প্রত্যাশা হতাশায় শুরু ২০২৫

উপল বড়ুয়া

‘পৃথিবী বদলে গেছে/যা দেখি নতুন লাগে’, কিশোর কুমারের এই গান শুনেননি এমন শিক্ষিত বাঙালি পাওয়া পাওয়া যাবে না বললেই চলে। এই যে পৃথিবী প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে, তা আমরা ক’জনে খেয়াল করি? খেয়াল না করলেও কিশোর কুমারের গানের মতো পৃথিবী প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে। যেখানে একদিন মাঠ ছিল সেখানে এখন বিশাল দালান। যে বনে আগে হাতির আনাগোনা ছিল সেখানে চলছে রেলগাড়ি। এই যে চোখের পলকে একটি বছর চলে গেল, নতুন বছর এলো, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে কতক্ষণ লাগল? ঘটনাবহুল একেকটি বছরের সঙ্গে আমাদেরও জীবনে অনেক কিছু অতীত হয়ে পড়ে। তারপরও আমরা নতুন বছরে অপেক্ষায় থাকি নতুন কিছুর জন্য। ২০২৫ সালের পৃথিবী কেমন হবে? জ্যোতিষী না হলেও অতীত ও বর্তমান ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ ও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে যে কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। আমরাও না হয় সেটিই করি। গণবিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের পলায়নে ২০২৪ সাল ইতিমধ্যে সিংহাসনচ্যুতির বছর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। রাজনীতির মাঠে নতুন বছরেও কি তেমন কিছু দেখব আমরা? সেই উত্তর না হয় ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকল। তার আগে একটু তথ্য, উপাত্ত ঘেঁটে, তত্ত্ব কপচিয়ে, বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলে নতুন পৃথিবী কেমন হবে দেখা যাক।

বাংলাদেশ কোনে পথে

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর বিশাল এক পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসন শেষ হয়েছে। শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রীদের অনেকে এখন ভারতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় যা হয়েছিল, বাংলাদেশেও সেই একই অকল্পনীয় দৃশ্য। অনেক বাধা-বিপত্তির পরও লঙ্কানরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ভোটের মাধ্যমে এসেছে গণতান্ত্রিক সরকার। গত সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হন বামপন্থী অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। বাংলাদেশ অবশ্য এখনই ভোটের পথে হাঁটছে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার অবশ্য আশ্বাস দিয়েছে শিগগিরই নির্বাচনের। রাজনৈতিক দলগুলোও আশা করছে, ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের। সে জন্য বিএনপি-জামায়াতের মতো দলগুলো শুরু করেছে দল গোছানো। আত্মপ্রকাশ ঘটেছে নতুন দলেরও। সামনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগও কি অংশ নিতে পারবে? আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে কি বাংলাদেশে নতুন কোনো দল ক্ষমতায় আসতে পারবে? সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে। তারপরও আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনের সুযোগ পায় তবে চাইবে কিছু হলেও আসন সংখ্যা ধরে রাখতে। তবে সেটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ, নেত্রী ও নেতাদের স্বার্থপরের মতো পলায়নের যে ন্যারেটিভ বা বয়ান তৈরি হয়েছে, সেটি তাদের ক্ষমতায় ফেরাতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

সেনাবাহিনীকে আপাতদৃষ্টিতে ক্ষমতায় নেই দেখা গেলেও পরোক্ষভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তারা। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাদের। এর আগে ২০০৭ সালে দায়িত্বে আসা ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সমালোচিত হওয়ার কারণে সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে নিজেদের নাম জড়ায়নি। তবে দেশের পরিস্থিতি বেসামাল হলে যেকোনো সময় জরুরি অবস্থা জারি করার প্রস্তুতি পরিকল্পনা করে রাখবে নিশ্চিত।

বাংলাদেশের জনগণের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, নির্বাচন কবে? নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত দেশের কোনো কিছুই স্বাভাবিক হবে না মনে করছে অধিকাংশ জনগণ। দেশের আরেক বড় দল বিএনপিও দ্রুত নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। আওয়ামী লীগের অধীনে গত দুই নির্বাচন বর্জন করেছিল তারা। এবার নির্বাচন হলে বিএনপির বড় প্রতিপক্ষ হতে পারে জামাত ও তার শরিক দল। এছাড়া ভোটের মাঠে বড় দাঁও মারতে পারে ছাত্রদের নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দলও।

কেমন হবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক রাজনীতি

রাজনীতির ক্ষেত্রে বড় বিষয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। কথায় আছে, ‘শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখাতে হয়’। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সেটাই প্রযোজ্য। শেখ হাসিনার সঙ্গে দিল্লীর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগের পতন এখনও মেনে নিতে পারেনি নরেন্দ্র মোদী সরকার। যার কারণে অভ্যুত্থানের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক বৈরিতার দিকে। প্রপাগাণ্ডামূলক খবর প্রকাশ করে জনগণের মনে ক্ষোভ তৈরি করায় আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারি কমিশনে হামলার মতো ঘটনাও ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়ে ক্রমাগত প্রপাগাণ্ডা তো চলছেই। ভিসাও বন্ধ রেখেছে ভারত। তবে এতে ক্ষতি দুই দেশেরই। কারণ, সীমানা ভাগাভাগি করা দুই দেশের বৈরিতা কখনও কাউকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। প্রতিবেশির ঘরে আগুন লাগলে নিজের ঘরও যে পোড়ার সম্ভাবনা থাকে! দুই দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি, পানি বণ্টনের মতো বিষয় নিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের পর আলোচনার জন্য বৈঠকের গুঞ্জন উঠলেও এখনও সেটি হয়নি। ড. ইউনূসের আমলে সেটির সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতির ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে পাকিস্তান। পণ্যের পাশাপাশি সাংস্কৃতিকভাবেও দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চোখে পড়ার মতো। তবে এ দেশের অধিকাংশই একাত্তরের গণহত্যাকারী পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মেলাতে নারাজ। নতুন বাংলাদেশ কাকে কাছের বন্ধু মনে সেটির ওপরেই নির্ভর করছে অনেক কিছ্।ু মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিকের হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসায় বিশ্ব রাজনীতিতেও নতুন হাওয়া লেগেছে। ডেমোক্রেটিকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ড. ইউনূসের। তার দীর্ঘদিনের বন্ধু হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়েই কিন্তু প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ট্রাম্প। এবারও তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মোদী। ট্রাম্প ঝানু ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। টাকার গন্ধ পেলেই ছুটে যান। সম্পর্ক যাই হোক, অনেকে মনে করেন ট্রাম্প টাকা-পয়সার হিসাব বা ব্যবসাকেই প্রাধান্য দেবেন তার রাজনীতিতে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরপরই আরেক দফা ডলারের মান বেড়েছে। নিজেদের ইতিহাসে ডলারের বিপরীতের সবচেয়ে বেশি দরপতন হয়েছে ভারতের রুপির। ভারত চাইবে যেকোনো প্রকারে আমেরিকার সঙ্গে সমঝে চলতে। নয়তো ট্রাম্পের অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর খেলায় ভুক্তভোগী হতে পারে ভারত। এমনকি সম্পর্ক খারাপের দিকে যাওয়ায় কানাডা সরকারও সেই পথে হাঁটতে পারে। এমনটা হলে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা খেতে পারে ভারত। মার্কিন মুলুকে বিশাল এক জনগোষ্ঠি রয়েছে ভারতের। রেমিটেন্স থেকে আয়ে শীর্ষে থাকা দেশের একটি ভারত। এশিয়ার বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চীন তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক অবনতি হয়েছে বিজেপি সরকারের আমলে। যার কারণে আগামী ভোটের মাঠে চাপে পড়তে পারেন মোদী। তবে সিংহাসন ধরে রাখতে দুই ট্রাম্প কার্ড খেলতে পারেন তিনি। ১. ধর্মীয় রাজনীতি ২. ইন্ডিয়া জোটে ভাঙন। গত নির্বাচনে কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি ও আরও কয়েকটি দল মিলে গড়া ইন্ডিয়া জোট বিজেপিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তবে এবার কংগ্রেস ও আম আদমির মধ্যে বিচ্ছেদের সুর শোনা যাচ্ছে। নির্বাচন অবশ্য আরও অনেক বছর আছে। তার আগে কী ঘটে সেটি বলা মুশকিল। তবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় না ফেরানো পর্যন্ত তারা পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও বিরোধিতা করে যাবে মনে করা হচ্ছে। তবে নেপাল ও মালদ্বীপের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বিরোধ স্বাভাবিকভাবে প্রভাব ফেলবে সার্কভুক্ত বা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের পর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা মোদী সরকারেরও তেমন পতন হতে পারে মনে করেন অনেকে। তবে ১৫০ কোটি জনসংখ্যার ভারতে সেটি হলে আন্তর্জাতিক বাজারে বড় ধরনের ধস নামবে।

এদিকে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ইস্যুতে সম্পর্ক অবনতি হয়েছে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। এক সময় দুই দেশের সম্পর্ক ভালো থাকলেও এখন সেটি আগের মতো নেই। সেক্ষেত্রে পাকিস্তান আবারও ট্রাম্প সরকারের ভালো বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করতে পারে সীমান্তে আফগানিস্তানের তালেবান দমন করে। দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে সম্পর্কে চিড় ধরেছে। ডিসেম্বরে সেটি পৌঁছেছে হতাহতের পর্যায়ে। সীমান্তে তালেবান জঙ্গি দমনে হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। কাবুলও জানিয়েছে, হত্যার  জবাব দেবে তারাও। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার আসার পর থেকে নারীদের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে আরও। ভবিষ্যতেও সেটি বেড়ে যাওয়া মানে দেশটির জন্য আবারও অশনি সংকেত। ২০ বছর পর মার্কিন সৈন্যরা আফগানিস্তান ছাড়ার পর দেশটি ঘুরে দাঁড়ানোর আশা দেখালেও ধর্মীয় মৌলবাদ উল্টো পেছনের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রোহিঙ্গা ইস্যু

বাংলাদেশের জন্য এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশাল আকারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। রয়টার্স ও বিবিসির মতো সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, নতুন করে আবারও রোহিঙ্গাদের ঢল নামতে পারে বাংলাদেশ সীমান্তে। গত কয়েক মাসে আরও প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলাদেশে। তার কারণ, সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মিরা প্রায় দখলে নিয়ে ফেলেছে মিয়ানমার। হয়তো শিগগিরই পতন হতে পারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর। লম্বা সময় ধরে দুই পক্ষের যুদ্ধ চলছে। এমনকি সেটির ছাপ পড়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উখিয়া ও টেকনাফের গ্রামগুলোতেও। যুদ্ধাহত অবস্থায় পালিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছিল মিয়ানমারের বেশ কয়েকজন সেনাবাহিনীর সদস্যও। গুলি ও শেল এসে পড়েছিল বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতেও। আগে থেকে কয়েক ধাপে আসা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির আশ্রয় হয়েছে বাংলাদেশে। অনেকে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশেও গেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে কিছু রোহিঙ্গা আরাকানে রয়ে গিয়েছিল। এখন আরাকান আর্মির সশস্ত্র হামলায় সেনাবাহিনী একের পর এক অঞ্চল হারানোয় রোহিঙ্গারা আবারও সংকটে পড়ে গেছে। প্রাণের ভয়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয়ের খোঁজে চলে আসছে বাংলাদেশে। ধারনা করা হচ্ছে, আরাকানে আরও ৪-৫ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে। তারাও যদি বাংলাদেশমুখী হয় তবে সেই চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। যত দ্রুত সম্ভব, আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে না পারলে সেই ‘মানবিক বোঝা’ সারাজনম টানতে হবে বাংলাদেশকে। বিশেষ করে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সামাল দিতে এ দেশের নিরাপত্তাবাহিনীকে আলাদা শক্তি ব্যয় করতে হবে।

মধ্যপ্রাচ্য সংকট

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় ইস্যু এখন মধ্যপ্রাচ্য। লম্বা সময় ধরে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতন, ইয়েমেন যুদ্ধ; এই সংকট বাড়ছেই। কী হবে সামনের দিনগুলোতে? হোয়াইটহাউসের পরোক্ষ সম্মতিতে গাজায় লাখো মানুষ হত্যা করেছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। তার মধ্যে অধিকাংশ শিশু ও নারী। সেই যুদ্ধের ভেতর দিয়েই আরেকটি নতুন বছরে প্রবেশ করছে ফিলিস্তিন। নতুন বছরে স্বাধীনতা পাবে তো তারা? নেতানিয়াহুর ইসরায়েল যেভাবে দখলদারিত্বের ভেতর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলাতে শুরু করেছে, মনে হয় না গাজায় এত তাড়াতাড়ি শান্তি ফিরবে। হামাসও চাইবে প্রতিশোধ নিতে। গত অক্টোবরে নতুন আরেকটি যুদ্ধ প্রায় বেধেই যাচ্ছিল। ইরানের এক সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যার অভিযোগে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। অবশ্য তার অধিকাংশ ঠেকিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। সেই হামলায় আতশবাজি ফুটিয়ে ইরান সমর্থকেরা নেচে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে বটে তবে এরপর নেতানিয়াহুর সেনাবাহিনী হিজবুল্লাহদের দমনের জন্য লেবানন ও সিরিয়া সীমান্তে হামলা চালায়। সেই হামলা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তার মধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে খোমেনির ইরান। কারণ, রাশিয়া ও ইরান ব্লকের সিরিয়া হাতছাড়া হয়েছে তাদের কাছ থেকে। ডিসেম্বরের শুরুতে বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ নেয় সিরিয়ার। ২০১১ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছিল দেশটিতে। বাবা হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুতে ২০০০ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন বাশার আল আসাদ। তার আগে তার বাবার তিন দশকের শাসন চলেছে দেশটিতে। শুরুতে জনমুখী হলেও পরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে স্বৈরাচারী হিসেবে হাজির হন বাশার। পুতিন ও খোমেনির কারণে এতদিন টিকে থাকতে পারলেও শেষটায় তাকে পালিয়ে যেতে হয়েছে রাশিয়ায়। সিরিয়ায় বাশারের পতনের নেপথ্যে কাজ করেছে ইসরায়েল। সামনের সিরিয়া কেমন হবে সেটির রূপরেখাও এখন বাতলে দিচ্ছে ইসরায়েল। তাদের সেই ইচ্ছে বাস্তবায়ন হলে চাপ বাড়বে ইরানের ওপর। ফিলিস্তিনে হামলার শুরু থেকে ইসরায়েলের বিরোধিতা করে আসছে ইরান। হিজবুল্লাহকে ইসরায়েলে হামলার মদদ ও পৃষ্ঠপোষকও ইরান। সিরিয়া ও লেবাননের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যে পুরোপুরি ইসরায়েলের কব্জায় চলে আসবে। ইরান তখন আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে। ইসরায়েল চাইবে তাদের শত্রুদের পুরোপুরি নিজেদের কব্জায় রাখতে। এক্ষেত্রে সৌদি আরব নিজেদের নিরপেক্ষ ভূমিকায় রেখে আগের মতো ব্যবসা গোছানোর দিকেই মনোযোগ দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে এরদোয়ানোর তুরস্ককে সম্পর্ক মীমাংসার ভূমিকায় দেখা গেলেও তারাও সরাসরি কোনো যুদ্ধে জড়াবে না। একবার যুদ্ধে জড়ানো মানে যে বিশাল অঙ্কের খরচ সেটি কার অজানা!

রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের গতিপথ

সম্পর্কটা আগে থেকে খারাপ ছিল দুই দেশের মধ্যে। ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া ও রাশিয়ার সীমানা সুরক্ষার নামে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় যুদ্ধ। প্রতিবেশী ইউক্রেনে হামলা চালায় রুশ সৈন্যরা। সেই যুদ্ধ এখনও চলমান। লাখো ইউক্রেনিয়ান নিজ দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে পাশের দেশগুলোতে। এর জন্য রুশদেরও ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে। ব্যবসা গুটিয়ে ঘরে ফিরে যেতে হয়েছে রুশ অলিগার্কিদের (ধনপতি)। এমনকি বিশ্বকাপ ও অলিম্পিকের মতো ক্রীড়াযজ্ঞেও নিষেধাজ্ঞা পেয়েছে রুশ খেলোয়াড়েরা। শুরুতে আর্থিক সংকটের ধাক্কাটা পুতিন কাটিয়েছেন ভারতে কম দামে তেল বিক্রি করে। তবে এই যুদ্ধে আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হয়েছে নরওয়ে।

আতশ কাচে দেখলে, আদতে এই যুদ্ধে বেশি লাভবান হয়েছে আমেরিকা। কারণ, শত্রু রাষ্ট্র রাশিয়াকে যুদ্ধে ব্যস্ত রাখতে পেরেছে। সামনের দিনগুলোতেও হয়তো সেটিই চাইবে। তাহলে ইউক্রেনের ভবিষ্যত কী? পশ্চিমাদের সাহায্য নিয়ে তারা আরও কয়দিন যুদ্ধ চালিয়ে পারে, এখন সেটিই দেখার।

মধ্য এশিয়া সংকট

দক্ষিণ এশিয়ার পর পৃথিবীর পরাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের এখন শক্তি দেখানোর ময়দান হতে যাচ্ছে মধ্য এশিয়া। উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, তুর্কেমেনিস্তানসহ আরও যত দেশ আছে তাদের দিকে চোখ এখন তাদের। এসব এক সময় সোভিয়েতের অংশ ছিল। এখন রাশিয়া হয়তো সরাসরি অঙ্গীভূত না করলেও সেখানে নিজের বলয়ের প্রভাব আরও বাড়াতে চাইবে। দুই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে এসব দেশের সীমানা রয়েছে। এই দুই দেশ মধ্য এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইবে। আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার ঠান্ডাযুদ্ধ গত শতকে শেষ হয়েছে মনে হলেও সামনের দিনগুলোতে সেটি আরও বাড়বে।

চীনের রাজনীতি

চীনের এখন ধ্যান-জ্ঞান নিজেদের শক্তি ও সমৃদ্ধি আরও বাড়ানো। এক্ষেত্রে তাদের দ্ইু সঙ্গী উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া। তিব্বত, তাইওয়ানের মতো স্বাধীনতাকামী দেশগুলোতে তাদের দমন নিপীড়ন হয়তো আরও বাড়বে। ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রাকে আরও বেশি শক্তিশালী করার দিকেই লক্ষ্য তাদের। এক্ষেত্রে কিপ্টোকারেন্সি অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে সামনের পৃথিবীতে। চীনের কারও সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা কম। তারা হয়তো সহযোগিতার ভূমিকায় থাকতে পারে। ভারতের সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধ, আমেরিকার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা লাগিয়েই রাখবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আরও বড় প্রকল্প নিয়ে নামছে তারা। ছোট ছোট দেশগুলোতে চীনের অর্থনীতিকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যেতে চাইবে তারা। এমনকি কোনো সরকারের পতন হলে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় বসবে চীন।

এছাড়া যুদ্ধ পরিস্থিতির অবস্থা বাদ দিলে নতুন বছরও চলবে আগের নিয়মে। তবে পরিবেশবাদী আন্দোলন জোরদার না হলে বলতে হবে এই পৃথিবী ভয়ঙ্কর এক সময়ে প্রবেশ করছে। ভবিষ্যতের মানুষদের বেশি ভোগাবে পরিবেশ দূষণ। আমাজনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সবুজ জঙ্গল ধ্বংসের মুখে এখন। সমুদ্রও দূষণের কবলে। নতুন বছরে কয়টি প্রাণী বিলুপ্তের খবর আসে এখন সেটিই দেখার। এক্ষেত্রে একটি সবুজ বিপ্লব না হলে ডিফরস্টেশনের কারণে হয়তো বড় পরিবর্তন আসতে পারে পৃথিবীতে। ৮০০ কোটিরও বেশি মানুষের খাদ্যের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে মা পৃথিবী। তার জন্য নিজের জীবন দিতে হচ্ছে বনভূমিকে। ২০২০-২১ সাল ছিল করোনার সঙ্গে যুদ্ধ। সামনের দিনগুলোতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না কি আবারও কোনো নতুন মহামারি আসতে পারে, সেটি জানা যাবে ভবিষ্যতেই।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: প্রচ্ছদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × one =