প্রিয় ছায়ানটে অশ্রু-গানে সন‌্জীদা খাতুনের শেষ বিদায় সন‌্জীদা খাতুন শেষবার ছায়ানটে

দুই বছর আগে হুইল চেয়ারে বসে ছায়ানটে এসেছিলেন সন‌্জীদা খাতুন। তার নব্বইতম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করতে ‘নবতিপূর্ণা’ শিরোনামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল ছায়ানট ভবনে।

আর এবার তিনি এলেন নিথর দেহে। ছায়ানট ভবনে তার সহকর্মী, সহযোদ্ধা আর শিক্ষার্থীদের চোখে জল, কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ-লালনের গান। যে গানকে সঙ্গী করে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে বর্ণাঢ্য এক জীবন কাটিয়েছেন সন‌্জীদা খাতুন। খবর বিডিনিউজ২৪.কম

তিনি ছিলেন ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সর্বশেষ সভাপতি। তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বুধবার সকাল থেকেই ছায়ানট ভবনে ভিড় করেন শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। তাদের দীর্ঘ লাইন ছায়ানট ভবন ছাড়িয়ে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে গিয়ে ঠেকে।

সাবেক সংসদ সদস্য ও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনী আরমা দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন‌্জীদা খাতুন বাঙালী সংস্কৃতির জন্য আজন্ম কাজ করেছেন। তিনি সারা পৃথিবীতেই বাঙালিকে উঁচু স্থানে নিয়ে যেতে কাজ করেছেন। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পথ ধরে তিনি আলো বিলিয়েছেন। সেই আলোতে আমরা আলোকিত হয়েছি।”

বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিংবদন্তিতুল্য, গবেষকদের চোখে বিস্ময় জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব সন‌্জীদা খাতুনকে একক কোনো বৈশিষ্ট্যে বাঁধতে পারেননি কেউই; একাধারে শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক হিসেবে তিনি নিজের দক্ষতার পরিচয় রেখে গেছেন।

ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯১ বছর বয়সে মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় জীবনের এই বিপুল যাত্রা সাঙ্গ করেন সন‌্জীদা খাতুন।

সাংস্কৃতিক সংগঠক রামেন্দু মজুমদার বলেন, ” সন‌্জীদা খাতুন এক বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়েছেন। শুদ্ধসংগীতের প্রসারে তিনি সারা দেশে কাজ করেছেন, অসংখ্য মানুষের মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করেছেন। যারা তার সংস্পর্শে এসেছেন, তারা আলোকিত হয়েছেন।”

শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন সন‌্জীদা খাতুনের প্রতিষ্ঠিত ছায়ানট, নালন্দা, কণ্ঠশীলনসহ দেশের অগ্রগণ্য প্রায় সব সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা।

তিনি চলে গেলেন এমন সময়ে, যখন বাঙালি বৈশাখ বরণে নানা প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই ষাটের দশক থেকে বাংলা বর্ষবরণ নাগরিক পরিমণ্ডল থেকে বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন সন‌্জীদা খাতুন।

তার মরদেহ ঘিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসন্তের গান ‘ঝরা পাতা গো’ গেয়ে শোনাচ্ছিলেন শিল্পীরা। শেষযাত্রার এই আয়োজনে ‘তুমি যে সুরের আগুন’, ‘মারের সাগর পাড়ি দেব’, ‘মানু্ষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে মূল হারাবি’সহ বেশ কিছু গান গেয়ে ছায়ানটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিদায় জানান তাদের গুরুকে। এই গানের শুদ্ধ সুর তারা সন‌্জীদা খাতুনের কাছেই শিখেছেন।

একদিকে শিল্পীদের কণ্ঠে গান, অন্যদিকে সারিবদ্ধভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন। ছায়ানটের উঠানে আসা হাজারো মানুষের চোখে জল। কেউ কেউ কেঁদেছেন অঝোর ধারায়।

শান্তা ইসলাম নামে একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “তিনি আমার শিক্ষক। আমি গান শিখেছি তার কাছে। বাংলা সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে শিখেছি তার কাছে।”

সংগীতশিল্পী খুরশীদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলা সংগীত অঙ্গনের নক্ষত্র তিনি। সারাজীবন তিনি ছায়ানটের জন্য নিবেদিত ছিলেন। স্পষ্টভাষী, আদর্শের সঙ্গে আপস করেননি।”

নাট্যজন ম. হামিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন‌্জীদা খাতুন আমাদেরকে শিখিয়েছেন দেশকে ভালোবাসতে। নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশে, বাংলাদেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে তিনি আমাদেরকে বাঙালি হওয়া শিখিয়েছেন। তার মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষক ও চিত্রশিল্পী আবুল বারক আলভী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন‌্জীদা খাতুনের বোন আমাদের চারুকলা এক ব্যাচ সিনিয়র ছিল। সেই সূত্রে ছাত্র অবস্থা থেকেই তাকে চিনতাম। পরে চারুকলায় অনেক অনুষ্ঠানে আমরা তাকে নিয়েছি। তিনি আমাদের নানা সাংস্কৃতিক কাজে পরামর্শ দিয়েছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।”

ছায়ানটে সন‌্জীদা খাতুনের শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষ হয় ‘আগুনের পরশমণি’ এবং সবশেষে জাতীয় সংগীত গেয়ে।

ছায়ানটের সহসভাপতি মফিদুল হক বলেন, “রমনার বটমূলে এখন যে বর্ষবরণ কোটি বাঙালির আবেগে জায়গা নিয়েছে, তার পেছনের মানুষটি সন‌্জীদা খাতুন। সারা দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন। গান শিখিয়েছেন, শিক্ষকতা করেছেন। গবেষণা করেছেন। মানুষকে ভালোবেসেছেন। তিনি অতুলনীয় কর্মগুণেই সবার মাঝে থাকবেন।”

ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, কণ্ঠশীলন, সুরের ধারা, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠন। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন অনেকে।

শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম, চলচ্চিত্র শিক্ষক মানজারে হাসিন মুরাদ, নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি মিনু হক, সংগীতশিল্পী অদিতি মহসিন, শাহীন সামাদ, বুলবুল ইসলাম, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদ, নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নীপা, আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যেপাধ্যায়, অধ্যাপক শফি আহমেদ, নাট্যনির্দেশক নায়লা আজাদ নূপুর, চন্দনা মজুমদার, গবেষক সাইমন জাকারিয়া, চলচ্চিত্র সংগঠক বেলায়াত হোসেন মামুন, ত্রপা মজুমদার।

ছায়ানটের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে।

বেলা সোয়া ১টার দিকে সন‌্জীদা খাতুনের মরদেহ ছায়ানট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রওনা হয়। সেখানে দীর্ঘদিন অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন সন‌্জীদা খাতুন।

বেলা আড়াইটায় তার কফিন নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তাকে শেষ বিদায় জানাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে সন‌্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। পড়েছেন ঢাকার কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে ১৯৭৮ সালে সেখান থেকেই পিএইচডি করেন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে তিনি অবসর নেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় শুদ্ধ সংগীতের চর্চার পাশাপাশি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন সন‌্জীদা খাতুন।

গান ছিল তার আত্মপরিচয়ের অন্বেষণ। তার তত্ত্বাবধানেই ছায়ানট এখন বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান, যা শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্যের প্রসারে কাজ করছে।

একুশে পদক, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারে (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) ভূষিত সন‌্জীদা ১৬টি বই লিখেছেন।

তার লেখার একটি বড় অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যাপক পরিসরে জনমানসে কবিগুরুকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তার।

‘সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রাম’ বইটি তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রামাণ্য ইতিবৃত্ত এবং মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক তার একান্ত ভাবনাগুচ্ছ ধারণ করেছে।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের শ্রদ্ধা অনুষ্ঠান শেষে সন‌্জীদা খাতুনের মরদেহ ফিরিয়ে নেওয়া হবে হাসপাতালের হিমঘরে। পরের আনুষ্ঠানিকতা কী হবে, সে বিষয়ে এখনো কিছু জানায়নি তার পরিবার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 − five =