মিষ্টি মেয়ে বাঁধন

নীলাঞ্জনা নীলা

অভিনয় ও নানা রকম ক্রিয়েটিভ লুক নিয়ে সবসময়ই আলোচনায় থেকেছেন বাঁধন। অনেকে তো তাকে ‘জামদানি কন্যা’ হিসেবেও জানেন। ৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে লালগালিচায় বাঁধন জামদানি পরে হাঁটার পর থেকে জামদানির সঙ্গে তিনি জড়িয়ে গেছেন। কাজে কিছুদিন বিরতি নেওয়ার পর হঠাৎ করে তিনি নতুন রূপে সকলের সামনে আসেন এবং অসাধারণ কিছু অভিনয় উপহার দেন দর্শকদের। বাঁধন শুধু অভিনয় নয় মানসিক স্বাস্থ্য এবং নানা রকম সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে জড়িত।

বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বরাবরই নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা এবং সকলকে তার গুরুত্বের কথা বোঝানোর চেষ্টা করেন। দীর্ঘ সময় তিনি ব্যক্তিগত জীবনে বিষণ্নতায় ভুগেছেন এবং যুদ্ধ করে তা থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ থাকলে তার জীবন কতটা বিধ্বস্ত হয়ে যেতে পারে তা তিনি খুব ভালো মতোই বোঝেন এবং এর গুরুত্ব সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। অনেক সংগ্রাম, যুদ্ধ করার পর তিনি নিজেকে নতুন করে চিনতে পেরেছেন, নতুন করে ভালবাসতে পেরেছেন।

বাঁধন ২০১০ সালে জানুয়ারি মাসে মাশরুর সিদ্দিকী সনেটকে বিয়ে করেন। কলেজের গণ্ডি শেষ করার পরপরই বাবা-মা’র ইচ্ছাতে বাঁধন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু তিনি কখনো সুখী হতে পারেননি। বিয়ের পর থেকে তার জীবনে নানা ধরনের সমস্যা শুরু হয়। ঠিক তখন থেকেই তার মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া শুরু হয়।

নানা শারীরিক ও পারিবারিক নির্যাতন এবং মানসিক সংকটের কারণে তিনি সে সময় আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। ২০০৬ সালে লাক্স চ্যানেল আই সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।

প্রাক্তন স্বামী মদ্যপ অবস্থায় মারধর করতেন বাঁধনকে। ২০১৭ সালে কন্যা সায়েরার বয়স যখন ৬ বছর, তখন নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঁধন স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। মেয়ের অভিভাবকত্বও দাবি করেন।

২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল আদালতের রায়ে মেয়ের অভিভাবকত্ব পান বাঁধন। তিনি সামাজিকভাবে বিভিন্ন অ্যাক্টিভিজমের সঙ্গে যুক্ত আছেন। নারী অধিকার, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে তিনি সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন। ব্রিটিশ কাউন্সিল আয়োজিত ওয়াও ফেস্টিভালে তিনি নারী অধিকার ও সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তুলে ধরেন। ইউএন উইমেনের সামাজিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তিনি ম্যারিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার বক্তব্য রাখেন।

বাঁধন ঢাকায় বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজে পড়ালেখা করেন এবং ডেন্টাল সার্জারিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বাঁধন মিডিয়া শিল্পের প্রতি গভীরভাবে অনুরাগী ছিলেন। অল্প বয়সে একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। তিনি চৈতা পাগলা, শুভ বিবাহ, চাঁদ ফুল ওমাবোশ, রং এবং হিজিবিজি নাথিং-এর মতো ধারাবাহিক নাটকে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি আরএফএল ফার্নিচার ও কোকোলা নুডলসের বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম নায়িকা হিসেবে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেন ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। বিশ্ব চলচ্চিত্রের মর্যাদাপূর্ণ এ উৎসবের ৭৪তম আসরের ‘আঁ সেত্রাঁ রিগা’ বিভাগে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো অফিসিয়াল সিলেকশনে জায়গা পায় নির্মাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের এ ছবি। বাঁধন অভিনীত রেহানা মরিয়ম নূর (২০২১) চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। তিনি প্রখ্যাত ভারতীয় অভিনেতা টাবু এবং আলী ফজলের সঙ্গে বিশাল ভরদ্বাজের ‘খুফিয়া’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন। অসাধারণ অভিনয়ের জন্য তিনি অনেকবার পুরস্কৃত হন। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বাঁধন অভিনীত ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসে নি’ ওয়েব সিরিজটির জন্য তিনি সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান।

বাঁধন বরাবরই কাজের সংখ্যার চেয়ে মানকে গুরুত্ব দিয়েছেন। খুব কম কাজ করলেও সেখানে তিনি বেশ সাড়া জাগিয়েছেন। স্পষ্টভাষী হিসেবে ও তার বেশ সুনাম রয়েছে। যেকোনো কাজে তিনি নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং কাজ নিয়ে তিনি ভীষণ খুঁতখুঁতে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তার নিজের করা অভিনয় তার পছন্দ না হয় ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি পরিচালক এবং অন্যান্যদের বিরক্ত করতে থাকেন। নিজের কাজ দেখে তিনি বেশিরভাগ সময় সন্তুষ্ট হন না। তার মনে হয় তিনি আরও ভালো করতে পারতেন। বাঁধন দর্শকদের সমালোচনা পছন্দ করেন। কারণ তিনি মনে করেন সমালোচনা তাকে নতুন করে শিখতে সাহায্য করবে। সমালোচনা শুনে বাঁধন কখনোই মন খারাপ করেন না। কারণ তার মনে হয়, একটি কাজের মাধ্যমে সবাইকে সন্তুষ্ট করা বা খুশি করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যেকোনো কাজ শুরুর আগে তিনি চেষ্টা করেন সঠিকভাবে অনুশীলন করতে এবং পরিচালকের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে। সত্যবাদী ও স্পষ্টবাদী হিসেবে বাঁধনের বেশ সুনাম রয়েছে। যেহেতু জীবনের অনেক চড়াই উতরাই পার করে তিনি আজকে প্রতিষ্ঠিত এবং শক্তিশালী হয়েছেন তাই তিনি যেকোনো ধরনের সত্যি কথাই অকপটে বলে দিতে পারেন।

পরপর বাঁধনের বেশ কয়েকটি অভিনয় বেশ প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু তিনি মনে করেন, যখন একটি কাজ সফল হয় তখনই তা সকলের কাছে প্রশংসিত হয়। কিন্তু সেই সফল হওয়ার পেছনে তিনি যে কতবার ব্যর্থ হয়েছেন সেই গল্প অনেকেই জানে না। বাঁধন বরাবরই বিশ্বাস করেন যে ব্যর্থতার পরে সফলতা আসে। তাই ব্যর্থতার সময়ও তিনি ধৈর্য ধরে রাখেন এবং ব্যর্থতা থেকে শেখার চেষ্টা করেন।

বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বলিউডেও তিনি অভিনয়ের মাধ্যমে বেশ প্রশংসিত হয়েছেন। এপার বাংলা ও ওপার বাংলা দু’বাংলাতেই তিনি অভিনয়ের মাধ্যমে সবাইকে মুগ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, সবসময় মিষ্টি কথা বলতে পারি না, অকপটে সত্যি কথা বলে দেই যার কারণে অনেকেই আমাকে পছন্দ করে না। আবার যারা তাকে ভালবাসে একদম মনের গভীর থেকেই তাকে ভালবাসে।

পারিবারিক কোলাহল, মানসিক স্বাস্থ্য, ওজন বৃদ্ধি অনেক কিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি নিজেকে ফিট রেখে নিজেকে দর্শকের সামনে হাজির করেছিলেন। দর্শক যেন দেখা পেয়েছিল নতুন এক আজমিরী হক বাঁধনের। ওজন কমিয়ে ফিট হওয়ার পর বাঁধন আরও ভালো কাজের সুযোগ পেতে থাকেন। বাঁধন মনে করেন, ফিটনেসের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সরাসরি জড়িত। ওজন কমিয়ে ফেললে শুধু যে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় তা নয় মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে। বরাবর তিনি জিম এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কারণ ব্যায়াম করে ওজন কমিয়ে ফেলার পর তার আত্মবিশ্বাস দ্বিগুণ বেড়ে  গেছে এবং বিষণ্নতার মাত্রা কমেছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × 1 =