বাংলাদেশি ৬ এভারেস্টজয়ী

রঙবেরঙ ডেস্ক

এভারেস্ট যারা জয় করে ফেলেন তাদের কাছে এটা পৃথিবীর সবচেয়ে অসাধারণ বিষয়ের একটি। বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করার মাধ্যমে নিজের দেশের পতাকা উড়িয়ে ইতিহাস গড়েন তারা। এই যাত্রা শুধু যাত্রা নয় এক মহাযাত্রা। এক প্রতিবেদনে জানা যায় ২০২৩ সালে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১৮ জনের। এর মধ্যে পাঁচজনের লাশই পাওয়া যায়নি আজ অব্দি। এমন দুঃসাহসিক আর প্রাণঘাতী জেনেও শত শত মানুষ নেপালের এভারেস্ট জয় করার জন্য প্রতিদিনই যাত্রা করছে।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ৬ জন মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন। ২০১০ সালের ২৩ মে বাংলাদেশি হিসেবে সর্বপ্রথম মুসা ইব্রাহিমের এভারেস্ট জয় করেন। সর্বশেষ ৬ষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন। ২০১৩ সালের পর বাবর আলীই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ জয় করতে সক্ষম হলেন।

প্রথম এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহিম

পর্বতারোহী মুসা ইব্রাহিম প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন ২০১০ সালের ২৩ মে বাংলাদেশ সময় সকাল ৫টা ১৬ মিনিটে। পর্বত বিজয়ী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে আসে মুসা ইব্রাহিমের হাত ধরেই। মুসা ইব্রাহিমের স্কুলজীবন কেটেছে ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস হাই স্কুলে। নটরডেম কলেজে পড়েছেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মজীবনে তিনি বেছে নেন সাংবাদিকতা। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টুয়েন্টিফোরে জ্যেষ্ঠ সংবাদদাতা হিসেবে এবং দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কাজ করেছেন যায়যায়দিন পত্রিকায়। এভারেস্ট জয়ের পর ২০১১ সালে তিনি পর্বত আরোহণ ও অ্যাডভেঞ্চার বিষয়ক নানা আয়োজনে তরুণ তরুণীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রতিষ্ঠা করেন এভারেস্ট একাডেমি। বর্তমানে নিজ গ্রামে ‘এভারেস্ট ডেইরি অ্যান্ড এগ্রো ফার্ম’ নামে খামার করেছেন। যেখানে নির্ভেজাল মাছ, সবজি, মাংস পাওয়া যায়।

দু’বার এভারেস্টজয়ী এম এ মুহিত

দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে ২০১১ সালের ২১ মে এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেন এম এ মুহিত। একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে ২০১২ সালে তিনি দ্বিতীয়বার এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখেন। ২০০৪ সালে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ও কালাপাথার ট্র্যাকিংয়ে অংশ নেন এম এ মুহিত। এরপর ভারতের দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে মৌলিক পর্বতারোহণ এবং একই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৫ সালে উচ্চতর পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ নেন। এছাড়া প্রস্তুতি হিসেবে বিভিন্ন সময় হিমালয়ের চুলু ওয়েস্ট, মেরা, বিশ্বের অষ্টম উচ্চতম শৃঙ্গ মানাসলুর, সিংগু ও লবুজে শৃঙ্গে আরোহণ করেন তিনি। এভারেস্ট জয়ের আগে মুহিত ২০০৯ সালে এভারেস্ট থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বিশ্বের ষষ্ঠ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ চো ওয়ো (৮,২০১ মিটার) জয় করেন। এছাড়া তিনি দুবার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ তাজিনডংয়ে আরোহণ করেছেন। ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার গঙ্গাপুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

দেশের প্রথম নারী এভারেস্টজয়ী নিশাত

বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টে আরোহণ করেছেন নিশাত মজুমদার। ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি লক্ষ্মীপুরে জন্মগ্রহণ করেন নিশাত। তিনি ১৯৯৭ সালে ঢাকার ফার্মগেটের বটমূলী হোম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৯৯ সালে শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা সিটি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা ওয়াসায় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। শৈশবে নিশাত মজুমদার হতে চেয়েছিলেন বৈমানিক কিন্তু হয়েছেন পর্বতারোহী। নিশাত মজুমদার ২০০৩ সালে এভারেস্ট বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া (৩ হাজার ১৭২ ফুট) কেওক্রাডং জয় করেন। ২০০৬ সালের মার্চে বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে বিএমটিসি আয়োজিত বাংলাদেশের নারী অভিযাত্রীদলের সঙ্গে ফের কেওক্রাডং চূড়ায় ওঠেন। একই বছরের সেপ্টেম্বরে বিএমটিসি আয়োজিত নারী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে তিনি এভারেস্ট বেস ক্যাম্প (১৭ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতা) ট্র্যাকিংয়ে অংশ নেন। এরপর ২০০৭ সালের মে মাসে বিএমটিসির অর্থায়নে দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে মৌলিক পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে হিমালয়ের মেরা পর্বতশৃঙ্গ (২১ হাজার ৮৩০ ফুট) জয় করেন। নিশাত মজুমদার ২০২২ সালে হিমালয়ের আরেকটি পর্বতশৃঙ্গ মানাসলু জয় করেন। ৮ হাজার ১৬৩ মিটার মানাসলু পৃথিবীর অষ্টম উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। নিশাত প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে ও ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে শিশুদের নিয়ে যান প্রকৃতির কাছে। ২০২৩ সাল থেকে ‘শিশুর সখ্য: পাহাড়ে সাথে, প্রকৃতির সাথে’ এই আয়োজনে শিশুদের প্রকৃতির কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন তিনি ও তার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘অভিযাত্রী’।

এভারেস্টজয়ী দ্বিতীয় নারী ওয়াসফিয়া

ওয়াসফিয়া নাজরীন ১৯৮২ সালের ২৭ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি পরিবারের সঙ্গে চলে যান চট্টগ্রামে। তিনি ঢাকার স্কলাসটিকা স্কুল থেকে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করার পর যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় এগনেস স্কট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। তার বিষয় ছিল সামাজিক মনোবিজ্ঞান ও স্টুডিও আর্ট। এরপর স্কটল্যান্ডে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। ওয়াসফিয়া নাজরীন দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালের ২৬ মে শনিবার সকাল পৌনে ৭টায় বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন। আবারও এভারেস্টের চূড়ায় ওড়ে লাল-সবুজ পতাকা। নিশাত মজুমদার, এম এ মুহিত পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়াটিতে পৌঁছানোর সাত দিন পর ২৬ মে ২০১২ এভারেস্ট জয় করেছিলেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম পর্বতারোহী হিসেবে সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গও জয় (সেভেন সামিট) করেছেন। ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর সকাল ১০টা ১৯ মিনিটে ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া অঞ্চল দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার (ওশেনিয়া) সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কারস্তনেজ পিরামিড জয়ের মধ্য দিয়ে সাতটি পর্বত জয়ের কাজটি সম্পন্ন করেন তিনি। বাংলাদেশ অন সেভেন সামিট কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২০১১ সালে ওয়াসফিয়া তার সেভেন সামিট অভিযান শুরু করেন। ৪১ বছর বয়সী এই পর্বতারোহী ২০২২ সালের ২২ জুলাই প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কে২-এর চূড়ায় আরোহণ করেন। ২০১৪ সালে দুঃসাহসী অভিযানের জন্য ওয়াসফিয়া নাজরীনকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির বর্ষসেরা অভিযাত্রীর খেতাব দেওয়া হয়।

পঞ্চম এভারেস্টজয়ী সজল সেখানেই মারা যান

পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন সজল খালেদ। ২০১৩ সালের ২০ মে পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখেন মোহম্মদ খালিদ হোসেন (সজল খালেদ)। ২০ মে সকাল সাড়ে ৮টায় সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি জয় করেন তিনি। কিন্তু নামার সময় আনুমানিক ২৮ হাজার ২১৫ ফুট উচ্চতায় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানেই মারা যান ৩৫ বছর বয়সী এই পর্বতারোহী। এভারেস্ট জয়ের আগে ২০০৬ সালে সিকিমের ফ্রে পর্বত, ২০০৯ সালে নেপালের মাকালু, ২০১০ সালে হিমালয়ের বাংলাদেশ-নেপাল ফ্রেন্ডশিপ পিক ও ২০১১ সালে অন্নপূর্ণা রেঞ্জের সিংগুচুলি পর্বত জয় করেন। পর্বতারোহীর পাশাপাশি তার ছিল আলাদা একটা পরিচয়। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা। মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে তিনি নির্মাণ করেছিলেন সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘কাজলের দিনরাত্রি’ যা ৬ষ্ঠ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনী হয়েছিল। সজল খালেদের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগরে। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট ছিলেন তিনি।

ষষ্ঠ এভারেস্টজয়ী বাবর

১১ বছর পর কোনো বাংলাদেশি হিসেবে বাবর মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছেন। ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন পর্বতারোহী বাবর আলী। পেশায় বাবর আলী চিকিৎসক আর নেশা পর্বতাহরণ। বাবর আলী ১৯ মে ভোরে ডেথ জোন নামে পরিচিত শৃঙ্গে আরোহণ করেন এবং মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন। বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন তিনি। বাবর আলী প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ডাবল ৮০০০ মিটার পর্বত চূড়া জয় করেছেন। ২১ মে বাবর আলী বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ শৃঙ্গ লোৎসে চূড়া জয় করেছেন। এটিই কোনো বাংলাদেশির প্রথম লোৎসে সামিট এবং প্রথম একই অভিযানে দুইটি আটহাজারি শৃঙ্গ সামিট। ২০১৪ সাল থেকে বাবর আলীর পর্বতারোহণে পথচলা শুরু হয়। এখন অব্দি হিমালয় রেঞ্জের ১১টি উচ্চ শৃঙ্গ জয় করেছেন তিনি। ২০১৭ সালে ভারতের উত্তরকাশীর নেহেরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে মৌলিক পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। ২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম দুর্গম ও টেকনিক্যাল চূড়া আমা দাবলাম (২২,৩৪৯ ফুট) আরোহণ করেন বাবর। ৩৩ বছর বয়সী বাবর আলীর বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বুড়ির চর গ্রামে। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন বাবর আলী। শুরু করেছিলেন চিকিৎসা পেশা। এরপর চাকরি ছেড়ে দেশ-বিদেশে ঘোরায় মনোযোগ দেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × two =