বিশ্বকাপের স্মরণীয় ও আলোচিত ঘটনা

উপল বড়ুয়া

অবশেষে শেষ হলো ১০ দলের ৪৫ দিনের ব্যাট-বলের লড়াই। শুরুটা যেখানে হয়েছিল শেষটাও সেখানে, আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে। ১৯ নভেম্বর লাখো দর্শক-সমর্থকদের সামনে ভারতের অজেয় যাত্রা থামিয়ে রেকর্ড ষষ্ঠতম বিশ্বকাপ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। রাউন্ড রবিন লিগে গ্রুপ সেরা, সেমিফাইনালেও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রতিশোধ নেওয়া দাপুটে জয়, কিন্তু এমন দুর্দান্ত শুরুর পর শেষটা ভালো হয়নি ভারতের। গ্রুপ পর্বে অজিদের বিপক্ষে দোর্দণ্ডপ্রতাপের জয় পেলেও ফাইনালে টিম ইন্ডিয়া ছিল নির্বিষ। জ্বলে ওঠার চেষ্টা করলেও রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, লোকেশ রাহুল ইনিংস বড় করতে পারেননি। আর ফাইনাল মানেই যে অস্ট্রেলিয়ার হলুদ উৎসব, সেটি আবারও প্রমাণিত হলো। ক্রিকেট বিশ্বের প্রথম দল হিসেবে জিতে নিল হেক্সা। ২০০৩ বিশ্বকাপেও ভারতকে বেদনায় নীল করে শিরোপা জিতেছিল অজিরা। সেবার খেলোয়াড় হিসেবে অশ্রুসজল হয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়, এবার কোচ হিসেবে। ২০১১ বিশ্বকাপের পর এবারই বিশ^কাপের ফাইনাল খেলা ভারতের। ২০১৩ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর আর কোনো আইসিসি শিরোপা নেই তাদের ঘরে। সেই অপেক্ষাটা তাদের আরও বাড়ল। গত ৯ বছরে ৯ বার ভারত আইসিসির কোনো ইভেন্টের নকআউটপর্ব থেকে বাদ পড়ল। তার মধ্যে পাঁচবার খেলেছে ফাইনাল, তিনবার সেমিফাইনাল। সে যাক, এ বিশ্বকাপ জন্ম দিয়েছে অনেক স্মরণীয় ও আলোচিত ঘটনা। আসুন পাঠক ফ্ল্যাশব্যাকে সেসব আরেকটু দেখে নিই।

ফাইনালের ঠান্ডা মাথার নায়ক হেড: চোটের কারণে প্রথম পাঁচ ম্যাচ খেলতে পারেননি। তারপরও ট্রাভিস হেডের ওপর আস্থা রেখেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কোচ অ্যান্ড্রু ম্যাকডোনাল্ড। ভারতে হেড দলের সঙ্গে যোগ দেন সবার শেষে। বিশ্বকাপে নিজেদের পঞ্চম ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ফিরেই করেন সেঞ্চুরি, সেমিফাইনালেও ফিফটির সঙ্গে ২ উইকেট নিয়ে হন ম্যাচসেরা। আহমেদাবাদের ফাইনালে তো লিখলেন অস্ট্রেলিয়ার অনন্য অধ্যায়। লক্ষ্য তাড়ায় ৪৭ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলা অজিরা ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জিতল হেডের সেঞ্চুরিতে। ঠান্ডা মাথার সঙ্গে মারনাস লাবুশেনের সঙ্গে ১৯২ রানের জুটি গড়ে দলকে পৌঁছে দেন জয়ের বন্দরে। ১২০ বলে ১৩৭ রানের ইনিংস খেলে ফাইনালের ম্যাচসেরাও তিনি। বিশ্বকাপের ফাইনালে সপ্তম ব্যাটার হিসেবে সেঞ্চুরি করেছেন হেড, আর রান তাড়ায় ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার অরবিন্দ ডি সিলভার পর এটিই ফাইনালে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি।

ম্যাক্সওয়েলের দ্রুততম সেঞ্চুরি ও ২০১*: এ বিশ্বকাপ দুই হাত ভরে দিয়েছে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে। শিরোপা জেতা হলো। কয়েকদিনের ব্যবধানে দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটার এইডেন মার্করামের (৪৪ বল) রেকর্ড ভেঙে ডাচদের বিপক্ষে ৪০ বলে সেঞ্চুরি, যা বলের হিসেবে বিশ্বকাপের দ্রুততম। অজি অলরাউন্ডারের কীর্তি এখানেই শেষ নয়। ম্যাক্সির কাছে তো বটে ক্রিকেট সমর্থকদের কাছে আমৃত্যু স্মরণীয় হয়ে থাকবে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তার ১২৮ বলে অপরাজিত ২০১ রানের ইনিংসটি। ২৯২ রানের লক্ষ্য তাড়ায় ৯১ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে বসা অস্ট্রেলিয়াকে চোট নিয়েও অবিশ্বাস্য জয় এনে দেন ম্যাক্সওয়েল। খেলার মাঝে হঠাৎ মাংসপেশীতে চোট পান তিনি। তবে দলের প্রয়োজনের মুহূর্তে দমে যাননি। তালগাছের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে খেলে গেছেন রিভার্স সুইপ-স্লগ সুইপ-লং অনের মতো চোখ ধাঁধানো একেকটি শট। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা ইনিংসের তকমাও পেয়ে গেছে এটি। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজনীয় রান দুটিও আসে তার ব্যাট থেকে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ম্যাক্সি আবারও পেলেন বিশ্বজয়ের স্বাদ।

শচীনকে ছাড়িয়ে কোহলির ৫০তম সেঞ্চুরি: ২০১১ বিশ্বকাপে জয়ের পর শচীন টেন্ডুলকারকে কাঁধে নিয়ে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন বিরাট কোহলি। সেই মাঠেই কিউইদের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’কে কুর্নিশ জানান ‘কিং’। ওয়ানডেতে শচীনের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ড যে ভাঙা হয়ে গেছে ততক্ষণে! কোহলির সেঞ্চুরির ফিফটি মাঠে বসেই দেখেছেন শচীনসহ আরও অনেক তারকা। ছিলেন ফুটবল কিংবদন্তি ডেভিড বেকহামও। এ বিশ্বকাপেই শচীনের রেকর্ডে ভাগ বসান কোহলি। আর সেটি ভাঙলেন এই বিশ্বকাপেই। শচীনের রেকর্ড ভাঙাকেই যেন পাখির চোখ করে একের পর ম্যাচ খেলে গেলেন কোহলি। শচীনের রেকর্ড ভেঙেই এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্রুততম ২৬ হাজার রান, আরও কত রেকর্ড যে করেছেন কোহলি তার ইয়ত্তা নেই। ফাইনালে হারলেও এই বিশ্বকাপ তারও। সর্বোচ্চ ৭৬৫ রান নিয়ে টুর্নামেন্ট সেরাও তিনি।

সাকিব বনাম ম্যাথুস: ‘টাইমড আউট’, এমন আউটের কথা আগে কি জানত কেউ? উইকেটে আসার পর হেলমেট সমস্যার কারণে শ্রীলঙ্কার মিডল অর্ডার ব্যাটার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস সময়ক্ষেপণ করায় আম্পায়ারের কাছে আবেদন জানান সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশ অধিনায়কের আবেদনে সাড়াও দেন ফিল্ড আম্পায়ার। লঙ্কান অলরাউন্ডার সাকিবের কাছে অনুরোধ জানিয়েও রক্ষা পাননি। আইসিসির নিয়মে এই আউট বৈধ হলেও তৎক্ষণাৎ সরগরম হয়ে উঠে বিশ্বকাপ। এমন আউট যে ক্রিকেট ইতিহাসেই প্রথম! নিয়ম অনুযায়ী, এক ব্যাটার আউট হওয়ার তিন মিনিটের মধ্যে মাঠে নামা ব্যাটারকে বলের মুখোমুখি হতে হবে। সেটি করেননি ম্যাথুস। এই ঘটনার জল গড়ায় অনেকদূর।

আফগানদের অনন্য আখ্যান: তৃতীয় বিশ্বকাপ খেলতে এসেই চার জয়, যার মধ্যে তিন চ্যাম্পিয়নকে হারানো, আফগানিস্তান তাদের ক্রিকেটে নতুন আখ্যান লিখল এবার। আশা জাগিয়েও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হেরে যাওয়ায় প্রথমবার সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্নটা মোটামুটি মুঠোছাড়া হয়ে যায় আফগানদের। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাওয়া জয় যে ‘ফ্লুক’ বা অপ্রত্যাশিত নয় সেটি তারা প্রমাণ করে প্রথমবার ওয়ানডেতে পাকিস্তাানকে হারিয়ে। অথচ হাশমতউল্লাহ শহীদিদের শুরুটা হয়েছিল বাংলাদেশের কাছে হার দিয়ে। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর বীরত্ব দেখিয়েছে তারা টিমওয়ার্ক দিয়ে। আফগানিস্তানের ক্রিকেট যে অনেকদূর এগিয়েছে সেটিও প্রমাণিত হলো। আইপিএলে তাদের এক ঝাঁক তারকা খেলে, সেই সুবিধাটাও তারা পেয়েছে ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ হওয়ায়।

ডাচ রূপকথা: শিল্প ও ফুটবলের দেশ তারা। জন্ম দিয়েছে ভিনসেন্ট ফন গঘ ও ইয়োহান ক্রুইফের মতো প্রতিভাকে। ক্রিকেট সেখানে খুব বেশি প্রসিদ্ধ নয়। তারপরও এ বিশ্বকাপের অন্যতম চমক দেখিয়েছে ডাচরা। নেদারল্যান্ডস বিশ্বকাপ শেষ করেছে সবার নিচে থেকে। তবে এক যুগ পর বিশ্বকাপে ফিরেই দেখিয়েছে চমক। ডাচরা নিজেদের তৃতীয় ম্যাচেই মাটিতে নামায় উড়তে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকাকে। কমলা নাচটা তারা আবারও দেখায় দুই ম্যাচ পর। বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়ে সেমিফাইনালের স্বপ্নও দেখেছিল ডাচরা। বাস ডি লিডরা চমক দেখিয়েছিল বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও। যেখানে তারা হৃদয় ভাঙে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের।

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিদায়: বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে নিয়ে বাজি ধরার লোকের অভাব ছিল না। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ভারতে আসা তাদের। দ্বিপাক্ষিক সিরিজেও দুর্দান্ত ফর্মে ছিল তারা। তবে বেন স্টোকস-জনি বেয়ারস্টোদের মতো তারকায় ঠাসা দলটি পেরোতে পারেনি লিগ পর্ব। নিজেদের শেষ দুই ম্যাচে জয় পেলেও তার আগে টানা পাঁচ ম্যাচ হারায় বিদায়ঘণ্টা বেজে যায় জস বাটলারদের। উদ্বোধনী ম্যাচে গতবারের রানারআপ নিউ জিল্যান্ডের কাছে হেরে বসে তারা। অথচ চার বছর আগে নিজেদের মাটিতে এই কিউইদের বিপক্ষে রোমাঞ্চকর জয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপের স্বাদ পেয়েছিলেন স্টোকসরা।

শ্রীলঙ্কার ৫৫ রানের লজ্জা: হারলেও শুরুর দিকে বড় স্কোরের দেখা পাচ্ছিল লঙ্কানরা। প্রথম দুই ম্যাচেই তিনশোর্ধ্ব স্কোর। কিন্তু ভারতের মুখোমুখি হতেই তারা বিশ্বকাপে ফিরিয়ে আনে গত সেপ্টেম্বের এশিয়া কাপের ফাইনালের স্মৃতি। সেই ম্যাচে মোহাম্মদ সিরাজের তোপের সামনে কলম্বোতে মাত্র ৫০ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। এবার ওয়াংখেড়েতে শামির তোপে করতে পারে তারচেয়ে মাত্র ৫ রান বেশি, যা এ বিশ্বকাপের সর্বনিম্ন স্কোর। আর বিশ্বকাপ ইতিহাসে চতুর্থ সর্বনিম্ন। তাদের চেয়ে টেস্ট খেলুড়ে কোনো দল বিশ্বকাপে এত কম রানে অলআউট হয়নি। শামি এই ম্যাচে একাই নেন ৫ উইকেট।

শামির অবিশ্বাস্য তোপ: ভাগ্যিস, বাংলাদেশের বিপক্ষের ম্যাচে চোটে পড়েছিলেন হার্দিক পান্ডিয়া। নয়তো অমন অবিশ্বাস্য মোহাম্মদ শামির কী দেখা মিলত! ভারতের শেষ ৭ ম্যাচ খেলতে পেরেছেন, তাতেই ২৪ উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপের সেরা বোলার এই পেসার। যার মধ্যে তিনবার পেয়েছেন ৫ উইকেটের দেখা, চার উইকেট একবার। তবে শেষটা ভালো হয়নি শামির। ফাইনালে নিতে পেরেছেন মাত্র ১ উইকেট। বিশ্বকাপে ৫৫ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় পাঁচে শামি, ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই শীর্ষে। এ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৩ উইকটে নিয়েছেন অ্যাডাম জাম্পা। অজি স্পিনার অবশ্য খেলেছেন ১১ ম্যাচ। দুজনেই আইসিসির বিশ্বকাপ সেরা একাদশে জায়গা পেয়েছেন। এ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় শামি ও জাম্পার পরে আছেন শ্রীলঙ্কার দিলশান মাদুশঙ্ক (২২), ভারতের আরেক পেসার জসপ্রীত বুমরাহ (২০) ও প্রোটিয়া পেসার জেরাল্ড কোয়েটজি (২০)।

সর্বোচ্চ রানের ম্যাচ: এ বিশ্বকাপ রানবন্যার হবে, এমন ভবিষদ্বাণীর প্রমাণ পাওয়া যায় টুর্নামেন্টের মাত্র চতুর্থ ম্যাচেই। দক্ষিণ আফ্রিকা-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে হলো ৭৫৪ রান। সেই ম্যাচ জিতে যায় প্রোটিয়ারা। তবে এটিই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রানের ম্যাচ নয়। ৭৭১ রান নিয়ে এ তালিকার শীর্ষে অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ড ম্যাচটি, যেখানে রান তাড়া করে হারে কিউইরা। এ বিশ্বকাপে ভারত-নিউ জিল্যান্ড সেমিফাইনালেই হয়েছে ৭২৪ রান, যা এ তালিকার তৃতীয় সর্বোচ্চ। গত বিশ্বকাপে ৭১৪ রান হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ ম্যাচে, যা ছিল চার বছর ধরে শীর্ষে। সেটি এখন তালিকার চারে। এ বিশ্বকাপে আশা করা হয়েছিল, ভারতের ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে ৫০০ রানের স্কোর হবে, সেটি অবশ্য হয়নি। ৪০০ পেরোনো স্কোর করেছে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twenty + four =