আশফাক আহমেদ
মোবাইল, কম্পিউটারসহ নানা প্রযুক্তিতে ঘেরা আমাদের প্রতিদিনের জীবন। কাজকর্ম থেকে শুরু করে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, খাওয়া থেকে শুরু করে কেনাকাটা সব বিষয়েই আমরা ইন্টারনেটের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছি। এর পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ার হাতছানি তো রয়েছেই। ব্যবসা বাণিজ্য কোনো সরকারি, বেসরকারি পরিষেবা সব কিছুতেই ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার অনিবার্য। এতো কিছুর মাঝে ২০২৩ সালকে প্রযুক্তি দুনিয়া সম্ভবত মনে রাখবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলধারায় যুক্ত হওয়ার বছর হিসেবে।
ফেলে আসা বছরটিতে তর্ক সাপেক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। বার্ড, চ্যাটজিপিটি, ডিপফেইকের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের চিন্তাশক্তিতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। প্রতিদিনের কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে এআই। এবং ধীরে ধীরে সোশ্যাল মিডিয়ার মতোই বিশ্বজুড়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে জায়গা করে নিচ্ছে। এর ব্যবহার আমাদের আরও আধুনিক হয়ে উঠতে একদিকে যেমন সাহায্য করেছে, বিপরীতে এর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা সামনে উঠে আসছে। সে যাই হোক, প্রযুক্তির ইতিহাস লিখতে গেলে ২০২৩ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
টুইটারের নাম এক্স
২০২৩ এ বদলে গেল টুইটারের নাম, হয়ে গেল এক্স। ব্যবহারকারী ও সাধারণের কাছে এতোদিনের পরিচিত ও পছন্দের সামাজিকমাধ্যম টুইটারের নাম বদলে ফেলেন এর নতুন মালিক ইলন মাস্ক। শুধু তাই নয় অতি,পরিচিত নীল পাখি সরিয়ে তার জায়গায় এসেছে এক্স লোগো। টাকা খরচ করে সাবস্ক্রাইব করা থেকে শুরু করে নানা ধরনের পরিবর্তন এসেছে টুইটারে! না মনে রাখতে হবে নাম কিন্তু বদলে গেছে, নতুন নাম হলো এক্স।
২০২৩ সালের পুরোটা জুড়েই প্রযুক্তিবিশ্বে অন্য যে কারোর চেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলেন টেসলা-এক্স-স্পেসএক্স-এর প্রধান ইলন মাস্ক। টুইটার নিয়ে যেমন নানা কাণ্ড ঘটিয়েছেন, বিপরীতে গত বছর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ইন্টারনেট পরিষেবার জন্য ব্যাপকভাবে কার্যকর হতে পারে স্টারলিংক। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট হচ্ছে যোগাযোগমূলক স্যাটেলাইট তথা জিওস্টেশনারি উপগ্রহের সাহায্যে সংযুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট প্রযুক্তিতে কোনো তার ছাড়াই সরাসরি স্যাটেলাইট থেকে সেবা দেওয়া হয়।
আলোচিত মেটাভার্স
গত বছর প্রযুক্তি দুনিয়ায় অন্যতম আলোচিত শব্দ হলো মেটাভার্স। অনেকের কাছে এ যেন এক নতুন জগতের সন্ধান পাওয়া। সময়ের সাথে বেড়েই চলছে মেটাভার্স নিয়ে আলোচনা। এর অনেক অংশ বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর দেশগুলোতে হয়ে উঠছে নিত্যদিনের সঙ্গী। মেটাভার্স মূলত ভার্চুয়াল দুনিয়া। এটি এমন এক ত্রিমাত্রিক ভার্চুয়াল দুনিয়া, যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত হতে পারেন। গত বছর এক্সের বিকল্প হিসেবে থ্রেডস অ্যাপ চালু করে ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রামের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা।
ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানির তালিকায় এনভিডিয়া
২০২৩ সালে ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানির তালিকায় নাম লিখিয়েছে গ্রাফিকস চিপ নির্মাতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়া। এআই নিয়ে কাজ করা বহু প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ার বিভিন্ন চিপ ব্যবহার করে। প্রযুক্তিতে নতুনত্বের তালিকায় আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ইউএসবি টাইপ-সি চার্জারসহ বাজারে আসে আইফোন ফিফটিন। দীর্ঘদিনের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নিজেদের তৈরি এআর-ভিআর প্রযুক্তির হেডসেট প্রদর্শন করে অ্যাপল। ‘ভিশন প্রো’ নামের হেডেসেটটি ব্যবহারকারীর চোখ ও আঙুলের নড়াচড়া শনাক্ত করতে পারে। এছাড়া, অ্যাপল ওয়াচ ও ম্যাক কম্পিউটারের জন্য উইজেট চালু করে অ্যাপল।
হ্যান্ডহেল্ড গেইমিং পিসি আসলে ব্যবহারকারীর পছন্দের সবকিছুরই সমন্বিত রূপ, যা ‘গেইমবয় অ্যাডভান্স’ বা ‘পিএসপি’র চেয়ে বেশি ক্ষমতার। এ ছাড়া, পছন্দের যে কোনো গেইম খেলার সুবিধাও মেলে এতে। ২০২৩ সালে এমন বেশ কিছু চমকপ্রদ নকশার ডিভাইস বাজারে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে লেনোভো’র ‘লিজিয়ন গো’ থেকে শুরু করে নতুন করে ঢেলে সাজানো ‘ওএলইডি’ ডিসপ্লেওয়ালা ‘স্টিম ডেক’।
ইলন মাস্কের চিপ স্টার্টআপ নিউরালিংক
মার্কিন নিয়ন্ত্রকদের বাধার মুখে পড়ে ২০২৩ সালে প্রবেশ করেছিল ইলন মাস্কের চিপ স্টার্টআপ নিউরালিংক। ২০২২ সালে এক পিটিশনে কোম্পানিটির মানুষের ওপর চিপ বসানোর পরীক্ষায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল এফডিএ। যেখানে তারা কারণ হিসেবে উল্লেখ করে, এর প্রোটোটাইপ পরীক্ষার সময় অনেক শুকর হত্যা করা হয়েছিল। একই বছরের জুলাই মাসে এক মানব রোগীর ওপর নিজস্ব ডিভাইস বসিয়ে নিউরালিংকের চেয়ে একধাপ এগিয়ে গেছে প্রতিদ্বন্দ্বী সিংক্রোন।
অন্যদিকে, নিউরালিংকের বিরুদ্ধে প্রাণী নিপীড়নের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ইউএসডিএ’। ২০২২ সালের নভেম্বরে মাস্ক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে নিউরালিংকও পরীক্ষা চালাবে। তবে, এখনও তার বাস্তবায়ন ঘটেনি। ২০২৪ সালে প্রবেশের সময় আগের চেয়ে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে নিউরালিংক। এরইমধ্যে কোম্পানির গবেষণাগার পরিদর্শন করেছে ইউএসডিএ।
বিশ্বের প্রথম এআই সেইফটি সামিট
গত নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের ব্লেচলি পার্কে বিশ্বের প্রথম এআই সেইফটি সামিট আয়োজন করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। যার লক্ষ্য, এআই নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যকে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে রাখা। দুই দিনের এ সম্মেলনে তথাকথিত ‘সম্মুখসারীর এআই’ ব্যবস্থার সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করেন সুনাক ও যুক্তরাজ্যের প্রযুক্তিমন্ত্রী মিশেল ডনেলান। এ যুগান্তকারী প্রযুক্তি ভুল কারও হাতে গেলে তা ক্ষতিকারক কাজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে, এমন সতর্কবাণীও উঠে এসেছে এ আয়োজনে।
‘ব্লেচলি ডিক্লারেশন’ নামের এক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে আয়োজনে অংশ নেওয়া দেশগুলো, যার মধ্যে রয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রও। বিভিন্ন কোম্পানি যেন নিরাপদ ও দায়িত্বশীল উপায়ে নিজস্ব এআই ব্যবস্থার বিকাশ ঘটিয়ে এর সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো মোকাবেলা করে, সে আহ্বান রয়েছে এ চুক্তিপত্রে। এ ছাড়া, যুক্তরাজ্যে ‘এআই সেইফটি ইনস্টিটিউট’ গঠন এবং ওপেনএআই ও গুগল ডিপমাইন্ডের মতো শীর্ষ কোম্পানির সঙ্গে ঐচ্ছিক চুক্তি করার ঘোষণাও দিয়েছেন সুনাক। এর মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর নতুন এআই মডেল প্রকাশের আগে প্রতিষ্ঠানটি সেগুলো পরীক্ষা করার সুযোগ পাবে। এ চুক্তি বাধ্যতামূলক না হলেও, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আলোচনায় এআই সুরক্ষা যে গুরুত্বপূর্ণ এক অংশ, তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এর মাধ্যমে।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো ২০২৩ সালে প্রযুক্তিবিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন ছিল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আসলেই মানুষের কাজ কেড়ে নেবে। এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা রয়েছে এবং চলছে। তবে বাস্তবতা হলো, এআই যখন চোখ রাঙাতে শুরু করেছে, সেই সময় বহু কর্মী চাকরি হারাচ্ছেন। গোটা বিশ্বজুড়ে একের পর এক কোম্পানির কর্মীদের চাকরি যাচ্ছে। ২০২৩ সালে গোটা বিশ্বজুড়ে ৪.২৫ লাখের বেশি তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী তাদের চাকরি হারিয়েছেন। সম্প্রতি এমনই একটি রিপোর্ট সামনে আসায় তা নিয়ে চাঞ্চল্য ছড়ায়।
রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গুগল, মেটা থেকে শুরু করে ১১৭৮টি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা থেকে ২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়। যেখানে ২০২২ সালে ১০৬১ কোম্পানি থেকে ১ লাখ ৬৪ হাজারের বেশি কর্মী চাকরি হারান। যার হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতিদিন গোটা বিশ্বের ৫৮২ জন কর্মীকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে গড়ে। রিটেল-টেক, কনজিউমার-টেক এবং ফিনটেক থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মীর চাকরি যায় বলে পরিসংখ্যানে উঠে আসে। সম্প্রতি পেটিএম থেকে ১ হাজার কর্মীর চাকরি যায়।
বিশ্বজুড়ে কর্মী ছাঁটাই
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম শেয়ারচ্যাট থেকেও বহু কর্মীর চাকরি যায়। সম্প্রতি ২০০ জন কর্মীকে ছাঁটাই করে শেয়ার চ্যাট। যা এই কোম্পানির কর্মী সংখ্যার ১৫ শতাংশ বলে জানা যায়। গেম স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম লোকো থেকেও ছাঁটাই করা হয় বহু মানুষকে। কোম্পানির যে লোকবল রয়েছে, তার ৩৬ শতাংশ কর্মীর চাকরি যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। ৪ থেকে ৫ হাজার কর্মীর চাকরি যায় বাইজুস থেকে। বিশ্বজুড়ে যে বহু মানুষের চাকরি যাচ্ছে, সেই পরিসংখ্যান দেখে চমকে উঠতে শুরু করেছেন অনেকেই।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: টেক ট্রেন্ড