নাহিন আশরাফ
একজন নারীর নিজের পায়ে দাঁড়ানো অনেক বেশি জরুরি। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না পারলে তাকে নানা রকম বাধার মুখোমুখি হতে হয়। তবে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করতে গেলেও একজন নারীকে অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ একজন নারীর ঘরে ও বাইরে দুদিক সামলাতে হয় এবং পুরো সংসারের দায়িত্বও থাকে তার কাঁধে। আজ জানবো এক সফল নারী উদ্যোক্তার গল্প। যিনি সংসার ও কাজ সবকিছু সামলে নিজের মতো কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছেন।
নাম মিথিলা আফরোজ, ডাকনাম রিতা। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান তিনি। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতে, মোহাম্মদপুর এলাকায় তিনি বেড়ে উঠেছেন এবং স্কুল ও কলেজের গণ্ডি শেষ করেছেন সেখানেই। যখন তিনি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তখন তার বাবা মারা যান। পরিবারে বাবা না থাকলে যেন মাথার উপরের ছাদ সরে যায়। মিথিলা আফরোজের বেলায় তেমনটাই ঘটেছিল। বাবার মৃত্যুর পর শুরু হয় জীবন যুদ্ধ। তবে তার তখন বয়স কম ছিল। তাই পরিবারের পুরো দায়িত্ব চলে যায় মায়ের কাঁধে। বাবার মৃত্যুর পর দেখেছেন মা’কে পরিশ্রম করে পরিবারের হাল ধরে রাখতে। মা রান্না করতে খুব ভালোবাসতেন, একজনের মাধ্যমে রান্নাবান্নাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নেন। এরপর তার মা রান্নার কাজে নেমে পড়েন। বাইরে থেকে অর্ডার আসত। তিনি ঘরে বসে পুরি, সমুচা, মোগলাই, চাইনিজ, বিরিয়ানি সহ বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করতেন।
ঘরোয়া পরিবেশে এমন মজাদার খাবার সকলের কাছে বেশ প্রিয় হয়ে ওঠে। এই কাজের মাধ্যমেই তার মা পরিবারের যাবতীয় খরচ যেমন তার পড়াশোনার খরচ, বাসা ভাড়া, বাজার ইত্যাদি সামলে নিতেন। ধীরে ধীরে মিথিলা বড় হতে থাকে, পরিবারে নানা ধরনের সমস্যার মধ্যেও তার মা তাকে বাবার অভাব বুঝতে দেননি। নিজের হাতে সবকিছু সামলে তার সব চাহিদা পূরণ করেছেন তার মা। মায়ের কাছ থেকে মিথিলা খুব বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ও শিখেছেন কেমন করে যেকোনো পরিস্থিতে নিজেকে শক্ত রাখতে হয়।
মিথিলা লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অনার্সে ভর্তি হন। মা এবং তার দুজনেরই ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। কিন্তু অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে থাকার সময় তার বিয়ে হয়ে যায়। মা, বাবার অভাব বুঝতে না দিলেও মনের মধ্যে আক্ষেপ ছিল বাবা না থাকার, যেকোনো পরিস্থিতে মনে হতো বাবা থাকলে জীবনটা হয়তো আর একটু সহজ হতো। প্রতি মুহূর্তেই তার বাবার কথা মনে পড়তো। মিথিলা বিয়ের পর অনার্স পড়া সম্পন্ন করেন। তিনি ইডেন কলেজে মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে যান। ইচ্ছে ছিল মাস্টার্স শেষ করে চাকরি করে মায়ের দায়িত্ব নেবেন। ছোটবেলা থেকেই মা’কে দেখেছেন সংগ্রাম করতে ও তার জন্য অনেক কষ্ট করতে। তাই তার ইচ্ছে ছিল মা’কে সবটুকু সুখ এনে দিবেন। কিন্তু মাস্টার্সের পর পরই তার গর্ভে সন্তান চলে আসার জন্য আর চাকরির জন্য আবেদন করতে পারেননি। তখন জীবনে কিছুটা হতাশা নেমে আসে। কারণ তার আশেপাশের সকল বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীরা যে যার মতো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে চাকরিতে যোগ দিতে থাকে। গর্ভবতী অবস্থায় তিনি বাসাতেই থাকতেন। সবকিছু মিলিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন। সেই মুহূর্তে মিথিলার মনে হতো হয়তো ছোটবেলা থেকে দেখা স্বপ্নগুলো আর কখনোই পূরণ হবে না।
হতাশাগ্রস্ত দিন পার করতে করতে তার সন্তানের জন্ম হলো। তখন শুরু হলো জীবনের আরেক যুদ্ধ। সন্তান ও সংসার সামলে উঠতে উঠতে কখন যে বয়স ৩০ পার হয়ে গেলো সেদিকে আর খেয়ালই ছিল না। পুরোদমে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বাচ্চাকে নিয়ে, ফলে এবারো তিনি আর চাকরির জন্য চেষ্টা করতে পারলেন না। জীবনের এই পর্যায়ে এসে তার নিজেকে খুব ব্যর্থ মনে হচ্ছিল এবং ধীরে ধীরে তিনি বিষণ্ন হয়ে পড়ছিলেন। সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে ভালোমন্দে তার সংসার জীবন কেটে যাচ্ছিল। তার স্বামীর উপর ছিল অনেক দায়িত্ব। যেহেতু তার স্বামী পরিবারে একমাত্র অর্থ উপার্জনকারী ব্যক্তি তাই মা-বাবা সহ সকলের দায়িত্ব তার স্বামীর কাঁধে চলে আসে। স্বামীর উপার্জন করা অর্থ দিয়ে এতোদিক সামলাতে গিয়ে তাদের বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছিল। ঠিক সে সময় মিথিলার মনে হয়েছিল এখনই তার কিছু একটা করা দরকার। চাকরি করার স্বপ্ন যেহেতু পূরণ হলো না তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মায়ের ফ্রোজেন ফুডের ব্যবসা তিনি শুরু করবেন।
মায়ের ব্যবসাটা কিভাবে আরেকটু বড় করা যায় তা নিয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন। এরপর তিনি কেক বানানোর দুটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কেক বানানো এবং বিক্রি করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে বেশ ভালো পরিমাণের অর্ডার পাওয়া শুরু করলেন। তার বানানো কেক খেয়ে সকলে প্রশংসা করতেন ও তাকে অনেক বেশি উৎসাহ দিতেন। সেই থেকে যাত্রা শুরু হয় ‘মিথি’স কেক’র। দিনরাত পরিশ্রম করে তিনি অর্ডারের কেক তৈরি করতে থাকেন। যেহেতু সংসার ও বাচ্চার দেখাশোনা তার করতে হয় তাই তিনি সবাই ঘুমিয়ে পড়লে রাত জেগে কেক বানাতেন। দিনের বেলায় সংসারের কাজ সামলে কেক বানানোর সময় পেতেন না, তাই রাতেই থাকে সব রান্নাবান্না করতে হতো। তাছাড়া পরিবার তার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সবসময় খেয়াল রাখেন যাতে কাজের চাপে পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে ভুল না হয়ে যায়। এ ব্যবসায় তাকে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় কেক ডেলিভারি দেওয়ার সময়। কারণ কেক অতি সংবেদনশীল। ডেলিভারির সময় কোনো ভুল হলে কেক পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
সাধারণত কেক মানুষ কোনো বিশেষ উপলক্ষ্যে অর্ডার দিয়ে থাকে, যেহেতু মানুষ বিশ্বাস করে কেকের দায়িত্ব তাকে দেয় তাই তিনি চান না সে কেকটি নষ্ট হোক। সেজন্য তিনি নিজেই কেকের ডেলিভারি করে থাকেন, দূরের অর্ডারগুলো তিনি অটো রিকশায় করে দিয়ে আসেন। মাঝে মধ্যে ডেলিভারির সময় তার ছেলেকেও সাথে করে নিয়ে যেতে হয়। এত কষ্টের পরে কাস্টমার যখন কেক পেয়ে সন্তুষ্ট হন এবং তাকে জানান কেক ভালো হয়েছে তখন তিনি তার সকল কষ্ট ভুলে যান ও শান্তি পান। তার পরিবারের সকলে তাকে সহযোগিতা করেন। কিন্তু অনেক সময় নেতিবাচক কথা তিনি অনেকের কাছে শুনেছেন যে পড়ালেখা করেও তিনি কেন এইসব কাজ করেন। মিথিলা কখনোই নেগেটিভ কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের কাজ করে গিয়েছেন। তিনি মনে করেন আজ কাজের মধ্যে আছেন বলে তিনি মানসিকভাবে সুস্থ আছেন। তাই সকল নারীর উচিত নিজের জন্য কিছু করা।
আজকাল অনেকে হোম মেড ফুড ব্যবসার সাথে জড়িত হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে মিথিলা বলেন, এখন হোম মেড কেক ও ফুড জনপ্রিয় হচ্ছে। তাই অনেকেই এ ব্যবসা করার কথা ভেবে থাকে। তবে মনে রাখতে হবে শুধু রান্না পারলেই হবে না সেটা সঠিকভাবে কাস্টমারের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতাও থাকতে হবে। কারণ কেক ও খাবারের মতো সংবেদনশীল জিনিস ঠিকমতো ডেলিভারি দেওয়া অনেক কঠিন কাজ। তাই শুধুমাত্র শখের বসে এ কাজে আসলে হবে না। হোম মেড কেক বা ফুড নিয়ে কাজ করতে চাইলে শুধু রান্নাবান্না জানাই যথেষ্ট না। এ দিকের নেতিবাচক ও ইতিবাচক দুটো দিক নিয়েই ধারণা নিয়ে আসতে হবে। যাতে করে যেকোনো সমস্যা হলে ঘাবড়ে না গিয়ে সহজেই সামলে নেওয়া যেতে পারে। সবদিক ভালো করে জেনেশুনে ও প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে তবেই খাবার সংক্রান্ত ব্যবসার সাথে নিজেকে জড়িত করতে হবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর