নাহিন আশরাফ
কিছু মানুষের অবদানে এখনো দেশীয় শিল্প বেঁচে আছে ও প্রতিদিন হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে নতুন রূপে। এর মধ্যে একটি পরিচিত নাম বিবি রাসেল, যিনি দেশীয় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন। বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারেও তিনি হয়ে উঠেছেন জনপ্রিয়। ডিজাইন ও সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি সবার মন কেড়েছেন। তিনি প্রতিনিয়ত বিশ্বের কাছে তুলে ধরছেন বাংলাদেশকে।
বিবি রাসেলের জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৫০ সালের ১৯ আগস্ট। জন্ম চট্রগ্রামে হলেও তার পৈত্রিক বাড়ি রংপুরে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বিবি রাসেল তৃতীয়। তিনি কামরুন্নেসা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে ম্যাট্রিক এবং পরবর্তীতে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। যে সময়ে তিনি বেড়ে উঠছিলেন সেসময় নারীর উচ্চশিক্ষা ছিল বিলাসিতা। ১৯৭২ সালে যখন নারীরা ঠিক মতো পড়ালেখার সুযোগই পেত না ঠিক সেই সময় বিবি রাসেল ফ্যাশন নিয়ে পড়ালেখা করতে চলে যান লন্ডন। ১৯৭৫ সালে তার ফ্যাশন নিয়ে পড়ালেখা শেষ হয়। সে বছর তিনি লন্ডনেই তার কলেজে নিজের ডিজাইন করা পোশাকে মডেলিং করেন, এতে তিনি বেশ সাড়া পান। বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মডেল হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান তিনি। ইভস সেন্ট লরেন্ট, কার্ল লেগার ফিল্ড, জর্জিও আরমানির মতো ব্র্যান্ডের সাথে কাজ করেন তিনি।
বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডের সাথে কাজ করা ও জাঁকজমকপূর্ণ জীবন ফেলে বিবি রাসেল ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশের বাইরে দীর্ঘদিন থাকলেও মাতৃভূমির প্রতি ছিল তার অন্যরকম টান। ১৯৯৫ সালে ১৯ জুন বিবি রাসেল নিজের হাতে গড়ে তোলেন বিবি প্রডাকশন। তার প্রোডাকশনের মাধ্যমে তিনি হাতে বোনা খাদি, মসলিন, জামদানি ও সুতি শাড়ির কাপড় নিয়ে কাজ শুরু করেন। মসলিন কাপড়ের রয়েছে দুঃখজনক এক ইতিহাস। এই ইতিহাস ও হারিয়ে যাওয়া মসলিনকে তুলে ধরছেন তিনি। তবে তার দুটি বিখ্যাত আবিষ্কার হলো গামছা ও রিকশা প্রিন্ট। ফ্যাশন দুনিয়াকে তিনি পরিচয় করান গামছার সাথে। গামছা দিয়ে অসাধারণ পোশাক, শাড়ি, ব্লাউজ তৈরি করেন। এছাড়া পোশাক, চশমা, জুতা ও অন্যান্য অনুষঙ্গের মধ্যে তিনি ঢাকা শহরের রিকশার প্রিন্ট তুলে ধরেন। গামছা ও রিকশা প্রিন্টের কথা যখন ফ্যাশন জগতে বলা হবে তখন বিবি রাসেলের নামও আসবে।
শুধু দেশেই নয়, ভারত, শ্রীলঙ্কা, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ডেনমার্ক ও কম্বোডিয়ার তাঁতিদের নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কম্বোডিয়ায় এইচআইভি পজিটিভ নারীদের সঙ্গে এবং স্পেনের কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দী নারীদের নিয়ে ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’ থিমে কাজ করেছেন। ইউনেস্কোর সহায়তায় ১৯৯৬ সালে ‘উইভারস অব বাংলাদেশ’ নামে বিবি প্রডাকশন প্রথম ফ্যাশন শো করে প্যারিসে। ইউনেস্কোর সহায়তায় তিনি ইউরোপে অনেক বড় শো করেন। ইউরোপের বিশ্বসেরা আটটি ব্র্যান্ড আরমানি, ভেলেন্তিও, পলস্মিথ, কেলভিন ক্লেইন, হুগোবস, ম্যাক্স মারা ও লরেল ব্র্যান্ডের পাশাপাশি ‘বিবি রাসেল’ নামের ব্র্যান্ডও ফ্যাশনপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। বাংলাদেশের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে তিনি তাঁতিদের খুঁজে বেড়ান। কারণ তিনি মনে করেন আমাদের দেশের তাঁতিদের মধ্যে যে প্রতিভা রয়েছে তা বিশ্বের কোথাও নেই। একটু সুযোগ পেলে তারা অনন্য স্থানে নিজেদের নিয়ে যেতে পারবে। বিবি রাসেলের সব সময় দেশীয় শিল্পকে তুলে ধরার এই চেষ্টার জন্য বলা হয় ফ্যাশনে তিনি বিপ্লব ঘটিয়েছেন।
ছোটবেলা থেকেই বিবি রাসেলের প্রচণ্ড জানার আগ্রহ। তার বাড়িতে কিছু নারী তরকারি ও মাছ বিক্রি করতে আসতেন। তারা নিখুঁত কাজ করা শাড়ি পরতেন। বিবি রাসেল তাদের প্রশ্ন করতেন, এ শাড়ি তারা কোথায় পায়। তারা জানাতেন গ্রামে এইসব শাড়ি তৈরি করা হয়। বিবি রাসেলের তখন মনে হতো গ্রামে অভাবে থাকা মানুষগুলো যদি এ কাজ করতে পারে তাহলে তার কাছে পেন্সিল আছে, রঙ-তুলি আছে, সুযোগ আছে তিনি কেন করতে পারবেন না? তখন থেকেই ডিজাইন নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। তার এই যাত্রায় সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন বাবা-মায়ের। তার বাবা তাকে কখনো ভয় পেতে শেখান নেই, শিখিয়েছেন মানুষকে শ্রদ্ধা করতে। নিজের কাজ নিয়ে সবসময় সন্তুষ্ট বিবি রাসেল। তিনি মনে করেন, নিজেকে যে স্থানে দেখতে চেয়েছিলেন আজ তিনি সেখানেই আছেন। দেশীয় শিল্প ও গ্রামবাংলার মানুষদের নিয়েই তিনি সবসময় কাজ করতে চান।
বিশ্ব দরবারে তিনি কেন গামছাকে তুলে ধরলেন এ প্রশ্নের জবাবে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, একটি ছোট্ট গামছায় রয়েছে হাজারো রঙের খেলা। গ্রামবাংলার মানুষরাই সাধারণত এই গামছার প্রচলন শুরু করেন। তাদের এত সুন্দর রঙের কম্বিনেশন আইডিয়া সবসময় তাকে মুগ্ধ করত। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন গামছার সাথে পুরো বিশ্বকে পরিচয় করাবেন, পোশাক ও ফ্যাশনে নিয়ে আসেন গামছার স্পর্শ। অনেকে তাকে মডেল বললেও তিনি নিজেকে ডিজাইনার পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ মডেলিং করার স্বপ্ন তার কখনোই ছিল না। এ কাজ তিনি করেছিলেন শুধুমাত্র শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায়। তার শিক্ষকরা মনে করতেন মডেলিংয়ে তিনি বেশ ভালো করবেন। তবে মডেলিংয়ের কাছেও তিনি কৃতজ্ঞ। কারণ মডেলিং করে তিনি বেশ অর্থ উপার্জন করেছিলেন, যে অর্থ তাকে সাহায্য করেছে এ প্রোডাকশন দাঁড় করাতে।
তিনি শুধু নিজের বিবি প্রোডাকশন নিয়েই ভাবেন না। তিনি ভাবেন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের তাঁতিদের নিয়ে। তিনি পৃথিবীতে বাংলাদেশকে পরিচয় করাতে চান দেশেল নান্দনিক ফ্যাশন দিয়ে। দেশীয় পণ্যকে বাঁচিয়ে রাখাই তার মূল উদ্দেশ্য। অনেকেই এখন দেশীয় পণ্য নিয়ে ব্যবসা করছে। কিন্তু ব্যবসায়ী ও ডিজাইনার এক জিনিস নয়, এ কথা সবসময় বলেন বিবি রাসেল। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আমাকে এতো দিয়েছে যার জন্য এ দেশের কাছে আমি চিরজীবন কৃতজ্ঞ। পৃথিবীর যে দেশেই তিনি যান না কেন, তার বেশিদিন মন টেকে না। তিনি যখন গ্রামে তাঁতিদের সাথে কাজ করতে যান তখন গ্রামের সব মানুষেরা তাকে ঘিরে ধরে। তাকে অসম্ভব সুন্দরভাবে আপ্যায়ন করে। যা তাকে সবসময় মুগ্ধ করে। দেশের প্রতি ভালবাসার বাড়িয়ে তোলে। এই ভালোবাসার টানে বাইরের দেশে অনেক সুযোগ হাতছানি দেওয়ার পরেও সবকিছু ছেড়ে তিনি দেশে চলে আসেন। অনেকেই মনে করে দেশীয় পোশাক অনেক একঘেয়ে ও একই সরল ডিজাইনের। কিন্তু বিবি রাসেল তাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণ করে দেশীয় পোশাকের মধ্যে নিয়ে এসেছেন নানা বৈচিত্র্য ও পরিবর্তন। পোশাকে করেছেন কখনো সুই সুতার কাজ, কখনো গামছা, কখনো রিকশা প্রিন্ট। ও হাজারো হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন তার পোশাকে। এই পোশাকই তিনি স্টেজে তুলে বিশ্বকে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি।
বিবি রাসেলের ফ্যাশন আইকন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোটবেলার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন সাদাকালো ছবি দেখে তিনি মুগ্ধ হতেন। তিনি মনে করেন সেকালের মানুষ হবার পরেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অনেক ফ্যাশনেবল ও স্টাইলিশ। বিবি রাসেল গান শুনতে ভালোবাসেন। শুধু অবসর নয় ব্যস্ততার মধ্যেও তার ঘরে বাজতে থাকে গান। ছোটবেলা থেকে রয়েছে ডায়েরি লেখার অভ্যাস। যত ব্যস্ত থাকুন না কেন প্রতিদিন একটু হলেও তিনি ডায়েরি লেখেন। বিবি রাসেল মনে করেন তিনি আজকে এ পর্যায়ে আসতে পেরেছেন শুধুমাত্র স্বপ্ন দেখার সাহসের কারণে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রিনিয়র