মেঘে ঢাকা তারা ফাহমিদা নবী

মাসুম আওয়াল

লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প/ তারপর হাতছানি অল্প/ চায় চায় উড়তে উড়তে/ মন চায় উড়তে উড়তে।/ টুপটাপ টুপটাপ বৃষ্টি/ চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টি;/ চায় চায় উড়তে উড়তে/ মন চায় উড়তে উড়তে। এখনো সবার মুখে মুখে ঘুরে ফিরে এই গান। গানটি গেয়েছেন সবার প্রিয় শিল্পী ফাহমিদা নবী। জানুয়ারি মাসে পৃথিবীর আলোয় এসেছিলেন তিনি। তার জন্মদিন ঘিরে রঙ বেরঙের এই ছোট্ট আয়োজন। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই মিষ্টি গানের ফেরিওয়ালার কথা। একজন ফাহমিদা নবীকে বলেছিলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’। কেন এমন নামে ডাকা হলো তাকে? আমরা জানবো সেই গল্প। রঙবেরঙ এর পক্ষ থেকে রইলো জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

ডাক নাম নুমা

ফাহমিদা নবী জন্মেছিলেন দিনাজপুর জেলায়। ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ মাহমুদুন্নবীর ঘর আলোকিত করে আসেন তিনি। তার ডাক নাম নুমা। দারুণ এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা তার। অন্যদিকে তার জীবন জুড়ে রয়েছে স্ট্রাগল। শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য এক লড়াকু জীবন পার করতে হয়েছে তাকে।

বাবার সঙ্গে পথচলা শুরু

ফাহমিদা নবীর সংগীতজীবন শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। ফাহমিদা নবী বুঝেছিলেন কিংবদন্তি শিল্পী মাহমুদুন্নবীর কন্যা হিসেবে তার কাছে মানুষের অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু সংগীতজীবনে তার বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রথম মঞ্চে ওঠার পর বাবার মূল্যায়ন। সেদিন বাবার লেখা ও সুরে তিনি গেয়েছিলেন ‘আমি এক পঙ্কিল পদ্ম’ গানটি। ফাহমিদা নবী বলেন, ‘আমি মঞ্চে যখন প্রথম উঠি আমার বাবাই আমার সাথে হারমোনিয়াম বাজিয়েছিলেন। দর্শক শ্রোতাদের চেয়ে আমি বেশি চিন্তা করছিলাম বাবা বাসায় গিয়ে কী বলবেন? কেমন গাইলাম? এই ভয়টা আমার বেশি কাজ করেছিল। প্রথম গাওয়ার সেই অভিজ্ঞতায় বড় পরীক্ষা ছিল বাবার সাথে। শ্রোতারা তো খুশি, মেয়ে গান গাইছে, বাবা বাজাচ্ছে। আর আমার চিন্তা আব্বা কী বলেন! কিন্তু সারা রাস্তা তিনি কিছুই বলেননি। বাসায় এসে বললেন, নুমা তো ভালোই গান গাইল।’

মায়ের উৎসাহে ওস্তাদের কাছে গান শেখা

মেলোডিয়াস, রোমন্টিক গান গাইতে বেশি পছন্দ করেন ফাহমিদা নবী। সফট মেলোডি গানে অনন্য তিনি। ফাহমিদা নবী বলেন, ‘আমার মা-ও খুব ভালো গান গাইতেন। মা-ই আমাকে বলেছিলেন শুধু গান গাইলেই হবে না, শিখতেও হবে। তখন ওস্তাদ আমানুল্লা খানের কাছে আমরা তালিম নিই। বাবাও শেখায় উৎসাহ দিতেন। গান শেখা শুরু করেছিলেন স্কুলে জাতীয় সংগীত দিয়ে। এরপর ছিল নজরুলসংগীত, দেশাত্মবোধকসহ নানা ধরনের সংগীত শেখার পালা। টেলিভিশনে প্রথম গাইলাম কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা লাকী আখন্দর সুরে একটি গান। সেই সময় অনেক মৌলিক গান তৈরি হতো। গীতিকার, সুরকার আর শিল্পী সব মিলিয়ে ছিল একটা টিম ওয়ার্ক।’

ফাহমিদা নবীর যতো গান

তিন যুগেরও অধিক সময় ধরে সাফল্যের সাথে গান গেয়ে যাচ্ছেন। তিনি উপমহাদেশীয় আধুনিক এবং ক্ল্যাসিকাল গান করেন। এছাড়া তিনি রবীন্দ্রসংগীত এবং নজরুলসংগীত গেয়েও মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। ২০১১ সালে তিনি সেলিম আল দীনের লেখা ১০টি গান নিয়ে অ্যালবাম প্রকাশ করেন। যার নাম ‘আকাশ ও সমুদ্র অপার’। বাপ্পা মজুমদারের সাথে যৌথভাবে তিনি ২০০৬ সালে বের করেন অ্যালবাম ‘এক মুঠো গান ১’। ২০১০ সালের ভালবাসা দিবসে প্রকাশ হয় তার দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘এক মুঠো গান ২’। এছাড়া ‘দুপুরের একলা পাখি’, ‘মনে কি পড়ে না’, ‘আমার বেলা যে যায়’, ‘আকাশ ও সমুদ্র ওপার’, ‘স্বপ্ন গল্প’, ‘চারটা দেয়াল হঠাৎ খেয়াল’, ‘পরস্পর’, ‘ফড়িং’, ‘তুমি কি সেই তুমি’, ‘এক চাঁদ ভালোবাসা’, ‘নিছক স্বপ্ন’, ‘সেলিব্রেটিং লাইফ ১, ২, ৩ এবং ‘আমি আকাশ’সহ বেশকিছু অ্যালবাম রয়েছে তার।

এক যুগ গাইতে পারেননি ফাহমিদা

ফাহমিদা নবী হাসি মুখে থাকেন সব সময়। টিভিতে বা স্টেজে তাকে গান গাইতে দেখা যায় ছিমছাম সাজে। তার হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে সীমাহীন কষ্টগুলো। গান ছাড়া যিনি কিছুই ভাবতে পারতেন না, সেই মানুষটিই বিয়ের পর নতুন পরিবারের চাপে ১২ বছর গান করতে পারেননি। এসব গল্প হয়তো অনেকেরই অজানা। ফাহমিদা নবী নিজেই বলেন, ‘আমি গান থেকে দূরে ছিলাম অনেকদিন। এক যুগ গান করতে পারিনি। মানে বিয়ের পর আমাকে গান গাইতে দেওয়া হয়নি। পারিবারিক কারণেই গান থেকে দূরে থাকতে হলো। স্কুলে ১০ বছর শিক্ষকতা করেছি। এক সময় ভেবে নিয়েছিলাম আর গান করা হবে না। আমার বোন সামিনা গান করতো। বাড়িতে সব সময় আড্ডা লেগেই থাকতো। অনেক গানের মানুষরা আসতেন। কিন্তু সবাই জানতেন আমি আর গান করছি না।

সেসময় একদিন সংগীতের মানুষ আজিজুর রহমান আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই মেয়েটা মেঘে ঢাকা তারা। কেন এই কথা বললেন তখন আমি বুঝতে পারিনি। গান গাইতে না পারার একটা কষ্ট তো সব সময় ছিল। আমি বুঝলাম আমার মেয়ে আনমোল আমার এনার্জি। আমি দেখলাম আমাকে কেউ কিছু করে দিবে না। অনেক কিছু করার চেষ্টা করেছি জীবনে। অনেক চাকরি খুঁজেছি। কেউ চাকরি দিতে চাইতো না। পরে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলাম। এরপর একটা গানের দলের সঙ্গে আড্ডা দিতে শুরু করলাম। আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। ইন্ডাস্ট্রিতেও নানা রাজনীতি হয়েছে সব সময়। আসলে ফাহমিদা নবী যে মাপের শিল্পী, গানে নিয়মিত তাকে পেলে হয়তো আরও অনেক ভালো গান তার কাছে পেতাম আমরা।

জীবন বদলানো ‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’

‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’ গানের আবেদন এতটুকু ম্লান হয়নি এখনো। অনেকে মনে করেন এটি ফাহমিদা নবীর গাওয়া শ্রেষ্ঠ গানের একটি। ‘আহা’ সিনেমায় ব্যবহার হয়েছিল গানটি। লিখেছিলেন ওই সিনেমার পরিচালক এনামুল করিম নির্ঝর। সুরকার ছিলেন দেবজ্যোতি মিশ্র। একবার গণমাধ্যমে গানটি সৃষ্টির পেছনের গল্প শুনিয়েছিলেন নির্ঝর। নির্ঝরের কথায়, ছবির কাজে কলকাতায় গেলাম। পরিচয় হয় সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্রর সঙ্গে। কথা হয় সংগীতের নানা বিষয় নিয়ে। এরপর সে রাতেই হুট করে লিখে ফেলি ‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’ গানটি। রুবার একটা লুকোচুরি গল্প আছে, আছে মনের গহীনে দুঃখ। ঠিক সে কথাগুলো পঙক্তির মতো করে লিখেছিলাম। দেবজ্যোতি গানে সুর করেন। নিজেই ডামি ভায়েস দেন। আমি চেয়েছিলাম, দেশের কোনো শিল্পীকে দিয়েই গানটি গাওয়াব। কিন্তু গানটি কে গাইবে, তখনও চূড়ান্ত হয়নি। দেশে ফিরে কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে কথা হয়। তারা আমাকে পরামর্শ দেন, গানটি ফাহমিদা নবীর কণ্ঠে মানাবে। ফাহমিদা নবীর গান শুনলেও তার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। বলতে পারেন, এ গানের সুবাদেই ফাহমিদার সঙ্গে পরিচয়। ফাহমিদাকে দিয়ে গাওয়ানোর প্রস্তুতি নেওয়া হলো। আর্ট অব নয়েজ স্টুডিওতে গিয়ে গাইলেন ফাহমিদা। সংগীত বংশপরম্পরায় তার রক্তে বইছে বলেই কি না জানি না, ফাহমিদা তার গায়কি দিয়ে সেদিন আমাদের মুগ্ধ করলেন। কাহিনীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গানটি গাইতে হবে – এটা ভালোভাবেই জানতেন তিনি। কিন্তু রুবার মনের গহিনের বিষয়টি ফাহমিদা এতো আবেগ দিয়ে ফুটিয়ে তুলবেন তা কল্পনাতেও ছিল না।’

ফাহমিদা নবী বলেন, কোনো অনুষ্ঠানে গেলেই ‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’ গানটা গাইতে হয়। শ্রোতাদের আবদার পূরণ না করলেই নয়। এই গান প্রকাশের পর কতো যে অনুষ্ঠানে গেয়েছি, তার কোনো লেখাজোখা নেই। মজার বিষয় হলো, এতো বছর ধরে গাইছি, তারপরও গানটা আমার কাছে পুরানো মনে হয় না। প্রতিবারই মনে হয়, যেন আনকোরা নতুন গান শোনাচ্ছি।’

গীতিকার ও সুরকার ফাহমিদা নবী

অনেকেই জানেন না ফাহমিদা নবী শুধুই কণ্ঠশিল্পী নন। তিনি একজন গীতিকার ও সুরকারও। তুমি ডাকো আবার যদি কোনদিন/ ভুলে যাবো অভিমান/ আবার ভুলে যাবো/ তুমি ছিলে না আমার একদিন। এই গানটির কথা ও সুর করেছেন ফাহমিদা নবী নিজেই। ১৫টি দেশের গান নিয়ে ‘জীবনের জয়গান’ নামের একটি অ্যালবাম তৈরি করেছিলেন সংগীতশিল্পী ফাহমিদা। এর বিশেষত্ব হলো অ্যালবামটির সবকটি গানের সুরকার ফাহমিদা নবী নিজেই। গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন রফিকুল আলম, ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, বাপ্পা মজুমদার, পান্থ কানাই, পঞ্চম, এলিটা করিম, বর্ণ চক্রবর্তী, ঐশী, তাসফি, আঁচল ও ঋতুরাজ। এর একটি গানের সংগীতায়োজন করেন পঞ্চম, বাকিগুলো সংগীত করেছেন বর্ণ চক্রবর্তী।

বেতারের তালিকাভুক্ত সুরকার

বাংলাদেশ বেতারে একজন তালিকাভুক্ত সুরকার ফাহমিদা নবী। সংগীতশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন তিনি ১৯৭৭ সালে। দীর্ঘ ৪৪ বছর পর ২০২২ সালে সরকারি একই প্রতিষ্ঠানে সুরকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। ফাহমিদা নবী বলেন, ‘আমার বাবা শ্রদ্ধেয় মাহমুদুন্নবী যখন সুর করতেন তখন থেকেই আমার নিজের মধ্যে গানের সুর আসত। এমনি করেই একদিন নিজের লেখা গানেই সুর করে ফেললাম। এখন তো নিয়মিত সুর করছি। অনেক ভালোলাগা এবং গর্বের বিষয়ও বটে যে আমি বাংলাদেশ বেতারে একজন সুরকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছি। এটা সত্যিই আমার জন্য অনেক আনন্দের।’

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফাহমিদা নবী। আধুনিক গানে তিনি শ্রোতাদের বহুবার মুগ্ধ করেছেন। সিনেমার গান গেয়েও তিনি সেরা গায়িকা হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’ গানের জন্য ২০০৭ সালে শ্রেষ্ঠ প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ফাহমিদা নবী। ২০০৮ সালে পান চ্যানেল আই পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড।

পরিবার

দেশবরেণ্য প্রয়াত শিল্পী মাহমুদুন্নবী ও রশিদা চৌধুরী দম্পতির বড় মেয়ে ফাহমিদা নবী। তার বোন সামিনা চৌধুরীও জনপ্রিয় শিল্পী। দুজনে বেড়ে উঠেছেন প্রায় একসঙ্গে এবং দুজনেই মঞ্চে জনপ্রিয়। তার ভাই পঞ্চমও সংগীতের মানুষ। ফাহমিদা নবীর একমাত্র মেয়ের নাম আনমোল। ২০১১ সালে মারা যান আনমোলের বাবা জয়নুল আবেদীন। বর্তমানে আনমোলকে ঘিরেই ফাহমিদা নবীর সুন্দর পৃথিবী।

সবশেষে একটুকুই বলার, মেঘ ফাহমিদা নবীর মতো তারাটিকে বেশিদিন ঢেকে রাখা যায়নি। ঠিকই বিকশিত হয়েছেন তিনি। তার জীবনেরই এই গল্প অনেকের জীবন বদলে দিতে পারে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 − 7 =