মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চলচ্চিত্র প্রেমীদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে তেমন আয়োজন নেই কোথাও। অথচ স্বাধীনতার লড়াইয়ের গল্প ঘুরে ফিরে এসেছে অনেক সিনেমায়। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। পরবর্তী প্রজন্মের সামনে এগিয়ে যেতে হলে অবশ্যই জানতে হবে আমাদের শেকড়ের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আর এসব জানার প্রধান মাধ্যম বই, সিনেমা ও তথ্যচিত্র। রঙবেরঙ পত্রিকায় প্রতি সংখ্যায় একটি করে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নিয়ে আলোচনা করা হয়। মৌ সন্ধ্যার প্রতিবেদনে আমরা জানবো ‘কারিগর’ সিনেমাটি নিয়ে।
মুক্তির আলোয় ‘কারিগর’
কারিগর সিনেমাটি কোনো সিনেমা হলে মুক্তি পায়নি। সিনেমাটি প্রথম মুক্তির আলোয় আসে ২০১২ সালের ২৬ মার্চ। ওই দিন সকাল ১১টায় আনোয়ার শাহাদাত পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা কারিগর দেখানো হয় চ্যানেল আইতে। এখন কেউ সিনেমাটি দেখতে চাইলে ঘরে বসেই উপভোগ করতে পারবেন। সিনেমাটি দেখা যাবে সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লেজার ভিশনের ইউটিউব চ্যানেলে।
কী আছে কারিগর সিনেমায়?
এই সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের নাম নূপুর। শহরের মেয়ে সে। সদ্য পড়ালেখা শেষ করেছে। স্বপ্ন পিইচডি করবে। এখানে দেখা যায় – আলতা দিয়ে পা রাঙিয়ে, কানে জবা ফুল গুঁজে গাঁয়ের সহজ সুন্দর এক নারীর সাজে ধুলা মাখা এক গ্রামে চলে আসে নূপুর। গ্রামের পথে উচ্ছলতা নিয়ে হাঁটতে থাকে সে। মুক্তিযোদ্ধা ওস্তাগারের খোঁজ পেতে হবে তাঁর। সাক্ষাৎকার নিতে হবে।
শহরের মেয়ে নূপুর গ্রামে এসে নড়ো বড়ো পায়ে গ্রামের সাঁকো পার হবার চেষ্টা করে। পথে চলতে চলতে এক দারুণ সুরের গান ভেসে আসে কানে ‘ওহো আলতা আঁকা পায়ে, ছলাত তালে ছন্দ তুলে হাঁটে…’।
সাঁকোর ওপারে বসে বসে দা দিয়ে পায়ের নখ কাটছেন এক বৃদ্ধ। নখ কাটতে কাটতে ফ্লাশব্যাকে হারিয়ে যান তিনি। একদিন এখানেই জমিতে কাজ করতে করতে পচা শামুকে পা কেটে গিয়েছিল তার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। তার স্ত্রী কুলসুম এসে পা ধুয়ে দেয়। তাদের নানা রকম খুনসুটি হয়। এমন সময় সাঁকোর উপর থেকে ‘এই যে’ বলে ডাক দেয় নূপুর। বাস্তবে ফিরে আসে মোতালেব কারিগর ওরফে মোতালেব ওস্তাগার। নূপুরকে হাত ধরে সাঁকো পার করে দেয় কারিগর।
নূপুর বলে সে কারিগরের কাছেই এসেছে। গ্রামের মানুষ যাকে একঘরে করে রেখেছে তার কাছে শহর থেকে একজন নারী কি কাজে আসতে পারে ভাবতে থাকে কারিগর। মোতালেবের হাতে প্রশংসা করে নূপুর। বলে তার হাত সুন্দর নরম, ঠিক নারীদের মতো। আবার ফ্লাশব্যাকে চলে যায় কারিগর। তার স্ত্রী কুলসুমের কথা মনে পড়ে। ফ্লাশব্যাকে দেখা যায় বসে বসে জাল বুনছে কারিগর। পাশে তার স্ত্রী বসে চাল বাছছে। কারিগর গান গাইছে ‘আমার বাড়ি আইসোরে মইশাল বসতে দিবো পিড়া, পান দিমু সুপারি দিমু সারি ধানের চিড়ারে মইশাল আমার বাড়ি এসো।’
কুলসুম উঠে গিয়ে কারিগরের হাত দুটো ধরে বলে, এই হাত দুইখান কার? হাত দুটো নিয়ে নিজের গালে ছোঁয়ায়। আবার কথা বলে ওঠে নূপুর। বলে, কারিগর আমি মনে হয় আপনাকে কোনো দুঃখের স্মৃতি মনে করিয়ে দিলাম। আমি আসলে এটা চাইনি। কারিগর বলে, বয়স হয়েছে এখন দুখেও কান্দন পায় সুখেও কান্দন পায়। কারিগরের পেছনে লেগে থাকে নূপুর। কিন্তু কারিগর আসল কথা কিছুই বলে না। নূপুর ফিরে যায়। বলে আবার আসবে সে। নূপুরের ফেরার পথে গ্রামের কয়েকজন মানুষের সঙ্গে তার দেখা হয়, কথা হয়। মোতালেব কারিগরের এক প্রতিবেশির সঙ্গে দেখা হয়। বোরকা পরা এক যুবতীর সঙ্গে দেখা হয়। সেই নারী বলে ইচ্ছে না থাকলেও তাকে বোরকা পরতে হয়। সামাজ তাকে এ পোশাক চাপিয়ে দিয়েছে। সে এক বছর আগে এসএসসি পাশ করেছে। তাদের ক্লাসে ছিল ৩০ জনের মধ্যে ২৩ জন ছাত্র। এসএসসি পাশ করলেও তার বাবা তাকে কলেজে পড়াতে চায় না। মেয়েটিকে নূপুর বোরকা পরা পরী বলে ডাকে। বোরকাটা ফেলে দিতে বলে তাকে। ভয় পেয়ে যায় সে নারী। বলে সমাজ তাকে ঢেকে থাকা অবস্থায় দেখতে চায়।
এদিকে গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি মোল্লা যায়েদ বিচার ডাকে। গ্রামের হিন্দু মুসলিম সবার ডাক পড়ে সেখানে। কারিগরকে নিয়ে কী নাকি ফতোয়া দেওয়া হবে সেখানে। এমনই ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে এগিয়ে যেতে থাকে সিনেমার কাহিনী। আবারও কারিগরের কাছে নূপুর। কারিগর ঘুরে ফিরে তার স্ত্রীর কথা বলতে থাকে। পুরো সিনেমার একটি বড় অংশ জুড়ে ফুটে উঠেছে কারিগরের পরিবারের গল্প। এ যেন সিনেমার ভেতরে আরও এক সিনেমা। সাদা কালো ফ্লাশব্যাকে ফুটে উঠেছে গ্রামের এক মানব মানবীর অনন্য ভালোবাসার গল্প। যেখানে নারী ও পুরুষের কোনো বিভেদ নেই। আছে শুধু দুটি মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার গল্প। নূপুর কারিগরের কাছে গুলবাহার ওরফে উম্মে কুলসুমের গল্প শুনতে থাকে আর ফাঁকে ফাঁকে কারিগরের জীবনে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া মূল্যবান অভিজ্ঞতার কথাগুলো জানার চেষ্টা করে। বার বার সেই প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে যায় কারিগর। এদিকে নাছোড়বান্দা নূপুরও।
ওম্বিকার মা ইতি রানী নূপুরকে পান দিয়ে যায়। আবারও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে কারিগর। তার স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। কারিগরের মন ভালো করার জন্য গান শোনায় ও নাচ করে নূপুর। সে নাচতে নাচতে গান ধরে। সে বলে এক সময় এক ছেলেকে আমি অনেক ভালবাসতাম। সেই সময় নাচ-গান অনেক কিছু শিখেছিলাম। আপনাকে একটা নাচ দেখাই। তারপর গান শুরু করে ও নাচতে থাকে
উঠান বাঁকা বাঁকা উঠান/ নাচতে জানি না,
নাচতে নেমে এই কথা তো/ আমি মানি না।
নুপুর বলে আপনার মন খারাপ ভালো করার জন্য অনেক পাগলামি করলাম। আপনি আপনার মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা বলবেন না! কারিগর বলে, মুক্তিযুদ্ধের আগেও তো অনেক কথা আছে। আমার যাত্রাপালায় গান করা। গুলবাহারের সঙ্গে পরিচয় বিয়ে। নূপুর বলে, সব শুনবো কিন্তুু আপনি যদি আপনার মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা না শেয়ার করেন; তাহলে আমার চাকরি থাকবে না। টেপ রেকর্ডার বের করে নূপুর। কারিগরের কথা রেকর্ড করতে থাকে। কারিগর বলে, এই যন্ত্রটা বন্ধ করেন এই যন্ত্রটা ভালো লাগে না। অনেকদিন কারিগরের পেছনে লেগে থেকে যে কাহিনীর খোঁজ পায় নূপুর তা শুনলে চমকে যাবে যে কেউ।
এক নজরে কারিগর সিনেমা
সিনেমাটিতে দেখা যায়, ‘একাত্তরে বরিশালের এক গ্রামে পাকবাহিনী হিন্দু নিধন করতে এসেছে। গ্রামের হাজাম (খৎনাকারী) তাদের কাছে গিয়ে বলে, এখানে কোনো হিন্দু নাই। যারা ছিল তাদের মুসলমান করেছে তার বাবা আর সে নিজে। কারিগর এই কথাটা মাথায় পবিত্র কোরআন শরীফ নিয়ে বলে। পাকবাহিনী তার কথা বিশ্বাস করে। গ্রামে সেদিন গণহত্যা না করে ফিরে যায়। একটি জনপদের মানুষ প্রাণে বেঁচে যায় একটি মিথ্যা বলার কারণে। যাওয়ার সময় বলে যায়, তারা যাদের মুসলমান করেছ খৎনা করে, তাদের তালিকা বানাও। কারিগর স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে ঐ গ্রামের এবং আশেপাশের গ্রামের হিন্দুদের তালিকা বানাতে শুরু করে। হিন্দু নামের সঙ্গে নতুন মুসলমান নাম বসাতে থাকে। এর মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। পরে কট্টরপন্থী হিন্দু এবং মুসলমান দু’সম্প্রদায়ের মানুষই কারিগরকে মিথ্যা বলার কারণে একঘরে করে। মুক্তিযুদ্ধের পর অনেক বছর পার হয়ে গেলেও কারিগরের কষ্টের কোনো শেষ হয় না। সে না পায় সরকারের সহযোগিতা না পায় বেসরকারি কোনো সহযোগিতা। সে সবার কাছে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত হয়। অথচ তার কারণে বেঁচে যায় কতগুলো মানুষের প্রাণ।’
যাদের অভিনয়ে কারিগর
সিনেমাটির গল্প, চিত্রনাট্য, ফটোগ্রাফি, সম্পাদনা ও পরিচালনায় ছিলেন আনোয়ার শাহাদাত। সিনেমাটিতে প্রধান প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। তার চরিত্রটির নাম মোতালেব কারিগর। এখানে তার স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুষমা সরকার। সিনেমায় সাদা কালো ফ্ল্যাশব্যাকে জয়ন্ত ও সুষমার রসায়ন সবাইকে মুগ্ধ করে রাখে। রোকেয়া প্রাচী অভিনয় করেছেন নূপুরের চরিত্রে। তিনি একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তার উপর দায়িত্ব আসে একজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিতে হবে তাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই ব্যক্তি ওস্তাগারের কাজ করত। ওস্তাগার অর্থাৎ হাজাম। হাজামের চরিত্রটিতেই অভিনয় করেছেন জয়ন্ত চট্টপাধ্যায়। আরও দেখা যায় মির্জা নামের এক ছেলের প্রেমে পড়েছে নূপুর। এছাড়া রেবেকা, তামান্না, মিস্টার কায়সারসহ বেশকিছু চরিত্র নজর কাড়ে। এছাড়া আরও অন্যান্য চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন হিমা মৃধা, সোমা, রানী সরকার, শফিক রহমান প্রমুখ।
শেষ কথা
কারিগর সিনেমাটি একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা, ভালোবাসার সিনেমা ও সমাজ সচেতনতামূলক সিনেমা। এই সিনেমায় বেশ কিছু মেসেজ আছে। যা মনে নাড়া দিয়ে যায়। নারী পুরুষের মধ্যে বিভেদ দূর করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় আমাদের।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযোদ্ধের সিনেমা