দেশ যার নিজস্ব মুদ্রা নেই। আসলে, গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের একটি অংশ, তাই এখানে ডেনমার্কের মুদ্রা চলে। এখানকার এক ডলার, বাংলাদেশের প্রায় ১৫ টাকার সমান।
৮০ ঘণ্টা লাগবে দ্বীপের একদিক ভ্রমণ করতে
কোনও পর্যটক যদি দ্বীপের প্রত্যেক দিক ভ্রমণ করেন তাহলে প্রতিটি দিকের জন্য ৮০ ঘণ্টা করে সময় লাগবে। এখানে প্রায় ২২৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় এবং বাসিন্দারা মাছ বিক্রি করেই তাদের সংসার চালান। গ্রিনল্যান্ডে এমন সব বিরল প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়, যেগুলি বিশ্বের অন্য কোনও দেশে একরকম বিরল। রেইনডিয়ার, সাদা খরগোশ, আর্কটিক ফক্স এবং এরমিনের মতো প্রাণীরা এখানে বসবাস করে।
১৭২ বছর আয়ু গ্রিনল্যান্ড হাঙরের
উত্তর আটলান্টিকের গভীর সমুদ্রের বসবাসকারী গ্রিনল্যান্ড হাঙরকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ-আয়ুর মেরুদণ্ডী প্রাণী। এরা কমপক্ষে ১৭২ বছরের আয়ু নিয়ে জন্মায়। এমনকি এ প্রজাতির কোনো কোনো হাঙর ৫শ বছরও বাঁচে। গ্রিনল্যান্ড হাঙরের উপর গবেষণা চালিয়ে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান ইউনিভার্সিটি অব কোপেনহেগেনের প্রাণী বিজ্ঞানীরা। এ হাঙর ১৫০ বছর বয়স হওয়ার আগে বংশবিস্তার করতে পারে না। এদের বসবাস উত্তর আটলান্টিকের শীতল পানিতে, তাই প্রজাতিটি খুবই বিপদের মধ্যে রয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ন্যাশনাল পার্ক
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাতীয় উদ্যান গ্রিনল্যান্ডে অবস্থিত। ‘নর্থ-ইস্ট গ্রিনল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক’ নামে এই পার্ক জীববৈচিত্র্যের অনন্য এক লীলাভূমি। এখানে প্রায় ৩১০ প্রজাতির ভাস্কুলার উদ্ভিদের দেখা মেলে, যার মধ্যে ১৫ প্রজাতির উদ্ভিদ পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। ডেনমার্ক এবং গ্রিনল্যান্ডের দুটি মন্ত্রণালয় পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। মন্ত্রণালয় দুটি প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সহযোগিতা করে আসছে। নর্থ-ইস্ট গ্রিনল্যান্ড ন্যাশনাল পার্কটি ১৯৭৪ সালে প্রথম তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে এর আকার প্রসারিত করে ০.৯৭ মিলিয়ন বর্গ কিমি করা হয়। পার্কটিতে সংরক্ষিত উদ্ভিদ ও প্রাণী এবং বরফে আচ্ছাদিত গ্রিনল্যান্ডকে রক্ষা করে। এখানে বিরল প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে মাস্ক ষাঁড়, মরু ভালুক, আর্কটিক নেকড়ে, আর্কটিক খরগোশ, রেইনডিয়ার এবং তুষারময় পেঁচা। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সম্পদেও গ্রিনল্যান্ড পৃথিবীখ্যাত। এখানকার সাগর উপকূলে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় হুডেড ও গ্রে শিলদের। আছে সাদা বেলোগা তিমি, লম্বা দাঁতের ওয়ালরাস। আছে পেরেগ্রিন ফ্যালকন, বড় পানকৌড়ি, গাঙচিলসহ নানা প্রজাতির পাখি। পার্কটি পশুপাখিদের অভয়াশ্রম। তবে, এখানেও কিছু মানুষের উপস্থিতি আছে। গবেষকরা এই অঞ্চলে টানা বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালান। অনেক পর্যটকও কৌতূহলবশত গবেষণা চালানোর প্রয়াস করেন। ফলে অনেক সময় উদ্ভিদ এবং প্রাণীর ক্ষতি হয়। দেশটির সবচেয়ে দূরবর্তী শহর ইতোকরতরমিত থেকে শিল ও তিমি ব্যবসায়ীরা এখানে যাতায়াত করেন। যা পূর্ব গ্রিনল্যান্ডে অবস্থিত। পার্কটির বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন। দ্রুত বরফ গলে সমুদ্রের পানি বেড়ে বিপদসীমায় অতিক্রম করছে।
আত্মহত্যা প্রবণতায় বিশ্বে প্রথম
স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ায় গ্রিনল্যান্ডবাসী সারা বিশ্বে প্রথম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে গ্রিনল্যান্ড পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা প্রবণ দেশ। সংস্থাটির জরিপে আত্মহত্যার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে এমন ১১০টি দেশের মধ্যে প্রথম পাঁচটি দেশ হলো – গ্রিনল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, গায়ানা, দক্ষিণ কোরিয়া এবং কাজাখস্তান। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গ্রিনল্যান্ডের প্রতি লাখে অন্তত ৮৩ জন্য মানুষ স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণের পথ বেছে নেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রিনল্যান্ডের ইনুইটদের একটি বড় অংশ আদিম জনগোষ্ঠী। তাই নানা সঙ্গত কারণেই তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। যদিও গ্রিনল্যান্ডের দাবি, তারা নিজেকে হত্যা করছে।
ওয়ার্ল্ড গলফ চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন
১৯৭৭ সাল থেকে প্রতি বছর গ্রিনল্যান্ডের উম্মান্নাক শহরে অনুষ্ঠিত হয় ওয়ার্ল্ড গলফ চ্যাম্পিয়নশিপ। আর্কটিক মহাসাগর থেকে ৬০০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত শহরটি। মাত্র ১৩০০ মানুষের বসবাস এখানে। এটি বিশ্বের উত্তরতম গলফ কোর্স। বিশাল তুষারস্তূপ ও হিমবাহের পথ ধরে চলে গলফ খেলা। মার্চ মাসে যখন খেলা শুরু হয় তখন তাপমাত্রা নেমে আসে মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। প্রচণ্ড ঠান্ডা এবং বিরূপ আবহাওয়া অন্যান্য দেশ থেকে অংশ নেওয়া গলফারদের কোনোভাবেই নিরুৎসাহিত করতে পারে না। পেশাদার ও অপেশাদার দুই ধরনের গলফার প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। চূড়ান্ত পর্বে কেবল ৩৬ জনই সুযোগ পান। জনপ্রিয় খেলাটির আয়োজক ওয়ার্ল্ড আইস গলফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফাউন্ডেশন।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা