ফুটবলে কেন এত বিনিয়োগ সৌদি আরবের

উপল বড়ুয়া

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর যাওয়ার আগে সৌদি আরবের ফুটবল নিয়ে খুব বেশি মানুষ মাতামাতি করতো বলে মনে হয় না। বিভিন্ন কারণে জাতীয় দলের খবর গুটিকয়েক মানুষ রাখলেও কে বা জানতো সৌদি প্রো লিগের ক্লাব আল-নাসর, আল-ইত্তিহাদ ও আল-হিলাল নামের ক্লাবগুলোকে? গত কয়েক মাস ধরে সেসব ক্লাবই এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনায়। সেই আলোচনার ঢেউ ইউরোপ থেকে এশিয়া হয়ে আমেরিকা, লাতিন আমেরিকায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এমনকি ইউরোপের ফুটবলে দীর্ঘদিন খেলেও যে ক্লাবগুলোর পরিচয় অন্তরালে রয়ে গেছে, তাদের চেয়েও এখন বেশি শোনা যাচ্ছে সৌদির ক্লাবগুলোর নাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সামান্য চায়ের দোকানেও আলোচনা চলছে আল-ইত্তিহাদ, আল-হিলালকে নিয়ে।

এই দেশের মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করেন বলে নয়। কিংবা মক্কা-মদিনায় ফি বছর হজ্বে যাওয়ার কারণে নয়। ক্লাবগুলো সাড়া ফেলে দিয়েছে লিওনেল মেসি-করিম বেনজেমার মতো খেলোয়াড়দের রেকর্ড অঙ্কের প্রস্তাব দিয়ে। প্রস্তাব অবশ্য যেকোনো ক্লাবই দিতে পারে তাদের মতো তারকাদের। আমাদের ব্রাদার্স ইউনিয়নও চাইলে আগ্রহ দেখাতে পারে না? অবশ্য কথাটাতে একটু বাড়তি মেদ রয়েছে। কেননা এমন আগ্রহ দেখানোও যে আকাশ-কুসুম চিন্তা সেটা কে না জানে। তবে সৌদি আরব ধনী দেশ। পেট্রোডলারের বিনিময়ে তারা পারে না এমন কোনো কাজ আছে! কথায় আছে না, ‘টাকা দিলে বাঘের দুধও মেলে’। সেই দুধের লোভে তারা একটা বাঘ আগেই কিনে রেখেছে। বছরে ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে গত জানুয়ারিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়ে আল-নাসরের সঙ্গে ২০২৫ সাল পর্যন্ত চুক্তি করেছেন পর্তুগিজ উইঙ্গার। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে চলে আসা রোনালদোর যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিকমাধ্যমে আল-নাসরের ফলোয়ারও বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে ক্লাবটিতে এক মৌসুম কাটিয়ে ফেলেছেন তিনি। তবে লিগ জিততে পারেননি।

এবার রোনালদো তার লিগে পাচ্ছেন সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ সতীর্থ করিম বেনজেমাকেও। লস ব্লাঙ্কোসদের সঙ্গে আরও এক বছরের চুক্তি থাকলেও সেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে বছর প্রতি ৪০ কোটি ইউরোতে ফরাসি ফরোয়ার্ড নাম লিখিয়েছেন সৌদির আরেক ক্লাব আল-ইত্তিহাদে। এখন গুঞ্জন, চেলসি ছেড়ে একই ক্লাবে যোগ দিচ্ছেন আরেক ফরাসি তারকা এনগোলা কান্তেও। সৌদি প্রো লিগ থেকে সবচেয়ে বড় প্রস্তাবটা পেয়েছিলেন মেসি। কিন্তু আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। সৌদি প্রো লিগে রোনালদো-মেসিকে দেখার যে বাসনা ছিল ভক্ত-সমর্থকদের মাঝে, সেটি আর পূরণ হচ্ছে না। তিন বছরের জন্য মেসি যোগ দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর সকার লিগের ক্লাব ইন্টার মিয়ামিতে। ক্লাবটির মালিক সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তারকা ডেভিড বেকহাম। গত মে মাসে প্যারিস সফরে যান তিনি। সাবেক ক্লাব পিএসজিতে গিয়ে দেখা করেন মেসিদের সঙ্গে। তখনই আর্জেন্টাইন তারকার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার গুঞ্জনের হাওয়া বইতে থাকে জোরে। এর আগে পর্যটন দূত হিসেবে সপরিবারে সৌদি সফরে যান তিনি। এরপর থেকে তার সৌদিতে যাওয়া নিয়েও জোর গুঞ্জন শুরু হয়। জুনের শুরুতে পিএসজির হয়ে শেষ ম্যাচ খেলেছেন মেসি। প্যারিসিয়ানদের সঙ্গে দুই বছরের সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর বেশিদিন বেকার থাকতে হলো না তাকে। সাবেক ক্লাব বার্সেলোনায় ফেরার আলোচনা চললেও মেসি সেখানে ফেরেননি। গ্রহণ করেননি আল-হিলালের বিশ^ রেকর্ড গড়া প্রস্তাব। বেছে নিয়েছেন ইন্টার মিয়ামিকে। এবারই প্রথম ইউরোপের বাইরের ফুটবলে দেখা যাবে ৩৫ বছর বয়সী তারকাকে। অথচ চাইলে নির্বিঘ্নে আরও কয়েক বছর মাতাতে পারতেন ইউরোপের ফুটবল। সেই প্রস্তাবও পেয়েছিলেন তিনি।

কথা হলো, সৌদি আরব কেন কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ খরচ করে মরুর বুকে ফুটবলের বাগান সাজাচ্ছে? একের পর এক ইউরোপ মাতানো ফুটবলারদের কিনে নিচ্ছে? সৌদির রাডারে আছে লুকা মদরিচ, জর্দি আলবা, সার্জিও বুসকেতস, সার্জিও রামোস, আলেক্সিস সানচেজ, রবার্তো ফিরমিনোর মতো তারকারা। যারা এখন ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে নতুন ক্লাবের সন্ধানে আছেন। তাদের অনেকে লুফে নিতে পারেন সৌদির প্রস্তাব। কেবল খেলোয়াড় কেনার দিকে নয়, সৌদি ক্রীড়াক্ষেত্রে, বিশেষ করে ফুটবলে বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগের জন্য নেমেছে। এখন আমরা এর পেছনের কিছু নির্ণয়ের চেষ্টা করব।

কয়েক বছর ধরে ফুটবল-ক্রিকেটের মতো জনপ্রিয় ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে আসছে উপসাগরীয় দেশগুলো। নিজেদের ঘরোয়া লিগগুলোয় তারকা ফুটবলারদের নিয়ে আসার পাশাপাশি সৌদি আরব ও কাতারের ধনকুবেররা যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে ইউরোপীয় ক্লাব কেনায়। ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রায় ৩ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকায় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেড কিনে নেয় সৌদি মালিকানাধীন কনসোর্টিয়াম সৌদি পাবলিক ইনভেস্ট ফান্ড (পিআইএফ)। এই সংস্থার প্রধান হিসেবে আছেন সৌদি যুবরাজ প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। রাতারাতি নিউক্যাসল হয়ে ওঠে ইউরোপের সবচেয়ে ধনী ক্লাব।

মাস দুয়েক আগে ৬৭ হাজার কোটি টাকায় আরেক ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কেনার জন্য দরপত্র হাঁকান কাতারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও ব্যাংকার শেখ জসিম বিন হামাদ আল থানি। রেড ডেভিলদের মালিকানা পেতে চায় স্যার জিম র‌্যাটক্লিফের ইনিওস গ্রুপও। দুজনই দরপত্র জমা দিয়েছেন। গ্লেজার্স পরিবার ইউনাইটেডের মালিকানা ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে আগ্রহ জানিয়ে আসছেন এই দুই ধনকুবের।

ইউরোপের বেশ কয়েকটি ক্লাবের মালিক মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবেররা। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ধনকুবের শেখ মনসুর কিনেছেন ম্যানচেস্টার সিটি ও পিএসজি কিনেছেন কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানি। অ্যাস্টন ভিলার মালিকানা মিসরের নাসেফ সাউয়িরিসের হাতে। ইউরোপীয় ফুটবলে শত শত মিলিয়ন ডলারের চুক্তি রয়েছে এমিরেটস, ইতিহাদ এয়ারওয়েজ ও কাতার এয়ারওয়েজের মতো জনপ্রিয় অ্যাভিয়েশন কোম্পানির।

ফুটবল ক্লাব কেনার জন্য কেন এত বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করছে মরুর দেশগুলো? এ নিয়ে গত এপ্রিলের শুরুতে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েবসাইট ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’। কারণ হিসেবে তারা অর্থনৈতিক সুবিধা, সামাজিক সুবিধা, ইউরোপিয়ান ফুটবলে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পৃক্ততার ভবিষ্যৎকে উল্লেখ করেছে।
অর্থনৈতিক সুবিধা

উপসাগরীয় দেশগুলো বিদেশে বিনিয়োগের পথ খুঁজছে বহুদিন আগে থেকে। এ ক্ষেত্রে ফুটবলে বিনিয়োগকেই নিরাপদ ভাবছে তারা। তেল-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে এই পদক্ষেপ। আর ইউরোপীয় ক্লাবগুলো চায় ভালো বিনিয়োগ। আট বছরে তাদের রাজস্বও বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৫ শতাংশ। ১৩ বছরে ইউরোপীয় ফুটবলে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবেররা আর বিশ^ব্যাপী ফুটবলের বাজারও বাড়ছে দ্রুতগতিতে।

সামাজিক সুবিধা
অর্থনৈতিক সুবিধার পাশাপাশি সামাজিক সুনামের কথাও চিন্তা করছে মধ্যপ্রাচ্যের ধনীরা। সামাজিক পরিবর্তনে ক্রীড়াক্ষেত্রে বিনিয়োগকে চালিকাশক্তি ভাবছেন তারা। অনেকে মনে করেন, লিভারপুলের যোগ দেওয়া মিসরীয় ফরোয়ার্ড মোহামেদ সালাহর জনপ্রিয়তা ইউরোপে ‘ইসলামফোবিয়া’ অনেকাংশে কমিয়েছে। ক্লাব কেনাকেও মধ্যপ্রাচ্যের ধনীদের পশ্চিমে নিজেদের অবস্থান শক্ত করা এবং নমনীয় ক্ষমতা প্রয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

ফুটবলে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পৃক্ততার ভবিষ্যৎ
পিআইএফ গ্রুপ নিউক্যাসলের মালিক হয়েছে দুই বছরও হয়নি। এমনকি চেলসি কিনতে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে দরপত্রও জমা দিয়েছিল তারা। সৌদিও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও হারানো ভাবমূর্তি উদ্ধারে উঠেপড়ে লেগেছে। ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার পর মানবাধিকার কর্মীদের তোপের মুখে পড়ে দেশটি। তাদের সঙ্গে আরব আমিরাত ও কাতারের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ফুটবলে বিনিয়োগ করে নিজেদের সুনাম উদ্ধারের চেষ্টা করছে তারা।

ফুটবল বিশ্বকাপ ও অলিম্পিক আয়োজনের ইচ্ছে
২০২২ বিশ্বকাপ হয়েছে কাতারে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রথমবারের মতো আয়োজিত বিশ্বকাপে শিরোপা জেতে আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপ আয়োজনকে ঘিরে নতুন স্টেডিয়াম তৈরি ও হোটেলসহ পর্যটক টানতে বেশকিছু উদ্যোগ হাতে নেয় কাতার। লাভবানও হয়েছে দেশটি। কাতারের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা রয়েছে সৌদি আরবের। মধ্যপ্রাচ্যের মোড়ল হিসেবে কাতারের এই উন্নতি তারা খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি। এখন নিজেদের দেশেও বিশ্বকাপ আয়োজন সত্ত্ব চায় তারা। ২০৩০ বিশ্বকাপ আয়োজনের আগ্রহ রয়েছে তাদের। তবে শততম বিশ্বকাপ হতে পারে লাতিন আমেরিকায়। প্রথমবারের মতো ১৯৩০ বিশ্বকাপ হয়েছিল উরুগুয়েতে। ফিফারও ইচ্ছে আছে লাতিনে শততম বিশ্বকাপ আয়োজন করার। তবে ২০৩০ বিশ্বকাপের আয়োজক সত্ত্ব না পেলেও বিশ্বকাপের অন্যকোনো আসরের দিকে তাকিয়ে সৌদি। এছাড়া অলিম্পিকের মতো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টও আয়োজনে আগ্রহী দেশটি। তার জন্য নিজ দেশের রোনালদো-বেনজেমাদের মতো তারকাদেও নিজেদের ঘরোয়া ফুটবলে এনে শক্তি ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে চায় তারা।

সৌদি প্রো লিগকে এশিয়ার সেরা বানানো
ইউরোপে দীর্ঘদিন খেলার পর অনেক নামী ফুটবলার ক্যারিয়ারের শেষ সময়টা কাটান ছোট কোনো দল বা লিগে। বেকহাম-ইব্রাহিমোভিচ, ওয়েইন রুনি, ডেভিড ভিয়া, কাকার মতো ফুটবলাররা এক সময় ক্যারিয়ারে শেষদিকে এসে কাটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সকার লিগে। মেসি এখন যেখানে যাচ্ছেন। এক সময় চীন বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করে ব্রাজিলের অস্কার, হাল্ক, পাওলিনহোদের মতো তারকাদের এনেছিল নিজেদের লিগে। এখন সেই পথে হাঁটছে সৌদি। তারকাদের শেষ সময়ের ঠিকানা হতে চাইছে তারা। তাতে বিশাল অর্থের প্রাপ্তিও যে আছে, সেটা আর নতুন কী! কয়েক দিন আগে রোনালদো তো বলেই দিয়েছেন, সৌদি প্রো লিগকে বিশে^র সেরা পাঁচ লিগের একটি বানানোর লক্ষ্য কর্তৃপক্ষের। এ যেন ইউরোপিয়ানদের কিনে ইউরোপকেই হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া। রোনালদো-বেনজেমা তো আছেন, আরও কয়েকজন বড় তারকা গেলে নিশ্চিতভাবে জমে উঠবে সৌদি ফুটবল। বাড়বে পর্যটন শিল্প। তেলসমৃদ্ধ দেশটি এখন পর্যটন, কৃষি ও সামরিক শক্তি বাড়ানোর দিকেই সর্বাত্মক মনোযোগ দিয়েছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × five =