সালেক সুফী
প্রথম রাউন্ড আর দ্বিতীয় রাউন্ডে অনেক স্নায়ুক্ষয়ী তুখোড় প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপহার দিয়ে শতাব্দীর সেরা বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২ এখন নাটকের শেষ অংকে। কোয়ার্টার ফাইনালের আট দল নির্ধারিত হয়ে গেছে। ৫টি ইউরোপীয় আর দুটি ল্যাটিন আমেরিকান দলের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে আছে আফ্রিকার বিস্ময় মরক্কো। জায়গা হয়নি চার বারের বিশ্বকাপ জয়ী জার্মানি, আধুনিক ফুটবলের অন্যতম চারণভূমি রিয়েল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার দেশ স্পেনের। ঝরে গেছে ফিফা র্যাংকিংয়ের দ্বিতীয় সেরা দল বেলজিয়াম, শক্তিশালী দল ডেনমার্ক। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন কোয়ার্টার ফাইনালের আট দলের ছয়টি ফিফা শীর্ষ র্যাংকিংয়ে থাকা ১০ দেশের ছয়টি – ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস আর পর্তুগাল। সঙ্গে যোগ করুন ২০১৮ বিশ্বকাপের রানার্স আপ ক্রোয়েশিয়া আর এবারের বিস্ময় আফ্রিকার মরক্কো। দেখুন এতো রমণীয় নাটকীয়তা আর বিস্ময়ের পরেও মেসি, নেইমার, রোনাল্ডো, এমবাপ্পের দলগুলো সেরা আটে টিকে আছে। এশিয়া আফ্রিকার জাপান, কোরিয়া, সৌদি আরব, তিউনিসিয়া, সেনেগাল, ক্যামেরুন কিছু অঘটন ঘটিয়েও চূড়ান্ত লড়াই পর্বের আগেই বিদায় নিয়েছে।
কোয়ার্টার ফাইনালে এখন মুখোমুখি ৫ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল গেলবারের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া, ইউরোপিয়ান ফুটবলের দুই সেরা দল ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড, দুইবারের বিশ্বকাপ জয়ী অন্যতম জনপ্রিয় মেসি ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনা – টোটাল ফুটবলের জননী দেশ যুহান ক্রয়েফের দেশ নেদারল্যান্ডস, সিআর সেভেন খ্যাত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দেশ পর্তুগাল – আফ্রিকান দেশ মরক্কোর। রমণীয় রোমান্টিকতায় টই টম্বুর এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে আগাম কিছু বলা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স-পর্তুগালের হাই ভোল্টেজ সেমি ফাইনাল মঞ্চ হয়তো প্রস্তুত হয়ে আছে। তবে ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, মরক্কো, ক্রোয়েশিয়া পাশার দান পাল্টে দিলেও বিস্মিত হবো না।
এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে নানা গুজব নানা ভাবে ডানা পালা মেলেছিল। মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির দেশ, ক্ষুদ্র অথচ গ্যাস তেল সমৃদ্ধ কাতার কি পারবে ফুটবল বিশ্বকাপের মতো মহাযজ্ঞ সামাল দিতে। কিন্তু মামুলি কিছু সমস্যা ছাড়া ইতিহাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ, খরুচে বিশ্বকাপ এযাবৎ নানা কারণেই ইতিহাসের পাতায় নয়া মাইলফলক স্থাপন করেছে। অত্যাধুনিক কারিগরি সুবিধাদি সমৃদ্ধ আট আটটি স্টেডিয়াম বিশ্ববাসীর অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করেছে। পাশাপাশি এশিয়া আফ্রিকার অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলগুলো ল্যাটিন আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপের সমৃদ্ধ দলগুলোর সঙ্গে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই করে প্রমাণ করেছে বিশ্ব ফুটবলে এখন বড়ো দল ছোট দল বলে কেউ নেই।
যদি কিছু বলতে হয় বলতে হবে চারবারের বিশ্বকাপ জয়ী, বরাবরের শক্তিশালী দল জার্মানির প্রিকোয়ার্টার ফাইনালের আগে থেকে ঝরে পড়ার কথা। জার্মানি, স্পেন, জাপান, কোস্টারিকাকে নিয়ে গড়া গ্রুপ ই সত্যিকার অর্থেই ছিল মৃত্যুকূপ। সেই কূপে ডুবে মরেছে জার্মানি আর স্পেন। আশা জাগিয়েও ঝরে গাছে সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। জাপানের কাছে জার্মানির হেরে যাওয়া এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা অঘটন। সেই যে ছন্দ হারানো সেখান থেকে বেরুতে পারেনি জার্মানি। স্পেনের সঙ্গে ১-১ গোলে পয়েন্ট ভাগাভাগি আর শেষ খেলায় কোস্টারিকাকে ৪-২ গোলে বিপর্যস্ত করেও শাপমোচন হয় নি। গ্রুপ থেকে জাপান, কোরিয়া উৎরে গেছে। একই বিশ্বকাপে জার্মানি আর স্পেনের মতো বিশ্বকাপ জয়ী দুই দেশকে হারিয়ে জাপান বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।
উন্নয়নশীল বিশ্ব এখন ব্রাজিল আর্জেন্টিনা অনুরাগী শিবিরে বিভক্ত। বিশেষত নতুন প্রজন্মের অনেকেই ম্যারাডোনা মেসি ভক্ত যারা পেলে, গারিঞ্চা, রোনালদো, রিভালদো, রিভেলিনদের দেখেনি। সেই আর্জেন্টিনা যখন প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের মরুঝড়ে বিপর্যস্ত তখন নড়েচড়ে উঠেছিল ফুটবল বিশ্ব। বিশেষত ফুটবল বিস্ময় খুদে জাদুগর মেসি ভক্তরা। সেই মেসি অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত আর্জেন্টিনা মেক্সিকো আর পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে যথারীতি পৌঁছে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। উপরন্তু গ্রুপ সেরা হয়ে এড়িয়ে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন উড়তে থাকা ফ্রান্সকে। আমার বর্তমান দেশ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ২-১ জয় পেতে আর্জেন্টিনার অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে।
অপরদিকে ২০২২ বিশ্বকাপে চিরদিনের প্রিয় দল জীবন সায়াহ্নে উপনীত ফুটবল সম্রাট পেলের ব্রাজিলের হেক্সা মিশন সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে সুন্দর শুরু করেও হোঁচট খায় আফ্রিকার অপ্রতিরদ্ধ ক্যামেরুনের কাছে। আঘাত আঘাতে জর্জরিত ব্রাজিল নতুন উদ্দীপনায় জ্বলে উঠে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে। সাম্বা ছন্দে নৃত্য করেই ৪-১ গোলে জয়ী দল এখন দারুন ভাবে প্রস্তুত। হয়তো বিশ্ব মিডিয়ায় পেলের জীবন আশঙ্কার সংবাদ প্রচার ওদের তাতিয়ে দিয়েছে। পুনরায় সুস্থ নেইমারের সঙ্গে আছে নান্দনিক গোল করা রিচার্লিসন, আগামীর বিস্ময় ভিনিসিয়াস জুনিয়র, কাশিমেরু। ৯ জন বিকল্প খেলোয়াড় নিয়ে খেলার ঝুঁকি নিয়েও তিতের কৌশলগত সাফল্য নজর এড়ায়নি। তবুও বলবো ক্যামেরন ব্রাজিলকে হারিয়ে আফ্রিকার দেশের ফুটবল ইতিহাসে নতুন পাতা জুড়ে দিয়েছে।
এর বাইরে আমি অবশ্যই বলবো বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স দলের কথা। পল পগবা, করিম বেঞ্জামার মতো তুখোড় ফুটবলার নানা কারণে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার পরেও গ্রুপ পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক বাধা পেরুতে অসুবিধা হয়নি ওদের। তবে বেঞ্চ শক্তি পরীক্ষা করার কৌশলে ফ্রান্স (০-১) গোলে হেরে যায় ওদেরই একসময়ের উপনিবেশ তিউনিসিয়ার কাছে। তবে দারুণ ফর্মে থাকা কিলিয়ান এমবাপ্পের অনুপ্রেরণায় বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা ৩-১ গোলে পোল্যান্ডকে হারিয়ে পৌঁছে গেছে কোয়ার্টার ফাইনালে। খেলতে হবে আরেক তুখোড় দল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে অনেকেই এবারে ইংল্যান্ড দলকে সম্ভাব্য বিশ্বকাপ জয়ীদের তালিকায় রেখেছেন। প্রথম ম্যাচেই এশিয়ার দেশ ইরানকে ৬-২ গোলে বিপর্যস্ত করে ওরা দারুণ সূচনা করে। যুক্তরাষ্ট্র ভালো খেলে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ০-০ পয়েন্ট ভাগাভাগি করার পর ওরা ৩-০ গোলে বিপর্যস্ত করে প্রতিবেশী ওয়েলস্কে। প্রিকোয়ার্টার ফাইনালে আফ্রিকার সিংহ সেনেগাল বাধা পেরিয়েছে ইংল্যান্ড ছন্দময় ফুটবল খেলে। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে তুখোড় ফর্মে থাকা ফ্রান্সের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে আমি মনে করি। আমার বাজি অবশ্য থাকবে ফ্রান্সের দিকেই।
বর্তমান বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা ইউসোবিওর উত্তরাধিকারী পোল্যান্ড বা টোটাল ফুটবলের জনক নেদারল্যান্ডস কিন্তু বিস্ময়কর হলেও এযাবৎ বিশ্বকাপ জয় করেনি। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স ইংল্যান্ডের বাইরে পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস কোয়ার্টার ফাইনাল বাধা পেরিয়ে সেমি ফাইনাল বা ফাইনালে পৌঁছালে আমি বিস্মিত হবো না। কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে খেলতে হবে দুর্দান্ত আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে। টিউলিপের দেশ নেদারল্যান্ডস ১৯৭০ দশকে টোটাল ফুটবলের জন্ম দিয়েছিলো। সম্ভাবনা আছে আর্জেন্টিনাকে হতবাক করার। কিন্তু এরপর হয়তো ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডকে মোকাবিলা করতে হবে সেমি ফাইনালে। অপরদিকে পর্তুগালকে টুর্নামেন্টে উড়তে থাকা মরোক্কো বাধা পেরিয়ে হয়তো লড়াই করতে হতে পারে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে। দেখা যাক পর্তুগিজ ভাষাভাষী ব্রাজিল মোকাবিলায় কি করতে পারে পর্তুগাল।
স্বাভাবিক পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল, ফ্রান্স-পর্তুগাল সেমি ফাইনাল হতে পারে। হয়তো ব্রাজিল-ফ্রান্স ফাইনাল হতেও পারে। যাহোক আমি ফাইনালে ইউরোপ ল্যাটিন আমেরিকা যুদ্ধ আশা করছি। সুন্দর ফুটবলের জয় হোক।