লিওনেল মেসি ফুটবলের মহাতারকা অনেক আগে থেকেই। ক্লাব ফুটবলের সম্ভাব্য সব শিরোপা এবং অসংখ্য রেকর্ড যোগ হয়েছে তার নামের পাশে।
বাকি ছিল জাতীয় দলের হয়ে সাফল্য। কোপা আমেরিকা জেতার পর সেই আক্ষেপ ঘুচলেও অপূর্ণতা ছিল আরও একটি। গত বছর বিশ্বকাপ জিতে সেই অপূর্ণতাকে বিদায় বলে দিয়েছেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। আর তাতে পূর্ণতা পেয়েছে যেন খোদ ফুটবল।
ফুটবলকে মহিমান্বিত করা বিশ্বজয়ী লিওনেল মেসির আজ (২৪ জুন) ৩৬তম জন্মদিন। ‘খুদে জাদুকর’ ও সর্বকালের সেরা (GOAT) খ্যাত এই জীবন্ত কিংবদন্তির এই বিশেষ দিনে চলুন দেখে নেওয়া যাক তার ক্যারিয়ারের ৩৬টি জানা-অজানা অধ্যায়।
১. মেসির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জল অধ্যায় অবশ্যই বার্সেলোনা। দুই বছর আগে পিএসজিতে পাড়ি জমানোর আগে কাতালান জায়ান্টদের জার্সিতে ৬৭২টি গোল করেছেন তিনি- যা একটি নির্দিষ্ট ক্লাবের জার্সিতে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড। এর আগে রেকর্ডটির মালিক ছিলেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত খেলে ৬৪৩ গোল করেছিলেন তিনি। পেলের মতো মেসিও ক্যারিয়ারের পড়ন্তবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ফুটবলে যোগ দিচ্ছেন। পেলে গিয়েছিলেন নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে খেলতে। আর মেসি যাচ্ছেন মেজর লিগ সকারের নবীন সদস্য ইন্টার মায়ামিতে।
২. সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৮০৭টি (বার্সার জার্সিতে ৬৭২টি, পিএসজির জার্সিতে ৩২টি এবং আর্জেন্টিনার জার্সিতে ১০৩টি) গোল করেছেন মেসি। যদি গোলগুলোকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ভিত্তিতে ভাগ করা হয় তাহলে দেখা যাবে- বাঁ পায়ে তার গোলসংখ্যা ৬৭৬টি, ডান পায়ে ১০৩টি, হেডে গোল ২৬টি, বুক দিয়ে ১টি এবং বাকি ১টি হাত দিয়ে। তার নিজস্ব ‘হ্যান্ড অব গড’ খ্যাত গোলটি করেন ২০০৭ সালের জুনে এসপানিওলের বিপক্ষে।
৩. ২০১২ সালে ক্লাব ও দেশের হয়ে ৯১টি গোল করেছিলেন মেসি। এক পঞ্জিকাবর্ষে এত বেশি গোল শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে আর কেউ করতে পারেননি। ১৯৭২ সালে ৮৫ গোল করে আগের রেকর্ডটি গড়েছিলেন জার্মান কিংবদন্তি জার্ড মুলার।
৪. ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ডও মেসির দখলে আছে। গত মাসের স্ত্রাসবুর্গের বিপক্ষে করা তার গোলটি ছিল লিগ পর্যায়ে তার ৪৯৬তম গোল। আর তাতে তিনি ছাড়িয়ে যান চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে (৪৯৫)।
৫. মেসি ব্যালন ডি’অর জিতেছেন ৭ বার। মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার জেতার ক্ষেত্রে তার কাছাকাছি আছেন কেবল রোনালদো। পর্তুগিজ উইঙ্গার মোট ৫ বার এই পুরস্কার ঘরে তুলেছেন। তবে মেসির ব্যবধানটা তিনে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। ২০২২ বিশ্বকাপ জেতার পর মেসির অষ্টম ব্যালন ডি’অর পাওয়ার সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি উজ্জ্বল।
৬. বিশ্বকাপের ক্ষেত্রে মেসির দখলে আছে অনন্য একটি রেকর্ড। ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে দুইবার গোল্ডেন বল (বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়) জেতার কীর্তি আছে তার। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির কাছে আর্জেন্টিনা হারলেও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার যায় মেসির ঝুলিতে। এরপর আর্জেন্টিনাকে ২০২২ বিশ্বকাপ জিতিয়ে দ্বিতীয়বার এই পুরস্কার জেতেন তিনি।
৭. ক্লাব ক্যারিয়ারে ছয় মৌসুমে ৫০ বা তার বেশি গোল করার রেকর্ড আছে মেসির। এর মধ্যে ২০১১-১২ মৌসুমে রেকর্ড ৭৩ গোল করেন তিনি। কিন্তু এত গোল করার পরও বার্সা ওই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং লা লিগার শিরোপা ঘুরে তুলতে পারেনি। তবে কোপা দেল রে এবং ক্লাব বিশ্বকাপ জিতে নেয় তারা।
৮. মায়ামির নতুন বাসিন্দা মেসি বার্সার জার্সিতে যে পরিমাণ গোল (৬৭২) করেছেন, ২০০০ মার্কিন নির্বাচনে এর চেয়ে কম ভোটের (৫৩৭) ব্যবধানে আল গোরকে হারিয়েছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ।
৯. মাত্র ১৩ বছর বয়সে আর্জেন্টিনার রোজারিও ছেড়ে বার্সার বিখ্যাত লা মাসিরা অ্যাকাডেমিতে পাড়ি জমান মেসি। ২০০৪ সালে এই ক্লাবের মূল দলে অভিষেক হয় তার। এরপর ২০২১ সালে বিদায় আগে জেতেন রেকর্ড ৩৫টি শিরোপা।
১০. আর্জেন্টিনার জার্সিতে ১০৩ গোল করেছেন মেসি। আন্তর্জাতিক ফুটবলে মাত্র তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে গোলের সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। অন্য দুইজন হলেন পর্তুগালের রোনালদো (১২৩) এবং ইরানের আলী দায়ি (১০৯)।
১১. ২০২২ বিশ্বকাপে আর্জেন্টাইন অধিনায়ক গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে গোল করেছেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে শেষ ষোলো চালুর পরে এক বিশ্বকাপের সব রাউন্ডে গোল করার এমন কীর্তি নেই আর কারো।
১২. চ্যাম্পিয়নস লিগে সবমিলিয়ে ৮ বার হ্যাটট্রিক করেছেন। যা টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। সমান হ্যাটট্রিক আছে শুধু ক্রিস্টিয়ানোর রোনালদোর। দ্বিতীয় স্থানে থাকা পোলিশ স্ট্রাইকার লেভানডভস্কির নামের পাশে আছে ৬টি হ্যাটট্রিক।
১৩. মাত্র ১০ বছর বয়সে গ্রোথ হরমনজনিত সমস্যা ধরা পড়ে মেসি। আশঙ্কা ছিল ফুটবল খেলার মতো যথেষ্ট উচ্চতা হবে না তার। কিন্তু ১৪ বছর বয়সে বার্সার অ্যাকাডেমিতে তার সুচিকিৎসা করা হয়। যার জেরে তার উচ্চতা দাঁড়ায় ৫ ফুট ৭ ইঞ্চিতে (১৭০ সে.মি.)।
১৪. মেসির উচ্চতা যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষদের গড় উচ্চতার চেয়ে ২ ইঞ্চি কম।
১৫. মেসির সেই বিরল খেলোয়াড়দের একজন যিনি দুইবার ট্রেবল জিতেছেন। ২০০৮-০৯ মৌসুমে তিনি বার্সার জার্সিতে লা লিগা, স্প্যানিশ কাপ এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন। এরপর ২০১৪-১৫ মৌসুমে ফের ট্রেবল জেতেন তিনি। প্রথমবার তিনি গোল করেন ৩৮টি এবং পরেরবার করেন ৫৮ গোল।
১৬. মেসি একবার অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিতেছেন। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে দুই গোল করেন তিনি। ফাইনালে আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে নাইজেরিয়াকে হারায়। ওই ফাইনালে একমাত্র গোলটি করেন ২০২২ বিশ্বকাপের ফাইনালে মেসির পাশাপাশি জালের খোঁজ পাওয়া আনহেল দি মারিয়া।
১৭. ক্যারিয়ারে মোট ৫৭ বার হ্যাটট্রিকের দেখা পেয়েছেন মেসি। বার্সার জার্সিতে ৪৮ বার এবং আর্জেন্টিনার জার্সিতে ৯ বার। তার প্রথম হ্যাটট্রিকটি আসে ২০০৭ সালের মার্চে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে। লা লিগার ওই ম্যাচটি ৩-৩ গোলে ড্র করে বার্সা।
১৮. বার্সেলোনার সর্বমোট গোলের ৭.২ শতাংশ (৯ হাজার ৩২২ গোলের মধ্যে ৬৭২টি) একাই করেছেন মেসি। ক্লাবটির বয়স ১২৪ বছর, কিন্তু আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড তাদের হয়ে খেলেছেন মাত্র ১৭ বছর।
১৯. ক্যারিয়ারে ৮০৭ গোল করলেও কোনো ম্যাচের প্রথম মিনিটেই গোল করেননি মেসি।
২০. আর্জেন্টিনার জার্সিতে ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচেই লাল কার্ড দেখেছিলেন মেসি। ২০০৫ সালের আগস্টে, হাঙ্গেরির বিপক্ষে ১৮ বছর বয়সী মেসি বেঞ্চ থেকে বদলি হিসেবে নামার মাত্র দুই মিনিট পরেই প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়কে কনুই দিয়ে ধাক্কা দেওয়ায় লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন তিনি। সবমিলিয়ে ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ৩ বার লাল কার্ড দেখেছেন মেসি (বার্সার জার্সিতে একবার এবং আর্জেন্টিনার জার্সিতে দুইবার)।
২১. ক্লাব ক্যারিয়ারে মোট ৩৮টি (বার্সার হয়ে ৩৫টি এবং পিএসজিতে হয়ে ৩টি) শিরোপা জিতেছেন মেসি। গড়ে প্রতি ২২ ম্যাচে একবার শিরোপা জিতেছেন তিনি।
২২. এক ম্যাচে মেসির সর্বোচ্চ গোল ৫টি। ক্যারিয়ারে দুইবার এই ম্যাজিক ফিগার ছুঁয়েছেন তিনি: প্রথমটি ২০১২ সালের মার্চে বায়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে এবং দ্বিতীয়টি ২০২২ সালের জুনে আর্জেন্টিনার জার্সিতে এস্তোনিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে।
২৩. ২০২২ সালের ডিসেম্বরের ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচটি মেসির বিশ্বকাপে ২৬তম ম্যাচ। তিনি পেছনে ফেলেছেন জার্মান কিংবদন্তি লোথার ম্যাথিউসকে (২৫)।
২৪. সবমিলিয়ে ৫টি বিশ্বকাপে খেলেছেন মেসি। এই রেকর্ডে তার সঙ্গে আছেন- মেক্সিকোর আনতোনিও কারবাহাল, রাফায়েল মার্কেজ আন্দ্রেস গুয়ার্দাদো এবং পর্তুগালের রোনালদো।
২৫. ইন্টার মায়ামির জার্সিতে মেসির অভিষেক ম্যাচটি হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে তার ১৪তম প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ। এর আগের ১৩টি ম্যাচ ছিল আর্জেন্টিনার জাসিতে। এর মধ্যে ২০১৬ কোপা আমেরিকার ফাইনালও আছে। নিউজ জার্সির ওই ম্যাচে চিলির কাছে টাইব্রেকারে হেরে যায় আর্জেন্টাইনরা। মেসি নিজে স্পট কিক মিস করেন।
২৬. আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৩৭টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের বিপক্ষে গোল করেছেন মেসি। সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন বলিভিয়ার বিপক্ষে, ৮টি।
২৭. আর্জেন্টিনার জার্সিতে সবমিলিয়ে ১৭৫ ম্যাচ খেলেছেন মেসি। আর্জেন্টিনা তো বটেই দক্ষিণ আমেরিকাতেই জাতীয় দলের জার্সিতে এত ম্যাচ খেলার রেকর্ড নেই অন্য কারো। সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা পুরুষ ফুটবলারদের তালিকাতে মেসি যৌথভাবে আছেন ১০ম স্থানে।
২৮. ক্লাব ক্যারিয়ারে মেসি সবচেয়ে বেশি বেশি গোল করেছেন সেভিয়ার বিপক্ষে, ৩৮টি।
২৯. আর্জেন্টিনার জার্সিতে সবসময় ১০ নম্বর জার্সি পরেননি মেসি। আলবিসেলেস্তেদের হয়ে ১৮ এবং ১৯ নম্বর জার্সিতেও খেলেছেন তিনি। ১০ নম্বর জার্সি না পরে সর্বশেষ ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে খেলেছেন মেসি, ফ্রান্সের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে।
৩০. চ্যাম্পিয়নস লিগে ইংলিশ ক্লাবগুলোর বিপক্ষে ২৭ গোল করেছেন মেসি, যা অন্য যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে ৭টি বেশি। ইংলিশ ক্লাবগুলোর মধ্যে আর্সেনালের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি (৯টি) গোল করেছেন মেসি।
৩১. ক্যারিয়ারে ফ্রি-কিক থেকে ৬২টি গোল করেছেন মেসি। এর মধ্যে ৫০টি বার্সার হয়ে, দুটি পিএসজির হয়ে এবং আর্জেন্টিনার হয়ে ১০টি।
৩২. কোপা আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডটিও মেসির। ছয় আসর মিলিয়ে মোট ৩৪ ম্যাচে মাঠে নেমেছেন তিনি। তবে এই রেকর্ডে তার সঙ্গে রয়েছেন চিলির সাবেক গোলরক্ষক সের্হিও লিভিংস্তোন, যিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ৩৪ ম্যাচ খেলেছেন।
৩৩. ২০১০ সালে ইংলিশ ক্লাব সান্ডারল্যান্ডকে গোলের হিসাবে প্রায় পেছনেই ফেলে দিয়েছিলেন মেসি। ওই সময় পর্যন্ত ইংলিশ ক্লাবটির সর্বমোট গোলসংখ্যা ছিল মেসির সমান ৩৮৯টি।
৩৪. ক্লাব ক্যারিয়ারে টানা ১০ ম্যাচে গোল করার অনন্য কীর্তি রয়েছে মেসির। ২০১২-১৩ মৌসুমে ২৫ বছর বয়সে এই রেকর্ড গড়েন তিনি।
৩৫. ক্লাব ক্যারিয়ারে টানা ১২ ম্যাচে গোল না করার ইতিহাসও আছে মেসির। ২০০৬-০৭ মৌসুমে ১৯ বছর বয়সী মেসি রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে এই গোলখরা কাটান।
৩৬. ইনস্টাগ্রামে সবচেয়ে বেশি লাইক পাওয়া পোস্টটি মেসির। ২০২২ বিশ্বকাপ জেতার পর মেসির উদযাপনের একটি ছবি এখন পর্যন্ত ৭৫.৬ মিলিয়ন লাইক পেয়েছে। তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা একটি ডিমের ছবির চেয়ে যা ১৫ মিলিয়ন বেশি।