সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রতি বছর জুন মাসে জাতীয় বাজেট সংসদে যে উপস্থাপিত তার ভাষা মানুষের কাছে অনেকটাই অবোধগম্য। বিভিন্ন শব্দজাল তৈরি করে দেশের সমস্যা ও সঙ্কট এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন মানুষ মনে করে যে বাজেট এমন এক বিরাট অর্থযজ্ঞ যা তাদের না বুঝলেও চলবে।
বাজেট ভাষার জিমন্যাস্টিক। তাই যা বলা হয় তার বাস্তবায়ন ঘটে না। কোনো বছরেই শতভাগ বাজেট বাস্তবায়নের রেকর্ড নেই। গত দশ বছর ধরে তো বাস্তবায়নের ধারে কাছেও যাচ্ছে না। এরপরও প্রতি বছর বড় আকারে বাজেট পেশ হয়, বিশাল রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয় এবং বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়ে অর্থবছরের শেষদিকে আয়-ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঢালাওভাবে কাটছাঁট করে সংসদে সংশোধিত বাজেট পাস করিয়ে নেওয়া হয়। এনবিআর তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে না প্রতি বছর, কিন্তু এ জন্য তাকে কোনো জবাবদিহিতাও করতে হয় না। এ বছরও চলতি বাজেট থেকে ব্যয় কমানো হচ্ছে সাড়ে ৪৭ হাজার কোটি এবং আয় ২২ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা একটা ঝুঁকির মধ্যে আছে অনেকদিন ধরে। রাজস্ব আয় কম, ব্যয় বেশি। তাই ধার করেই চলতে হচ্ছে সরকারকে। অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। সরকারের এ ঋণ গ্রহণ মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকনির্ভর। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাড়ে সাত মাসে (১ জুলাই থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শেষ দেড় মাসে ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়টিতে অর্থমন্ত্রী সম্পূর্ণ নীরব থাকছেন বরাবর। শুধু সুদ মেটাতে সরকার কোষাগার থেকে প্রতি একশো টাকার জাতীয় উৎপাদন থেকে কত ব্যয় করে তার একটা গবেষণা প্রয়োজন।
যদিও বাজেটের আকার বড় হচ্ছে, কিন্তু মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে বাজেট বরাদ্দ বাড়ছে না, বরং কমছে। আর্থিক উন্নয়ন থেকে দেশ চালনা, জনকল্যাণ থেকে প্রশাসনিক ও প্রতিরক্ষা ব্যয় সবই একটা অস্বচ্ছতায় ঢাকা।
আগেই বলেছি বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় সেটি অর্জিত হয় না। শেষদিকে এর পরিধি ছোট করে সংশোধন করা হয়। বছর শেষে প্রকৃত বাজেট বাস্তবায়ন আরও কম হয়। এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বাস্তবভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। সংখ্যার ভোজবাজিতে বড় বাজেট লোকসম্মুখে এনে বলা হয় দেশের উন্নতি হবে, প্রবৃদ্ধি হবে; প্রকৃতপক্ষে এগুলো বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয় না। আসলে বাজেট বাস্তবায়ন হবে না জেনেই সেটি তৈরি করা হয় এবং উপস্থাপিত হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। অর্থনীতির গবেষকরা তো এ কথা বলেই যাচ্ছেন যে, বাস্তবভিত্তিক বাজেট করতে হবে। কিন্তু রাজনীতি কবেই বা গবেষণার ধার ধরেছে? আমরা এক সময় জিডিপির চড়া বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে গিয়ে প্রায় সব খাতে আর্থিক শৃঙ্খলার ক্ষতি করেছি।
বাজেটের চরিত্র, আকার, বিন্যাস, প্রকৃতি ইত্যাদি নিয়ে অনেক প্রশ্ন জাগছে জানমনে। প্রত্যাশা, বাস্তবতা, আশা-নিরাশা নিয়ে অনেক কথাই হয়। বাস্তবতা হলো বাজেট আমাদের সমস্যার সমাধান করে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণেও আনে না, বৈষম্য কমায় না এবং বেকারত্ব দূর করে না। উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি নিয়ে যত সাফল্যের কথাই বলা হোক তা ম্লান করে দেয়, নিত্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি। গত প্রায় তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে লাগামহীন দ্রব্যমূল্য মানুষের জীবনকে অস্থির করে রেখেছে। সাধারণ মানুষ উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি বোঝে না। খেতে না পেলে, সন্তানকে লেখাপড়া করাতে না পারলে, চিকিৎসার খরচ লাগামের বাইরে চলে গেলে কি মানুষ জিডিপি বুঝতে চাইবে?
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে পণ্যের উৎপাদন, মজুত, সরবরাহ শৃঙ্খল, বাজার নিয়ন্ত্রণ, সংঘবদ্ধ চক্রের কারসাজি, পরিবহনের চাঁদাবাজি প্রভৃতি অনেক কিছু বিবেচনায় নিতে হবে। সরকারের দিক থেকে এ কথাগুলো বলাও হয়, কিন্তু আমরা কোনো সুফল দেখি না। একটা সরকার টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায়, অথচ মানুষ মরছে দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে। বাজার ব্যবস্থাপনাই গড়ে তুলতে পারেনি সরকার। ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে বাজারে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অভিযোগ আছে কারসাজির এবং সেটা করছে প্রভাবশালীরা। তাদের মধ্যে যেমন বড় ব্যবসায়ী আছেন, তেমনি আছেন মিল মালিক ও আড়তদাররা। পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি বড় কোম্পানির কারসাজি আছে বলেও বুঝতে পারা যায়, অথচ আমাদের প্রতিযোগিতা কমিশন সেখানে নিরব। ফলে এদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বা নেওয়া হচ্ছে না।
বাজেট আসে, বাজেট যায়। কিন্তু দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে বাজারের ওপর যে সরকারের নিবিড় নজরদারি থাকা দরকার সেটা দেখা যায় না। বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন কোথাও দৃশ্যমান নয়। একই কথা প্রযোজ্য দুর্নীতির বেলায়ও। দুর্নীতি এখন সর্বগ্রাসী। দেশটা যেন যেন দুর্নীতির আঁতুড় ঘরে পরিণত হয়েছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেট, অর্থপাচার, ব্যাংক দখল, জমি, জল দখল; তালিকাটি দীর্ঘ। একই সময়ে সমাজে এতো রকমের দুর্নীতি ঘটতে পারে, সেটা ভাবাই যায় না; কিন্তু হচ্ছে ঠিকই।
সমাজে যত দুর্নীতি বাড়ছে, দুর্নীতি ততই আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। সেটা হচ্ছে বলেই আরও অনেকে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন, যার ফলে সমাজে দুর্নীতি আরও বেড়ে যাচ্ছে। দুর্নীতির শক্তি বৃদ্ধি হওয়ার অনেক কারণের বড় কারণ হলো ক্ষমতা কাঠামোর প্রশ্রয়। কিন্তু আমরা হয়তো বুঝতেও পারছি না যে দুর্নীতির পাঁকে একটি সমাজ কীভাবে ডুবে যাচ্ছে অতলে। দুর্নীতি লাগাম ছাড়া হয়ে পড়লে সমাজ নিমেষে পৌঁছে দিতে পারে এমন একটি মন্দ সাম্যাবস্থায়, যেখানে দুর্নীতিই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আমরা কি সেখানেই এখন অবস্থান করছি?
লেখক: সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সিনিয়র সাংবাদিক
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিন দিন