মুনাফার নয়, মানুষের পক্ষে অবস্থান নিতে হবে কপ৩০-কে: ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক

ঢাকা, ১৩ নভেম্বর ২০২৫ (ইপি ডেস্ক): “এলিট দখল ও জীবাশ্ম জ্বালানির মিথ্যা প্রচার এখন জলবায়ু বাস্তবতার সবচেয়ে বড় বাধা,”— এমন সতর্কবার্তা দিয়েছে আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজের জোট ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (CAN)।

তাদের নতুন প্রতিবেদন “Inequity, Inequality, Inaction” প্রকাশের মাধ্যমে তারা বলেছে, রিও আর্থ সামিটের তিন দশক ও প্যারিস চুক্তির এক দশক পার হলেও সরকারগুলো এখনো “মানুষের চেয়ে মুনাফাকে অগ্রাধিকার” দিচ্ছে— যা জলবায়ু ন্যায়বিচারকে পিছিয়ে দিচ্ছে।

উত্তর ও দক্ষিণের বৈষম্য

প্রতিবেদনটি জানায়, গ্লোবাল নর্থের দেশগুলো এখনো নির্গমন কমানোর প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ এবং নতুন তেল-গ্যাস প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। একই সঙ্গে তারা প্রতিশ্রুত অর্থায়নও দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা এখনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি— বরং এটি বহু দেশকে ঋণের ফাঁদে আটকে রেখেছে।

গ্লোবাল সাউথ তুলনামূলকভাবে তাদের ন্যায্য অংশ পূরণের কাছাকাছি আছে, তবে তারা কার্যকর জলবায়ু পদক্ষেপ নিতে পারছে না অর্থের অভাব ও ঋণের চাপের কারণে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “যদি কপ৩০ সত্যিকারের ন্যায্য সংস্কার না আনে— ঋণ থেকে অনুদানে, মুনাফাকেন্দ্রিক অর্থায়ন থেকে জনস্বার্থকেন্দ্রিক বিনিয়োগে রূপান্তর না ঘটে— তাহলে বৈশ্বিক সহযোগিতা অচল হয়ে পড়বে।”

বাকুর কপ২৯ থেকে বেলেমের প্রত্যাশা

গত বছর আজারবাইজানের বাকুতে কপ২৯-এর ব্যর্থতা জলবায়ু সহযোগিতার প্রতি আস্থা ধ্বংস করেছে বলে উল্লেখ করেছে প্রতিবেদনটি।

গ্লোবাল সাউথ যখন “বাস্তব অর্থে ট্রিলিয়ন ডলারের জনঅর্থায়ন” দাবি করেছিল, তখন তা প্রতিস্থাপিত হয় “প্রতীকী প্রতিশ্রুতি ও ভুয়া হিসাব”-এর মাধ্যমে। ফলে সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলো রয়ে গেছে ঋণ ও বিপর্যয়ের দ্বিগুণ ফাঁদে।

প্রতিবেদন বলছে, বেলেমে কপ৩০ আরেকটি আলোচনা নয়— এটি বিশ্বাস পুনর্গঠন, ন্যায্য অংশ নিশ্চিত করা এবং জলবায়ু উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ।

অভ্যন্তরীণ বৈষম্য ও রাজনৈতিক দখল

প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে যে, দেশের অভ্যন্তরীণ বৈষম্যও জলবায়ু সংকটকে তীব্র করছে। বিশ্বের ধনী শ্রেণি নিজেদের জলবায়ু ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারছে, অথচ পরিবর্তনের খরচ ও ক্ষতির বোঝা পড়ছে কর্মজীবী মানুষ ও জনসেবামূলক খাতে।

এই “এলিট দখল”— বিশেষত জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের প্রভাব— রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিকৃত করছে, ন্যায়বিচারকে দুর্বল করছে ও সহযোগিতাকে ভেঙে দিচ্ছে।

এছাড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সামরিকীকৃত সংঘাতগুলো জলবায়ু তহবিলকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে অস্ত্রের পেছনে— যা শান্তি ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতায় পুনঃনির্দেশ করা প্রয়োজন।

‘ধাপে ধাপে’ পন্থা এখন অচল

প্রতিবেদন বলছে, বর্তমান ব্যর্থতা “অল্প অল্প করে পরিবর্তনের কৌশল”-এর সমাপ্তি ঘটিয়েছে। এখন দরকার একটি নতুন “জলবায়ু বাস্তববাদ”— যা ন্যায়বিচার, সমতা ও দ্রুত রূপান্তরের ভিত্তিতে গঠিত হবে।

প্রতিবেদনটি জোর দিয়ে বলেছে, “জলবায়ু ব্যর্থতা উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাবে নয়— এটি ন্যায়বিচারের অভাবে। কপ৩০-কে প্রমাণ করতে হবে যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ন্যায়বিচার একে অপরের বিপরীত নয়, বরং অবিচ্ছেদ্য।”

কপ৩০-এ যা অর্জন করতে হবে

প্রতিবেদনটি তিনটি মূল ‘ব্রেকথ্রু’ চিহ্নিত করেছে, যা কপ৩০-এর সফলতার জন্য অপরিহার্য:

*ন্যায্য অংশভিত্তিক এনডিসি (Fair-shares NDCs): অর্থায়ন ও জীবাশ্ম জ্বালানি পরিহারের বিষয়ে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি।

*অর্থায়নের সংস্কার (Finance Reset): আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার, যেখানে ঋণ ও সুদভিত্তিক সহায়তার পরিবর্তে থাকবে অনুদান, ঋণ মওকুফ ও বৈশ্বিক করনীতি।

*ন্যায্য রূপান্তর কাঠামো (Just Transition Frameworks): শ্রমিক, নারী, তরুণ ও আদিবাসীদের কেন্দ্র করে গঠিত রূপান্তর পরিকল্পনা, যা প্রগতিশীল করনীতি ও শূন্য-কার্বন অর্থনীতির মাধ্যমে এলিট দখল ভেঙে দেবে এবং সামরিক ব্যয় থেকে শান্তি ও মানব উন্নয়নে সম্পদ পুনঃনির্দেশ করবে।

CAN-এর আহ্বান

ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক তাসনিম এসোপ বলেন, “জলবায়ু উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও জলবায়ু ন্যায়বিচার এক নয়, বরং একত্রে অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু এই দুটিকেই শ্বাসরোধ করে রেখেছে এলিট দখল ও জীবাশ্ম জ্বালানির মিথ্যা প্রচারণা। বেলেমে কপ৩০-কে অবশ্যই এই দখল ভেঙে ফেলতে হবে, ন্যায্য অংশের ভিত্তিতে সহযোগিতা পুনর্গঠন করতে হবে এবং ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে জনগণ ও কমিউনিটিগুলোর হাতে।”

তিনি আরও বলেন, “গ্লোবাল নর্থকে এখনই তাদের সম্পদ-সঞ্চয় বন্ধ করতে হবে এবং জলবায়ু অর্থায়নে ট্রিলিয়ন ডলারের প্রকৃত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে— দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানি পরিহার ও সত্যিকারের সংহতির মাধ্যমে আস্থা পুনর্গঠন করতে হবে।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

thirteen + 19 =