সালেক সুফী
এমনিতেই সংকট পথে থাকা জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টর নিবিড় সেচ মৌসুম ,পবিত্র রমজান মাস এবং আসন্ন গ্রীস্মকাল সামনে রেখে মহাসঙ্কটের পথে ধাবমান হচ্ছে। আতংকিত করছি না কিন্তু জাতীয় স্বার্থে সতর্ক করছি বরাবরের মত। ক্ষমতাচ্যুত সরকার জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টর নিরংকুশ আমলা নিয়ন্ত্রিত করে সরকার সিন্ডিকেটদের দুরভিসন্দির কারণে সেক্টরের মূল কাঠামো এলোমেলো করে ফেলেছিলো। দেশের প্রাকৃতিক জ্বালানি আহরণ আর উন্নয়ন না করে আমদানি জ্বালানি মুখী হয়ে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক ভাবে পঙ্গু আর দেউলিয়া করে ফেলেছিলো।
ঢালাও পরিবর্তন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জ্বালানি সেক্টরে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। হোয়াইট পেপার নামের সাদা হাতির মত প্রতিবেদন প্রকাশ করে জ্বালানী বিদ্যুৎ খাতের ঘোরতর দুর্নীতি আর অপশাসনের স্বরূপ অন্নেষণের ব্যার্থ প্রচেষ্টা নিয়েছে। এখন পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন জ্বালানি মাফিয়া কাউকেই আইনের আওতায় আন্তে পারেনি। অথচ উভয় খাত অতিশীঘ্র তীব্র সংকটে পড়তে যাচ্ছে।
দুর্নীতির মূল কারণ জ্বালানি খাতে সুশাসনের অভাব। প্রধান মন্ত্রী নিজে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকেছেন। ছিল তার একজন বিতর্কিত আমলা উপদেষ্টা। প্রধানমন্ত্রীর মুক্ষ সচিব জ্বালানি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে যথেচ্ছ নাক গলিয়েছে। দুইজন প্রতিমন্ত্রী জ্বালানি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের সীমাহীন দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলে অভিযোগ আছে. সুবিধাবাদী সচিব আর অদক্ষ কর্পোরেশন চেয়ারম্যানরা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেটদের সঙ্গে মিলে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরকে অবাধ দুর্নীতির চারণ ভূমিতে পরিণত করেছিল।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে জ্বালানি বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ আইন ২০১০ বাতিল, অধিকাংশ অস্বচ্ছ চুক্তি বাতিল এবং পূর্ববর্তী সরকার কর্তৃক দুরভিসন্ধিমূলক ভাবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন বাতিল করার মত ভালো কাজ করলেও সেক্টরের আমলা নিয়ন্ত্রণ বহাল রেখে লেজে গোবরে অযথা করে ফেলেছে। বেশ কিছু অতি অত্যাবশ্যকীয় প্রকল্প বাস্তবায়নরত থাকা অযথায় বাতিল করে জ্বালানি সঙ্কট সহসা সমাধান করা অসম্ভব করে ফেলেছে। জ্বালানী বিদ্যুৎ উপদেষ্টা একই সঙ্গে সড়ক ,ব্রীজ ,রেল মন্ত্রণালয়ের বিশাল দায়িত্বে থাকায় তার পক্ষে জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকটের গভীরতা এবং স্বরূপ হয়ত সঠিকভাবে বোঝা সম্ভম হচ্ছে না. ৩১০০০ মেগাওয়াটের বেশি গ্রিড নন গ্রিড বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি সঙ্গট এবং প্রয়োজনীয বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে ধারাবাহিকভাবে ১৫০০০-১৬০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না. বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংকটে অনেক ক্ষুদ্র মাঝারী শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গাছে। বৃহৎ শিল্প কারখানাগুলো ধুঁকছে। রপ্তানী বাণিজ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ায় অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে
সকল গ্রাহকের যখন গ্যাস সরবরাহে নাজুক অবস্থা তখন অবিবেচকের মত জ্বালানি মন্ত্রণালয় পেট্রোবাংলার মাদ্ধমে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে নতুন শিল্প এবং চালু শিপ্লে উৎপাদনে থাকা ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যাবহৃত গ্যাসের মুলা দ্বিগুন করার প্রতাব দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট অংশী জনের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা উচিত কাজটি সময়পোযোগী হয় নি. অথচ আমলা নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের ব্যার্থতার কারণেই বর্তমান জ্বালানি সংকট। আর জ্বালানি সংকটের কারণেই বিদ্যুৎ সংকট। সরকারি প্রতিষ্ঠাগুলোর দেউলিয়া হয়ে পড়া.
কেন সরকার জ্বালানি সেক্টরের প্রতিষ্টানগুলোর মূল সমস্যা সুশাসনের ব্যবস্থা করতে বার্থ হয়েছে। মন্ত্রণালয় ,কর্পোরেশন পর্যায়ে ঢালাও পরিবর্তন করা হলেও আমলাদের হাতেই মূল চাবিকাঠি রয়েছে। অনেকটা পুরনো বোতলে নতুন মদের মতোই হয়েছে জ্বালানি ক্ষেত্রের সংস্কার।
দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন আশংখাজনক ভাবে কমছে.বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র ( প্রায় ৫০% উৎপাদন করেছে) . উৎপাদনে ভাটির টান. ফ্রুট উৎপাদন কোন গেলে কোন বিকল্প নেই.আগামী ৩-৫ বছরে নিজেদের উৎপাদন উল্লেখজনক ভাবে বৃদ্ধির কোন সুযোগ নেই. ভোলা গ্যাস ক্ষেতের গ্যাস জাতীয় গ্রীডে সঞ্চালন বিষয়ে সরকার দ্বিধাগ্রস্ত। তৃতীয় ভাসমান টার্মিনাল স্থাপন চুক্তি অগ্রবর্তী অবস্থায় বাতিল হওয়ায় ২০২৮ ,২০২৯র আগে নতুন এলএনজি আমদানির সুযোগ নাই. এলএনজি আমদানির বেশ কয়েকটি কার্যক্রম বাতিল হয়ে গাছে। এই সরকার অন্যানোদের মতোই নিজেদের কোলিয়া আহরণে সাহসী ভূমিকা নিতে পারছে না. জ্বালানী উপদেষ্টার কিছু বক্তব্য থেকে সেক্টরের সংকট মুক্তির বিষয়ে সুসংবাদ মিলেছে না. এবারের গ্রীস্মকালে ২০০০-৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি কিভাবে মিটানো হবে ভেবে পাচ্ছি না.
আমি বাংলাদেশের জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতের সমস্যা এবং সম্ভাবনা বিষয়ে সম্মক অবগত থাকায় নিম্ন বর্ণিত সুপারিশ করছি
এ. বর্তমান অবস্থায় জ্বালানি সরবরাহ দ্রুত বাড়ানোর কোন সম্ভাবনা নাই বিধায় জ্বালানি বিদ্যুৎ ব্যাবহারে কঠোর কৃচ্ছতা অবলম্বন করতে হবে. সরকারি আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে লাইটিং এবং কুলিং লোড বৃহৎ আকারে কমাতে হবে. ব্যাবসায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ করে সপ্তাহে ৫ দিন দোকান পাট সন্ধ্যা ৭-৯ বন্ধ রাখা যায় কিনা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিয়ে সাধী সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো দিনের আলোয় করতে হবে। সকল প্রকার আলোকসজ্জা পরিহার করতে হবে.
ব. গ্যাস বিতরণ এলাকায় সমন্বিত অভিযান চালিয়ে সিস্টেম লস নামের চুরি শুন্যের পর্যায়ে এনে ১৫০-২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় সম্ভব। প্রয়োজনে গ্যাস চোরদের অপারেশন ডেভিল হান্টের যাওয়াও াণ যেতে পারে।
সি। অবিলম্বে বাপেক্সের রিগগুলো উৎপাদন রত গ্যাস ক্ষেত্রের চিন্নিত কূপগুলোর সংস্কার বা উন্নয়ন কূপে নিয়োজিত করতে হবে। পার্বত্যচট্টগ্রাম এলাকায় জলদি ,পটিয়া ,কাসালং ,সীতাপাহাড় এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান ত্বরান্বিত করতে হবে.
ড. ভোলার গ্যাস গ্রিড সংযুক্তির জন্য অবিল্বমে গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণের জন্য দেশীয় শীর্ষ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণের সুযোগ রেখে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করতে হবে. স্মরণে রাখতে হবে তেঁতুলিয়া ,মেঘনা নদীর তলদেশে পাইপ লাইন নির্মাণের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের নেই. আর দেশীয় গ্যাস পাইপ লাইন ঠিকাদাররা নিজেদের মধ্যে ক্লাব বানিয়ে বিগত সময়ে গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণ বাজেট স্ফীত করেছে।
ই : সরকারকে অবস্যই নিজেদের কয়লা আহরণ এবং উন্নয়ন বিষয়ে বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে. একই সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর কার্যকরী প্রসার ঘটানোর জন্য বাস্তবসম্মত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করে একটি নিদৃস্ট প্রতিষ্ঠানকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশের কিন্তু দ্রুত কার্বন দূষণ কমানোর দায় নেই। ২০৫০ কেন ২০৮০ যেয়ো বিশ্ব নেট জিরো অর্জন করতে পারবে না. উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশকে ফসিল ফুয়েল ব্যবহার অব্যাহত রাখতে হবে. পাশাপাশি যথাযথ প্রণোদনা দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ঘটাতে হবে. জ্বালানি দক্ষতা বহুগুন বাড়াতে হবে. কাজগুলো কিন্তু আমলাদের দিয়ে হবে না.