অলকানন্দা মালা
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিচ্ছিলেন। প্রিয় নেতার দিকনির্দেশনা শুনতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন অজস্র মুক্তিকামী মানুষ। সেদিনের সে জনসভায় ছিলেন এক তরুণ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তার মনে আমূল পরিবর্তন আনে। এদেশের মানুষ হিসেবে তার আলাদা একটি পরিচয় আছে। বাঙালি হিসেবে পৃথক একটি জাতিসত্তা আছে তার। তিনি সুজেয় শ্যাম। একুশে পদকপ্রাপ্ত সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যামের কথাই বলছিলাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ সুর করেছিলেন তিনি। জেনে নেওয়া যাক প্রখ্যাত এ সংগীতজ্ঞ সম্পর্কে।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
১৯৪৬ সালের ১৪ মার্চ সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন সুজেয় শ্যাম। তার বাবা অমরেন্দ্র চন্দ্র শাহ একটি চা বাগানের মালিক। সুজেয় শ্যামের বেড়ে ওঠাও চা বাগানের সবুজ আচ্ছাদিত পাহাড়ি এলাকায়। শ্যামের পরিবার ছিল সংস্কৃতিবান্ধব। তার জ্যাঠা মশাইয়ের বাড়িতে নিয়মিত বসত গানের আসর। ছোট্ট সুজেয়ও গিয়ে যোগ দিতেন সে আসরে। একমনে শুনতেন গান। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী রোজ সকালে প্রার্থনা সংগীতে যোগ দিতে হতো। সেখান থেকেই সংগীতের সাথে সখ্যতা শুরু। সুজেয় শ্যাম প্রথম হাতে তুলে নিয়েছিলেন মন্দিরা। যদিও ঘরে হারমনিয়াম ছিল। তবে সেসব ছোঁয়া ছিল বারণ। তখনকার দিনে মেয়েদের একটু গান শেখান হতো যেন তাদের ভালো বিয়ে হয়। পুরুষদের এসব গান বাজনা করা অপ্রয়োজীন মনে করা হতো।
তবে পরে সুজয় গিটার বাজান শুরু করেন। তবে সংগীতকে পেশা হিসেবে নেওয়ার পরিকল্পনা তখনও ছিল না। সিলেটের ছেলে লন্ডন যাবে, সেখানে হবে কর্মস্থল, এটাই তো রীতি। বিলেত যাওয়ার বন্দোবস্তও প্রায় ঠিক। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে রইলেন। ভেস্তে গেল সুজয়ের লন্ডন যাত্রা। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ১৯৬৩। লন্ডন যাওয়া হলো না দেখে চলে গেলেন কলকাতা। সেখানে বছরখানেক কাটিয়ে দেশে ফিরলেন ১৯৬৪ সালে।
সংগীতে যাত্রা
সেসময় চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্রে যন্ত্রশিল্পী নেওয়া হচ্ছিল। এক শুভাকাক্সক্ষীর পরামর্শে সুজেয় শ্যাম গিটারবাদক হিসেবে বসলেন পরীক্ষায়। কিন্তু প্রথমবারই করলেন ফেল। দ্বিতীবারও তাই। তৃতীয় বারও হলেন ব্যর্থ। তবে চতুর্থবার বিচারকদের সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হলেন। এভাবেই চট্টগ্রাম বেতারে তিনি নাম লিখিয়েছিলেন গিটারিস্ট হিসেবে। যোগ দিয়েছিলেন ৬০ টাকা মাসিক বেতনে। বেতারে বড়দের অনুষ্ঠানে গিটার বাজানোর পাশাপাশি ছোটদেরও একটি অনুষ্ঠান করতেন। বেশ ভালোই কাটছিল। গিটারবাদক হিসেবেও নাম ডাক হয়েছিল।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা
শিল্পীমন সে তো পাখির মতো। সুজেয় শ্যাম সব ছেড়ে ঢাকায় থিতু হতে চাইলেন। এই উদ্দেশ্যে যোগ দেন ঢাকা বেতারে। ঢাকায় এসে সংগীতাঙ্গনের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়তে লাগল। সেইসঙ্গে প্রসারিত হতে লাগল কাজের পরিধি। সেই থেকে এফডিসিতে যাতায়াত শুরু। পরে সেখানে আলাপ হয় সংগীত পরিচালক রাজা হোসেনের সাথে। ১৯৬৯ সালে দুজন মিলে রাজা-শ্যাম নামে কাজ শুরু করেন। সিনেমার সংগীত পরিচালনা করতে থাকেন। পরে একসাথে পঁচিশটির মতো ছবিতে কাজ করেন তারা। এরমধ্যে ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘সূর্য সংগ্রাম’, ‘ভুল যখন ভাঙল’ উল্লেখযোগ্য। সূর্যগ্রহণ ছবিটির জন্য তিনি পান বাচসাস পুরস্কার। সংগীত পরিচালনায় ভালোই নাম করেছিলেন সুজেয় শ্যাম।
ক্রান্তিকালে দেশ
সুজেয় শ্যাম যখন ঢাকায় নিয়মিত কাজ করছেন তখন দেশের পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। দেখলেন উত্তাল ৬৯, ৭০। ৭১-এ জনারণ্যে দাঁড়িয়ে শোনেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। ভেতরে জেগে ওঠে বাঙালি সত্তা। এরপর ২৫ মার্চ, কালোরাত। সেদিন সিলেটে ছিলেন শ্যাম। রাজনীতির সাথে জড়িত এক বড়ভাই ঢাকার ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা জানিয়ে বাড়ি যেতে বলেন তাদের। এরপর থেকে দিন যেতে থাকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে। শ্যাম বুঝতে পারেন পাকিস্তানি সেনারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গ্রামে ছুটছে মানুষ। তিনিও নিজের পরিবারসহ আরও কয়েকটি পরিবারসহ রওনা দেন নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে। এ সময় গুরু দায়িত্ব পালন করেন শ্যাম। বিপন্ন মানুষরা যখন নিরাপদ আশ্রয় পেতে দেশের সীমানা পাড়ি দিচ্ছিল তখন একটি করে পরিবার রোজ সীমান্তের ওপারে রেখে আসার কাজটি করতেন তিনি। পরে মা-বাবাকে নিয়ে শ্যাম রওনা দেন ভারতের উদ্দেশে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে
পশ্চিমবঙ্গে বাবা-মাকে নিরাপদ স্থানে রেখে তিনি বেরিয়ে পড়েন নিজের লক্ষ্যে। সুজেয় শ্যামের একমাত্র লক্ষ্য ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেওয়া। একদিন ট্রেন যাত্রাকালীন তার সাথে হঠাৎ দেখা হয় নির্মাতা সুভাষ দত্তের। তিনিও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাচ্ছিলেন। শ্যামও একই খোঁজে বেরিয়েছেন শুনে সাথে নিয়ে যান। এভাবেই সুজেয় শ্যাম পান স্বাধীন বাংলা বেতারের খোঁজ। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগাতে কাজ শুরু করেন। স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রথম তিনি সুর করেন ‘আয়রে মজুর’ নামে এক গান। সেসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নেতৃত্বে ছিলেন প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক সমর দাস। একদিন আবুল কাশেম নামের এক গীতিকার শ্যামকে একটি লিরিক নিয়ে দেখান। সেইসঙ্গে তিনি জানান সমর দাসকে লিরিকটি দেখানোর সাহস পাচ্ছেন না। তাই শ্যামের হাতে তুলে দেন গানের কথা। কথাগুলো পছন্দ হয় তার। গানটি তিনি করবেন বলে জানিয়ে দেন। এভাবেই তৈরি হয়েছিল সুজেয় শ্যামের দ্বিতীয় গান ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’। গানটি হয়ে উঠেছিল বাঙালির প্রাণের গান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে থাকাকালীন মোট ৯টি দেশের গান করেন তিনি।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান
সুজেয় শ্যাম সুরারোপিত গানই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বেতারের কেউ জানতেন না আজ বিজয়ের গান গাইতে চলেছে বাঙালি। এ খবর তাদের দেন জাতীয় চার নেতা তাজুদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এইচ এম কামারুজ্জামান। তারা জানালেন বিজয়ের গান প্রয়োজন। সমর দাস এই দায়িত্ব দেন সুজেয় শ্যামের ওপর। কিন্ত এত তাড়াতাড়ি লিরিক পাবেন কোথায় তিনি। লিরিক দিয়ে তাকে উদ্ধার করলেন শহিদুল ইসলাম। অল্প সময়েই তাতে সুর বসালেন সুজেয় শ্যাম। তৈরি হলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’। এবার ঘরে ফেরার পালা।
যুদ্ধপরবর্তী সময়
৭১ পরবর্তী সময় দেশে ফিরে ফের কাজে মন দেন শ্যাম। ১৯৮৬ সালে যাত্রা শুরু করেন একক সংগীত পরিচালক হিসেবে। আবদুল লতিফ পরিচালিত ‘বলবান’ ও ‘অবাঞ্চিত’ ছবির মাধ্যমে এই যাত্রা শুরু হয় তার। এরপর ‘হাছন রাজা’ সিনেমায় সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করে জিতে নেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পরে ‘জয়যাত্রা’ ও ‘অবুঝ বউ’ চলচ্চিত্রের জন্য আরও দুইবার জাতীয় পুরষ্কার জিতে নেন তিনি। শুধু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারই নয় পেয়েছেন একুশে পদক। ২০১৮ সালে ভাষা সাহিত্যে অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার তাকে এ সম্মাননা প্রদান করে।
আক্ষেপ
কিছু আক্ষেপ রয়ে গেছে সুজেয় শ্যামেন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ডাকে বাঙালি সত্তা জেগে উঠেছিল তার। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মেনেই চলেছেন পথ। যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারে। এদিকে শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যানসার। এ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বরং তিনি ভাবেন তার ‘বিজয় নিশান’ গানটির সঙ্গে করা একপেশে আচরণ নিয়ে। শ্যাম জানান, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পরই গানটির প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘদিন অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল গানটি। পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে গানটি মুক্তি পায় বন্দিদশা থেকে। বিষয়টি দুঃখ দেয় তাকে। শিল্পের সঙ্গে এমন আচরণ মানতে পারেন না তিনি।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সুরের মূর্চ্ছনা