সালেক সুফী: তুলনামূলকভাবে অনেক কম সুযোগ এবং পরিচর্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবল, ক্রিকেট অঙ্গনে ক্রমাগত সাফল্য অর্জন করছে। সম্প্রতি হিমালয় কন্যা নেপালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে বিস্মিত করে দাপটের সঙ্গে সাফ ফুটবলের সোনা জয় করেছে সাবিনা-কৃষ্ণা-সানজিদা-রূপনাদের সোনালী দল।
শুধু দাপুটে শিরোপা জয় নয় খেলার কৌশল, দক্ষতা মুগ্ধতা বিস্ময় জাগিয়েছে। যাদের প্রয়াস, নিবেদন এবং উৎসাহে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মেয়েরা বিশাল অর্জন করে ১৭ কোটি দেশবাসীকে আনন্দ জোয়ারে ভাসিয়েছে তাদের সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।
পাশাপাশি বাংলার মেয়েরা ক্রিকেটেও ক্রমউন্নয়ন ধারা অব্যাহত রেখেছে। জ্যোতি-সালমা -রুমানারা বিশ্বকাপ ২০২৩ কোয়ালিফাইং রাউন্ড জিতে কাঙ্ক্ষিত ভাবেই চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাংলার মেয়েরাই কিন্তু সর্বপ্রথম এশিয়া কাপ জয় করেছিল। বিজয়ী ফুটবল আর ক্রিকেট দল যথাযথ প্রণোদনা এবং উন্নত প্রশিক্ষণ সুবিধা পেলে উত্তরোত্তর অনেক সাফল্য বয়ে আনবে হলফ করেই বলতে পারি।
নারীদের সাফল্য সামাজিক ভাবে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রসারিত করবে। ‘আমরাও পারি’ আত্মবিশ্বাস সমাজে নারীদের প্রতি রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়ে জাতির উন্নয়ন প্রয়াসে নারী পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস বেগবান করবে। আরো অধিক সংখ্যায় মেয়েরা খেলাধুলার মতো নির্মল বিনোদনে অনুপ্রাণিত হবে। সুস্থ জাতি গঠনে সামাজিক আন্দোলন বেগবান হবে।
কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের যখন জয় জয়কার পুরুষরা কিন্তু অপেক্ষাকৃত অধিক আর্থিক সুযোগ সুবিধা, অনুশীলন সুযোগ এবং প্রণোদনা পেয়েও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ করতে পারছে না। ক্রিকেটে সব ফরম্যাটে বাংলাদেশের ক্রমাগত ব্যার্থতা ক্রিকেটপ্রেমিকদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি করছে।
দেশ জুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও ফুটবল কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না। ভারতের কথা না হয় বাদ দিলাম , ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, নেপালের বিরুদ্ধে কালেভদ্রে আসছে জয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড বা মধ্যপ্রাচ্যের দলগুলো আমাদের ধরা ছোয়ার বাইরে চলে গাছে।
সীমিত সুযোগে মেয়েরা পারলে ছেলেরা কেন খাবি খাচ্ছে? খেলোয়াড়, কর্মকর্তা খেলার মাঠ, প্রশিক্ষণ, অনুশীলন, দেশব্যাপী সংগঠনগুলোর দুর্বলতা কাকে দায়ী করা যায়? নাকি সমন্বয়ের অভাব পরিকল্পনার অভাব। বিএফএফ বা বিসিবি মেয়েদের সাফল্যে বাহবা পেতে পারে। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে ব্যার্থতার দায় সমভাবে ওদের উপর বর্তায়।
দেখা যায় মেয়ে বা ছেলে কোনো দল কিছু অর্জন করে দেশে ফিরলে বিমানবন্দর বা বিসিবি/বিএফএফ অঙ্গনে কর্মকর্তাদের কৃতিত্ব হাইজ্যাক করার ইঁদুর দৌড় শুরু হয়ে যায়। মনে হয় কৃতিত্ব অর্জনে খেলোয়াড়দের ভূমিকা গৌণ। কর্মকর্তারা ক্রীতদাসের হাসি হাসতে থাকেন। দৃষ্টিকটু বিষয়গুলো পরিহার হলে সবার জন্য মঙ্গল।
নারী ফুটবল দলের সাফল্য ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত প্রান্তরের সেই কলসিন্ধুর স্কুলের অসামান্য প্রতিভাধর কিশোরীদের সাফল্য থেকে সূচিত। কত না গঞ্জনা সয়ে, দারিদ্র্যের কষাঘাত মোকাবিলা করে, বাধা বিঘ্নের অচলায়তন ভেদ করে ওরা এগিয়ে গেছে। এবারের সাফল্যের নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করেছে কলসিন্দুরের সেই দুরন্ত কিশোরীরা। স্কুলের শিক্ষক আর মেয়েদের অভিভাবকরা সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার। ওদের দেখানো পথ ধরে এগিয়ে আসে সাতক্ষিরা, বান্দরবন, রাঙামাটি, কক্সবাজার, রংপুরের কিছু দুরন্ত কিশোরীরা। আজ তাই সাবিনা, কৃষ্ণা, রূপনা, সানজিদাদের বন্দনা দেশ জুড়ে।
অথচ সাধারণ ঘরের এই অদম্য কিশোরীদের সংসারে সচ্ছলতার অভাব। প্রশংসা করতেই হয় অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ওদের ক্রমবিকশিত হওয়া এবং ধাপে ধাপে এগিয়ে বিশাল অর্জনের দুয়ার খুলে দেওয়াকে। আমি মেয়েদের দলটিকে ঘিরে পরিকল্পনা, বিদগ্ধ প্রশিক্ষক ছোটনের নিবেদিত প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। যে প্রক্রিয়ায় মেয়ে ফুটবলারদের সাফল্য এসেছে একই ভাবে ছেলেদের ক্ষেত্রে বিশেষত বয়সভিত্তিক তরুণদের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হলে ছেলেদের ফুটবল কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভ না করার কারণ দেখি না। ঢালাও সমালোচনা না করে ফুটবলের শুভাকাঙ্ক্ষিদের বাফুফেকে পরামর্শ, সহায়তা দিয়ে নারী পুরুষের ফুটবল সাফল্যের প্রয়াসকে বেগবান করতে আহবান জানাবো।
মেয়েরা অবশ্যই অনুশীলনের জন্য পৃথক আন্তর্জাতিক মানের মাঠ, আধুনিক জিমনেসিয়াম, সম্মানজনক ভাতা , বিভাগীয় শহরগুলো সহ কলসিন্দুর, সাতক্ষীরা, রাঙামাটি, বান্দরবন, রংপুর এলাকায় মুক্ত পরিবেশে খেলার দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। আমরা যেন মেয়েদের সাফল্য তাৎক্ষণিক উপহার, অভিনন্দন আর কিছু সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির মধ্যে গুলিয়ে না ফেলি।
ধারাবাহিক সাফল্য লাভের জন্য অবশ্যই কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। ঢাকা সহ অন্তত বিভাগীয় সদরদপ্তর গুলোতে নিয়মিত মেয়েদের লীগ ফুটবল, মেয়েদের অফিস লীগ চালু করা যেতে পারে। বসুন্ধরা গ্রূপের মতো কর্পোরেট অফিস গুলোকেও ভূমিকা নিতে হবে। বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট মেয়েদের ফুটবলের সূতিকাগার। এটি যেন আরো সুস্থভাবে প্রতিবছর নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় সেই দিকে নজর দিতে হবে।
আমি আশা করি বিএফএফ বর্তমান মহিলা দল এবং বয়সভিত্তিক দলগুলোকে নিয়মিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দিবে। একই কথা ছেলেদের ক্ষেত্রেও একই ভাবে প্রযোজ্য। দেশ জুড়ে আমি নিজে ফুটবল জনপ্রিয়তার জোয়ার দেখেছি। এই জোয়ার ধরে রাখতে হলে পরিকল্পিত পথে এগুতে হবে। আর সেই প্রচেষ্টায় অবশ্যই সাফল্য আসবে।
ক্রিকেট নিয়ে অনেক কথা হয় লেখা হয়। অনেক ব্যর্থতার পর বাংলাদেশ দল অচিরে আইসিসি টি২০ বিশ্বকাপের কঠিন মিশনে খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাবে। যে দলকে ইউএই দলের সাথে পেতে জয় পেতে লড়তে হয় তাদের নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তুখোড় দলগুলোর বিরুদ্ধে জয়ের আশা করায় ভরসা নেই। তবুও আশা আর প্রত্যাশা থাকবে সাকিব বাহিনী যেন লড়াই করতে পারে। মেয়েদের সাফল্য যেন ওদের বাড়তি অনুপ্রেরণা যোগায়। মেয়েদের দলটিকেও যেন পরিকল্পিত পথে প্রস্তুত করা হয় বিশ্বকাপের জন্য।