শোনা যায় বিশ্বের বড় বড় ধনকুবেরদের একটি করে ফ্ল্যাট আছে দুবাইতে। অবসর উদ্যাপন করতে সেখানে যান তারা। এই তালিকায় আছেন বিনোদন অঙ্গনের তারকা, খেলোয়াড় ব্যবসায়ীসহ অর্থবিত্তে প্রথম সারির বিশিষ্ট মানুষজন। শান শওকত ও আভিজাত্যে ভরপুর দুবাইয়েরও চাকচিক্যের কমতি নেই। দুবাই এই জৌলুস দিয়েই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খ্যাতনামা ও বিত্তবানদের টেনে আনে নিজের দিকে। ওই মানুষদের আপ্যায়নে মরুর বুকে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুর্জ আল খলিফা। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন। যার শীর্ষে দাঁড়ালে দুবাই চলে আসে চোখের সামনে। নানা রঙের বাতির আলোয় গোটা শহর ঝলমল করে। এই সৌন্দর্য আর প্রাচুর্য কেবলই চোখে দেখার, বর্ণনা করার নয়।
নির্মাণ
মরুর বুকে বুর্জ খলিফার কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে। সে এক মহাযজ্ঞ বলা চলে। বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল বিখ্যাত নকশাকারদের। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন স্কিডমোর, ওইংস অ্যান্ড মেরিল এর অ্যাড্রিয়ান স্মিথ। বিশ্বের সুউচ্চ সব অট্টালিকা তৈরির অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। বুর্জের আগে বিশ্বের একাধিক আকাশ ছোঁয়া ভবন বানিয়েছিল দলটি। এমনকি বুর্জ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যে ভবনটির দখল থেকে বিশ্বসেরা খেতাব কেড়ে নিয়েছিল সেই শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ারের নকশাও তাদের করা ছিল। আর গোটা বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল হায়দার কনসাল্টিংকে।
নির্মাণের কারণ
আরব বিশ্বের অর্থনীতির প্রধান উৎস খনিজ সম্পদ। এরমধ্যে অন্যতম তেল। তাদের আয়ের প্রধান উৎস এই তেল। একমুখী তেল নির্ভরতা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা অনেক দিন ধরেই করে আসছিল আরব আমিরাত। বুর্জ আল খলিফা তাদের এই প্রকল্পের একটি। তেল নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে এই প্রকল্প হাতে নিয়েছিল তারা। শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে। এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় ২০০৯ সালে। ভবনটি খুলে দেওয়া হয় ২০১০ সালে। সে বছর বুর্জ আল খলিফা উদ্বোধন করেন দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাক্তম।
কী আছে এই বহুতল ভবনে
বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতা বিশিষ্ট এই ভবন নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। শেখ মেহরার সৌন্দর্যের যেমন তারা কূল কিনারা করতে পারে না তেমনই কূল পায় না বুর্জ আল খলিফা নিয়ে। এর উত্তরে বলা যায় কী নেই এখানে। রেস্তোরাঁ থেকে সুইমিং পুল সব রয়েছে। ১৬৩ তলার বুর্জ খলিফায় রয়েছে চারটি সুইমিং পুল। এর একটি ৪৩ তলায় আর অন্যটি ৭৬ তলায়। বুর্জ খলিফায় রয়েছে একটি স্বাস্থ্যচর্চা কেন্দ্র। একে ডাকা হয় দ্য ক্লাব নামে। এই দ্য ক্লাবের ছাদে রয়েছে বাকি দুটি সুমিং পুল। বিভিন্ন ধরনের মানুষজনের যাতায়াত এখানে। তাই একে করা হয়েছে সবার উপযোগী। মাথায় রাখা হয়েছে পড়ুয়া ব্যক্তিদের কথাও। যারা বই পড়তে ভালোবাসেন, খানিক অবসরে ডুবে যেতে চান বইয়ের পাতায় তাদের জন্য এই বহুতলের ১২৩ তলায় রয়েছে একটি পাঠাগার। বছর দুয়েক আগেই পৃথিবীর উচ্চতম রেস্তোরাঁ ছিল এখানে। সেটি হলো ‘অ্যাটমোসফিয়ার’। তবে গেল বছর তার রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছে চিনের একটি বহুতল ভবনে তৈরি রেস্তোরাঁ। শুরুতেই বলেছি বুর্জ খলিফা থেকে দেখা যায় গোটা দুবাই। এই ব্যবস্থা রয়েছে ১৪৮ তলায়। ৫৫৫ মিটার উঁচু এই জায়গাটি পর্যটকদের ভীষণ টানে। এখানে রয়েছে আউটডোর অবজারভেশন ডেক যেখানে দাঁড়িয়ে পর্যটকরা ইরানের সমুদ্র উপকূলও অনায়াসে দেখতে পান।
বুর্জ খলিফায় রাত কাটানোর জন্য রয়েছে আবাসিক ব্যবস্থা। ভবনের এক থেকে আট তলা পর্যন্ত রয়েছে আরমানি হোটেল। এখানে কক্ষ রয়েছে ১৬০টি। নিজস্ব স্পা, সুইমিং পুল, লাইব্রেরি এবং জিমসহ সব রকম সুবিধাই রয়েছে। এখানে যারা থাকেন কেনাকাটা বা কোনো প্রয়োজনেই বাইরে যেতে হয় না তাদের। ফলে এখানকার বাসিন্দাদের আয়েশের যেন অন্ত নেই। দোকান, বাজার, শপিং মল সবই রয়েছে এখানে। তবে সেসব সুবিধা পেতে হলে থাকতে হবে পকেট ভর্তি অর্থ। কেননা শানশওকতে ভরা এই বহুতল ভবনে থাকতে প্রতি মুহূর্তে চলে কাড়ি কাড়ি টাকার খেলা। আপনি যদি এখানে একটি ৪ থেকে ৫ বেডরুমের কোনো অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে চান তাহলে গুনতে হবে ২ কোটি ৭ লক্ষ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৩০০ কোটিরও বেশি। তবে একটি স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট কিনলে খরচ কম পড়বে। সেটিও ২০ লক্ষ আরবীয় মুদ্রা। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫ কোটির সমান। এখানেই শেষ নয় এই ভবনে যারা থাকেন তাদের নানাবিধ খরচও অনেক। যা আরবীয় মুদ্রা বছরে পাঁচ লাখের মতো। বাংলাদেশি টাকায় হতে পারে দেড় কোটির বেশি। এই বহুতল ভবনে অ্যাপার্টমেন্ট এবং স্টুডিও মিলিয়ে কক্ষের সংখ্যা ৯০০। তাতে ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ থাকেন।
নামকরণ
শুরুতে বুর্জ খলিফার নামকরণ করা হয়েছিল বুর্জ দুবাই। তবে শেষ পর্যন্ত টিকেনি এই নাম। কেননা নির্মাণ কাজ চলাকালীন হঠাৎ আর্থিক সংকটে পড়ে প্রকল্পটি। সে সময় পাশে এসে দাঁড়ান আরব আমিরাতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। অর্থ সহায়তা দিয়ে ও তহবিল তৈরি করে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু এই ভবনটিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে সহায়তা করেন। এতে কৃতজ্ঞতা স্বরুপ বদলে যায় বহুতল ভবনের নাম। খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ভবনটির নাম রাখা হয় বুর্জ আল খলিফা।
স্থাপনার ধরন
হাইমোনোক্যালিস নামের এক ধরনের ফুল আছে যেটি ওপরের দিকে যত বাড়ে তার বিস্তার তত কমে। ওই ফুলের আদলেই নির্মাণ করা হয়েছে বুর্জ আল খলিফা। স্থাপত্য কলাতে একে বলে হোলো নিউ-ফিউচারিজম। কংক্রিট, স্টিল, কাচ ও স্টেইনলেস স্টিল নিয়ে নির্মিত হয়েছে বিলাসী এই বহুতল ভবন। এতে কংক্রিট রয়েছে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার ঘনমিটার। অন্যদিকে ৩৯ হাজার ঘনমিটার স্টিল খরচ হয়েছে এখানে। এছাড়া এক লাখ ৩ হাজার বর্গমিটার কাচ এবং ১৫ হাজার ৫০ বর্গমিটার স্টেইনলেস স্টিলে তৈরি হয়েছে বুর্জ খলিফা
এখানে দিনের দৈর্ঘ্য বেশি
উচ্চতার দিক দিয়ে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারকারী বুর্জ খলিফার উচ্চতা ৮১৮ মিটার বা ২৭১৬ ফুট। দীর্ঘ এই ভবন মোট ২০৬ তলা বিশিষ্ট। ওঠানামার জন্য আছে ৫৪টি অত্যাধুনিক লিফট। যেগুলো ঘণ্টায় ছোটে ৪০ কিমি পর্যন্ত। আর মিনিটের মধ্য আরোহী নিয়ে চলে যায় ১২৪ তলায়। তবে চাইলেই আপনি হেসে খেলে ওপরের তলাগুলোতে চলে যেতে পারবেন না। ১৬০ তলা ছাড়ানোর পরই আপনাকে বহন করতে হবে অক্সিজেন সিলিন্ডার। অর্থাৎ সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরাটা মুশকিলই বটে। এ কারণেই কারিগরি কাজকর্মগুলো পরিচালনার জন্য রাখা হয়েছে ওই তলাগুলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বুর্জ আল খলিফার নিচের তলার সাথে ওপরের তলায় থাকা মানুষজনের জন্য উচ্চতার ব্যবধানই বড় কথা না, আরও রয়েছে সময়ের ব্যবধান। ওপর তলার বাসিন্দাদের সাথে সূর্যের দেখা মেলে বেশি। এরা সকালেও যেমন সূর্য বেশি সময় পায় তেমনই দিনের শেষেও সূর্য তাদের জন্য একটু বেশি সময়ই আলো ছড়ায়।
যে কারণে বুর্জ খলিফা টানে
দুবাইয়ের রাজকুমারী শেখ মেহরা বিশ্ববাসীকে যেমন মুগ্ধ করে সৌন্দর্যের দ্বারা বুর্জ খলিফাও তাই। পর্যটককে নিজের দিকে টানার যথেষ্ট উপকরণ রয়েছে এতে। সেসবের একটি ভবন প্রাঙ্গণে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। সহস্রাধিক কোটি অর্থে নির্মিত ফোয়ারাটি মরুভূমি থেকে ৯০০ ফুট উঁচু। পানি প্রবাহের সময় এর উচ্চতা আরও ৫০০ ফুট বেড়ে যায়। একে আলোকিত করে রেখেছে ৬০০টি বৈদ্যুতিক বাতি ও ৫০টি রঙিন প্রজেক্টর। আরবি ভাষায় ধ্রুপদী সংগীতের তালে তালে পানি ছুড়ে দেওয়া ফোয়ারাটি বুর্জ খলিফার মতোই পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতা বিশিষ্ট। এছাড়া ভবনের বাইরে রয়েছে কৃত্রিম হ্রদ, দৃষ্টিনন্দন পার্ক ও উদ্যান যা পর্যটকদের বাড়তি প্রশান্তি যোগায়। পাশাপাশি ভবনটির দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের অসংখ্য চিত্রকর্ম যা শৈল্পিক রুচিবোধ সম্পন্ন পর্যটকদের চোখ ও মনের তৃপ্তি দিয়ে থাকে। তাছাড়া টিকিট কেটে ভবনটির নির্মাণ ভিডিও চিত্র দেখার ব্যবস্থাও রয়েছে। বুর্জ আল খলিফার আরও একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এর অবজাভেশন ডেস্ক। আগেই বলেছি যেখান থেকে গোটা দুবাই দেখা যায়। পাশাপাশি টেলিস্কোপের সাহায্যে রাত ও দিনের দুবাই আলাদা করে উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে সেখান থেকে।
যাদের শ্রম-ঘাম মিশে আছে
বুর্জ আল খলিফায় লেগে আছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া থেকে ভাগ্য ফেরাতে আসাদের ঘাম। এসব জায়গার শ্রমিকদের পরিশ্রমে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ভবনটি। এটি নির্মাণের সময় রোজ কাজ করেছে ১২ হাজার শ্রমিক। তবে শোনা যায় দিন শেষে শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হয়েছে, তাদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।
যেখানে দাঁড়িয়ে আছে
বুর্জ খলিফার অবস্থান দুবাই মলের পাশে ডাউন টাউনে। রোজ সকাল ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে এর প্রবেশ পথ। তবে বৃহস্পতি থেকে শনিবার তা উন্মুক্ত থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। তাই মন ভরে দেখতে সপ্তাহের এই তিন দিন বেছে নেওয়াই উত্তম।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: কোথায় কি