মধুর জয়ে বাংলাদেশ, আশার প্রদীপ জ্বলেছে

সালেক সুফী

ভাগ্য বাংলাদেশকে বঞ্চিত করেনি। বাঁচা মরার ম্যাচে আফগানিস্তানকে বিশাল ব্যাবধানে (৮৯ রান) পরাজিত করে বাংলাদেশ এশিয়া কাপে বড় কিছু অর্জনের স্বপ্নটাকে আবারো জ্বালিয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড গরমে টস জয় করে সঙ্গত কারণে ব্যাটিং নেওয়া বাংলাদেশ নতুনভাবে সাজানো পরিবর্তিত দল নিয়ে ব্যাঘ্র বিক্রমে ব্যাটিং করে বিশাল ৩৩৪/৫ স্কোর করে ম্যাচটির ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেলে। এরপর বোলারদের সুশৃঙ্খল আক্রমণে সম্ভব হয়নি আফগান দলের রানের পেছনে ছুটে ম্যাচ জয় করা।

তাসকিন, শরিফুলদের বোলিং তোপে ২৪৫ রানে গুটিয়ে যাওয়া আফগানিস্তান হেরে গেছে ৮৯ রানে। বলা যায় বাংলাদেশ পৌঁছেছে পরবর্তী গ্রুপ ফোর বিজ্নেস রাউন্ডে।  পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, আফগানিস্তান  গ্রুপের অবশিষ্ট ম্যাচে বড় ব্যাবধানে জয় পেলে শ্রীলংকা ছিটকে পড়বে।  স্বল্প ব্যাবধানে জয় পেলেও আফগানিস্তান কোয়ালিফাই করবে না। আর হেরে গেলে কথাই  নেই। বাংলাদেশ অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেছে।

আহত বাঘের গর্জন নিয়ে বিশাল জয়ে বাংলাদেশ সম্ভাবনার  দুয়ার খুলেছে।  অনেক প্রত্যাশার এশিয়া কাপের প্রথম খেলায় শ্রীলংকার সাথে  কৌশলগত ভুল করে হতাশার পরাজয়ে বাংলাদেশের এশিয়া কাপ স্বপ্ন অংকুরে বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। কাল পাকিস্তানের লাহোরে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচটি ছিল বাংলাদেশের ‘করো না হয় মরো’ লড়াই। করেছে বাংলাদেশ। আহত বাঘের বিক্রম নিয়ে গর্জে উঠে ৮৯ রানের বিশাল জয় নিয়ে এখন অনেকটা নিশ্চিতভাবেই পৌঁছেছে গ্রুপ অফ ফোর মূল রাউন্ডে।

প্রথম ম্যাচ থেকে অনেক শিক্ষা নিয়েছে বাংলাদেশ।  তিনটি পরিবর্তন নিয়ে খেলা বাংলাদেশ দল সম্ভবত বিদ্যমান অবস্থায় সেরা দল নিয়ে খেলেছে। ওপেনার হিসাবে মোহাম্মদ নাঈমের সঙ্গে মেধাবী মেহেদী হাসান মিরাজের প্রমোশন বিচক্ষণতার কাজ হয়েছে। আমরা সব সময় মনে করি পরিশ্রমী এবং প্রতিভাবান মেহেদী মিরাজকে ৭/৮ নম্বরে লেট্ মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করানো ওর চৌকষ মেধার অপচয়।

আফিফ, শামীম এবং হাসান মাহমুদকে সুযোগ দেওয়াও ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত।  প্রথম ম্যাচে টপ অর্ডারে চার বাম হাতি ব্যাটসম্যান খেলানোর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন সঠিক ছিল। সর্বোপরি প্রচণ্ড গরম থাকায় টস জয় বাংলাদেশের জন্য অনেক সহায়ক ছিল।

শুরু থেকেই উজ্জীবিত ব্যাটিং করেছে বাংলাদেশ। শুরুতে নাঈম এবং কিছু পরে মিরাজ ফজল হক ফারুকী এবং মুজিবের বলে  একের পর এক দৃষ্টি নন্দন বাহারি স্ট্রোকস খেলে বড় কিছু অর্জনের আগাম সংকেত দেয়। ১০ম ওভারে মুজিবের ক্যারম বলে ২৮ রান করে ফিরে যায় নাঈম। কিছুক্ষণ পরেই গুলবদন নায়েবের বলে শূন্য রানে তাওহীদ হৃদয় ফিরে গেলে কিছুটা হকচকিয়ে পড়ে বাংলাদেশ।

কিন্তু এই সময়ে উইকেটে আসা নাজমুল হোসেন শান্ত এবং মেহেদী মিরাজের যোগাযোগে গড়ে উঠে বাংলাদেশের ম্যাচ জয়ী জুটি। এই দুই তরুণ তুর্কি আফগানিস্তানের উঁচু মানের স্পিন বোলারদের বিরুদ্ধে চমৎকার ব্যাটিং করে তৃতীয় উইকেটে ১৯৪ রানের বিশাল পার্টনারশীপ গড়ার পর পরিশ্রান্ত মিরাজ অবসর নেয়।  ম্যাচের খোল নলচে পাল্টে দেওয়া মিরাজ ১১৯ বলে সাত চার এবং তিন ছক্কায় ১১২ রান করে বাংলাদেশের স্মরণীয় প্রত্যাবর্তনে অন্যতম মূল ভূমিকা পালন করে।

তুখোড় ফর্মে থাকা নাজমুল শান্ত ১০৫ বল খেলে নয় চার আর দুই ছক্কায় করে ১০৪। শান্ত-মিরাজের যুগল শতক বিশেষত পাকিস্তানের লাহোরের মাটিতে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম গৌরবের মাইল ফলক হয়ে থাকবে। শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে দুই প্রধান ব্যাটিং স্তম্ভ মুশফিক (২৫) এবং সাকিব অপরাজিত ৩২ রান করলে বাংলাদেশের রান দাঁড়ায় ৩৩৪/৫।

প্রচণ্ড গরমে হাঁস ফাঁস করতে থাকা আফগান দল এমন বেধড়ক পিটুনি খেয়ে এলোমেলো হয়ে পড়েছিল বললে ভুল হবে না। ওদের তিন বিশ্ব সেরা স্পিন বোলারদের (রাশিদ খান ০/৬৬, মোহাম্মদ নবি ০/৫০ এবং মুজিব উর রহমান ১/৬২) কার্যকারিতা ভোঁতা করে বাংলাদেশের অর্জন টুর্নামেন্টের বড় দলগুলোর জন্য ছিল সতর্ক  বার্তা।

জবাবে ব্যাটিং করতে এসে আফগানিস্তান শুরুতেই শরিফুলের বলে গুরবাজকে হারিয়ে চাপে পড়ে। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ইব্রাহিম জাদরান, রহমত শাহকে সঙ্গী করে ৭৮ রান জুড়ে দেয়ার পর আঘাত হানে তাসকিন। এর পর জাদরান হাসমাতুল্লাহ প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও তাসকিন, শরিফুলদের পরিমিত এবং পরিশীলিত বোলিং এবং বিশাল টার্গেটের চাপে ভেঙে পড়ে আফগান প্রতিরোধ।

ইব্রাহিম জাদরান (৭৫) এবং হাসমাতুল্লাহ শাহিদী (৫১) রান ছাড়া শেষ দিকে শুধু রাশিদ খান (২৪) রান কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। তাসকিন (৪/৪৪) এবং শরিফুল (৩/৩৬) বোলিং তোপে ২৪৫ রানে শেষ হয় আফগান ইনিংস। ৮৯ রানের বিশাল জয়ে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়।  এই দলটি কয়েক দিন আগে ভুল কৌশলে খেলে শ্রীলংকার কাছে ১৬৬ রানে গুটিয়ে গিয়েছিলো।

কাল সবচেয়ে ভালো লেগেছে পাকিস্তানের মাটিতে  সবুজের পতাকা গৌরবের সঙ্গে উড়তে দেখে। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সংগীতের গর্বিত উচ্চারণে। পারবে তো বাংলাদেশ জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে?

সালেক সুফী: আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিশ্লেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

one × one =