বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ৪৫

দেখতে দেখতে বাংলাদেশে ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছর পার করলো। প্রতিষ্ঠানটি ৪৫ বছর ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সেলুলয়েড ফিতায় ধারণ করা শত বছরের পুরোনো গল্পও সংগ্রহে আছে তাদের। ষাটের দশক থেকে আজ পর্যন্ত চলচ্চিত্র এবং ফিল্মের ধারণ করা সবকিছুই দেশের অমূল্য সম্পদ। যা বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ রক্ষা করে চলেছে। ১৭ মে ২০২৩ বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। রঙ বেরঙের পাতায় থাকছে সেই আয়োজন নিয়ে কিছু কথা।

আর্কাইভ কী?
মূলত আর্কাইভস হচ্ছে একটি সংরক্ষণাগার। এখানে গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড এবং অন্যান্য মূল্যবান ঐতিহাসিক নথিপত্র সুসংবদ্ধভাবে সুরক্ষিত রাখা হয়। আর্কাইভ হতে পারে সরকারি, বেসরকারি অথবা ব্যক্তিগত ।

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের সূচনা
দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ। দেশ বিদেশের চলচ্চিত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য ১৯৭৮ সালে ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলচ্চিত্র সংগ্রহ, সংরক্ষণ, চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট দ্রব্যাদি সংগ্রহের পাশাপাশি ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স পরিচালনা করে। নিয়মিত প্রদর্শনীর পাশাপাশি বিভিন্ন দিবসেও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করে থাকে।

‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ’ এর ইতিহাস
১৯৭৫ সালে চলচ্চিত্র সংসদের সহযোগিতায় ফিল্ম আর্কাইভের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয় এবং তৎকালীন তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ে তা পেশ করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১৭ মে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভ’ নামে এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় এবং ১৯৮৪ সালে ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ’ নামকরণ করা হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পর্যায়ক্রমে রাজধানীর ধানমন্ডি, আসাদগেট, গণভবন ও সর্বশেষ শাহবাগে এর কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। পরে আগারগাঁওয়ে প্রায় ৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় বর্তমান ভবন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর ভবনটি উদ্বোধন করেন।

ফিল্ম আর্কাইভে যা আছে
ফিল্ম আর্কাইভের সংরক্ষণাগারে বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র ‘দি লুমিয়র ব্রার্দাস’ (১৮৯৫) সংরক্ষিত আছে। আছে ঢাকার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬), কাজী নজরুল ইসলাম অভিনীত ‘ধ্রুব’ (১৯৩৪), প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘দেবদাস’ (১৯৩৫), ফতেহ লোহানির ‘আসিয়া’ (১৯৬০), রাশিয়ার ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’ (১৯২৫), ‘মাদার’ (১৯২৬), ‘অপুর সংসার’ (১৯৫৯), ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০) ও ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ (১৯৬৭)-সহ অনেক ক্লাসিক ছবি। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্মের ভিজ্যুয়াল দলিলের সংগ্রাহক এ প্রতিষ্ঠান। ফিল্ম আর্কাইভে থাকা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ও আলোচিত ছবিগুলো হলো: দুই দুয়ারী, শ্রাবণ মেঘের দিন, কিত্তনখোলা, চন্দ্রকথা, গেরিলা, দূরত্ব, মেহের নিগার, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, আহা, কাবুলিওয়ালা, ঘানি, নিরন্তর, আমার বন্ধু রাশেদ, শংখনাদ, আগুনের পরশমণি, অবুঝ বউ, গঙ্গাযাত্রা, ঘেটুপুত্র কমলা, মনের মানুষ, গহীনে শব্দ, দিপু নাম্বার টু, মৃত্তিকা মায়া, জালালের গল্প, অজ্ঞাতনামা, প্রিয়া তুমি সুখি হও, কৃষ্ণপক্ষ, চকোরী, স্মৃতিটুকু থাক, ঝড়ের পাখি, সাধারণ মেয়ে ইত্যাদি।

ফিল্ম আর্কাইভ ডিজিটালে রূপান্তর
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে স্থান পাওয়া সব চলচ্চিত্র আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তর ও রেস্টোরেশন করে সংরক্ষণ করা হয়। ফিল্ম ডিজিটাইজেশন ও রেস্টোরেশনের জন্য কারিগরি শাখায় রিয়েল টাইম ফিল্ম স্ক্যানার, ফিল্ম রেস্টোরেশন ইউনিট, কালার গ্রেডিং ইউনিট ও ভিডিও এডিটিং প্যানেল রয়েছে। সনাতন পদ্ধতিতে সংরক্ষিত চলচ্চিত্রকে ডিজিটাল ফরমেটে সংরক্ষণ করার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি বিশেষ করে ফিল্ম স্ক্যানার, কালার কারেকশন ইউনিট, সাউন্ড ফলোয়ার, ফিল্ম চেকিং ও ক্লিনিং মেশিন, ডিজিটাল এডিটিং মেশিন ও ডিজিটাল প্রজেক্টর বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করে ৩৫ মিমি, ১৬ মিমি ফরমেটের চলচ্চিত্রকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ’ ভবনে রয়েছে ৫০০ আসনের অত্যাধুনিক মাল্টিপারপাস অডিটোরিয়াম, ৩০০ আসনের প্রজেকশন হল ও ১২০ আসনের সেমিনার হল।

চলচ্চিত্র গবেষণায় ফিল্ম আর্কাইভ
২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্র বিষয়ে গবেষণা ও প্রকাশনা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। এ পর্যন্ত ৭০টি গবেষণাকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। ২০০৯ সাল নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্র বিষয়ক জার্নাল ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল’ প্রকাশ করে আসছে। ইতিমধ্যে জার্নালের ১৭টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ এ পর্যন্ত চলচ্চিত্র বিষয়ক ৭৫টি বই প্রকাশ করেছে। এখানে দেশের প্রথম ফিল্ম মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়েছে, যা সর্বসাধারণের জন্য উম্মুক্ত।

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ১৯৮০ সালে আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অব ফিল্ম আর্কাইভস (এফআইএএফ)-এর সদস্য পদ লাভ করে ও ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক অ্যাসোসিয়েশন অব অডিও ভিজ্যুয়াল আর্কাইভ (আইএএসএ)-এর সদস্য পদ লাভ করে।

ফিল্ম আর্কাইভে ছবি না জমা দিলে জেল
চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট দ্রব্যাদি সংরক্ষণের জন্য একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান ফিল্ম আর্কাইভ থাকার পরও দেশের চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সচেতনতার অভাবে অনেক চলচ্চিত্রের কপি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফিল্ম আর্কাইভের পক্ষ থেকে দেশে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর একটি কপি জমা দেওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া হলেও অনেকেই ফিল্ম আর্কাইভে ছবি জমা দিচ্ছে না। ২০০৫ সালে এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে কপিরাইট আইন পাস করা হয় এবং ২০১২ সালে এই আইনের সংশোধন করা হয়। যে কোনো নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান তার নির্মিত চলচ্চিত্রের একটি কপি বাধ্যতামূলকভাবে ফিল্ম আর্কাইভে জমা দিতে হবে। এ আইন অমান্য করলে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা ও দুই বছরের জেল হওয়ার বিধান রয়েছে।

৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তারকামেলা
৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনে বসেছিল ঢাকাই চলচ্চিত্রের তারকাদের হাট। মিলনমেলায় মুখর হয়েছিল চারদিক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদ, জায়েদ খান, নাদের চৌধুরী, আলী রাজ, আলেকজান্ডার বো, ঝুনা চৌধুরী, অভিনেত্রী সুচন্দা, দিলারা জামান, অঞ্জনা, অরুণা বিশ্বাস, জ্যোতিকা জ্যোতি, সুচরিতা, দিলারা।

যা বললেন ফিল্ম আর্কাইভের পরিচালক
৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনে ফিল্ম আর্কাইভের পরিচালক ফারহানা রহমান বলেন, ‘১৯৭৫ সালের বিয়োগান্তক ঘটনার কারণে এ উদ্যোগ থমকে গেলেও পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের ১৭ মে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের গুরুত্ব অনুধাবন করে ডিজিটাল আর্কাইভ ব্যবস্থাপনা, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও আধুনিক ভবন নির্মাণ করে বিশ্বমানের ফিল্ম আর্কাইভের কার্যক্রম গতিশীল করে।’

ফিল্ম আর্কাইভে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট দ্রব্যাদি সংগ্রহ করা হয়। দেখার মতো অনেক কিছুই আছে সেখানে। সময় করে একদিন ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে। বিনোদনের পাশাপাশি দেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের অনেক কিছু জানা হয়ে যাবে ঘুরতে ঘুরতে। জয় হোক বাংলা চলচ্চিত্রের।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twelve − 4 =