সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনের ঘটনায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তথা রাজউকের নাম বারবারই আসছে। এটি একদম সুস্পষ্ট হয়েছে যে, এই ভবন তদারকিতে রাজউকের গাফিলতি ছিল এবং এই যে এতগুলো মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হলো তার জন্য রাজউকের বড় দায় আছে। নিশ্চয়ই আরও অন্যান্য সংস্থারও দায় আছে, তবে রাজউকেরই বেশি বলতে হবে। নিশ্চয়ই দায় আছে ভবন মালিকেরও।
এই ভবনটি সম্পর্কে জানা যায়, ২০১১ সালে রাজউক থেকে একটি বেজমেন্টসহ আবাসিক-কাম বাণিজ্যিক আকারে অনুমোদন ছিল। আবাসিক-কাম বাণিজ্যিকের বহু ক্যাটাগরি আছে। এরমধ্যে বেইলি রোডের এই ভবনটি আবাসিক-কাম অফিস স্পেস অনুমোদন ছিল। ২০১৩ সালে ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। পরে দেখা যায়, ভবনে অফিস স্পেসের পরিবর্তে রেস্তোরাঁ পরিচালনা হচ্ছিল। এই রেস্তোরাঁর কারণেই ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বেশিরভাগ রেস্তোরাঁ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে এবং মজুদ করে।
এখন প্রশ্ন হলো আবাসিক-কাম অফিস স্পেসের আনুমতি নিয়ে যে তলায় তলায় এতগুলো রেস্তোরাঁ গড়ে তুলে ব্যবসা করতে থাকল, তখন রাজউক কোথায় ছিল? তাদের তো পরিদর্শন দল আছে, আছে নানা রকম আইন আর বিধি। এখন এতগুলো প্রাণ হারিয়ে যাওয়ার পর রাজউক বলছে এই ভবনে রেস্তোরাঁর অনুমতি ছিল না।
একটা ভবন কি কাজে ব্যবহৃত হবে তার জন্য নির্দিষ্ট অকুপেন্সি সনদ নিতে হয়। কোন কাজে কতটুকু স্পেস ব্যবহার করা হবে সেটা নিশ্চিত করে রাজউক। ঢাকা শহরে যে ভবনগুলোতে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটছে, সেই ভবনগুলো যে অকুপেন্সি অনুমোদন নেওয়া আছে সেভাবে কি ব্যবহৃত হচ্ছে? হচ্ছে না, হচ্ছে একেবারে যা তা ভাবে।
অফিস স্পেসের অনুমোদন থাকার পরও রেস্তোরাঁর ব্যবসা চলছিল, অথচ রাজউক না দেখার ভান করে ছিল। কারণ হলো দুর্নীতি। রাজউকের দুর্নীতি এখন দুষ্কর্মে পরিণত হয়ে সংস্থাটিকে দুষ্কৃতিকারীতে পরিণত করেছে। রাজউক মাঝে মাঝে উচ্ছেদে যায়। কিন্তু অভিযোগ আছে যে, রাজউকে কেবল উচ্ছেদ অভিযানের নামেই চলছে রমরমা ঘুষ বাণিজ্য। নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের এক শ্রেণির অসৎ কর্মকর্তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। নামকাওয়াস্তে উচ্ছেদ অভিযানের নামে ওই কর্মকর্তারা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে গেলেও প্রকৃত অপরাধীরা থাকছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। রাজউকের কাছ থেকে নকশার অনুমোদন নিয়ে ভবন তৈরি হয়। আবার সেই অনুমোদনকারী সংস্থাই ভবন মালিকদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে নকশা জালিয়াতিতে সহায়তা করছে।
বলা হয় রাজউকের নাকি ধুলাবালিও ঘুষ খায়। এখানে আছে হরেক রকম দুর্নীতি। এরমধ্যে মৃত ব্যক্তির নামে প্লট-বাণিজ্য, চেক জালিয়াতি, লটারি জালিয়াতি, প্লট পরিবর্তন, নকশা পরিবর্তন সহ সব অনিয়ম এখানে নৈমত্তিক রুটিনে পরিণত হয়েছে। আর এর মাধ্যমেই চলছে হাজার কোটি টাকার লুটপাট। এই সংস্থার একটি সমন্বিত চক্র একদিকে প্রকাশ্যে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করছে, অন্য দিকে নগরবাসীকে করে রেখেছে জিম্মি। রাজউকের দুর্নীতিবাজ কর্মচারী-কর্মকর্তারা কোটি কোটি টাকা উৎকোচ নিয়ে ঢাকাকে একটি অপরিকল্পিত নগরীতে পরিণত করেছে এবং হাজার হাজার নিয়ম বহির্ভুত ভবন তৈরিতে সহায়তা করেছে। এসব দুর্নীতির কারণেই কখনো ভবনে আগুন লাগছে, কখনো কোনো ভবন হেলে পড়ছে, ধ্বসে পড়ছে।
রাজউকের সামগ্রিক ম্যান্ডেট নিয়েই ভাবতে হবে। রাজউক আর দশটা ব্যক্তিগত রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর মতো প্লট আর ফ্ল্যাটের ব্যবসা করে। বিশেষ করে প্লট বিতরণ আর প্লট পরিবর্তন হলো রাজউকের এক জমজমাট দুর্নীতির ক্ষেত্র। এই বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে রাজউক চত্বরে গড়ে উঠেছে একাধিক দালাল চক্র। রাজউকের বেশিরভাগ কর্মচারী-কর্মকর্তাই প্লট বিতরণ আর পরিবর্তন বাণিজ্যে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। দুর্নীতির আর একটি ক্ষেত্র ভবনের নকশা অনুমোদন। রাজউকের বিধি অনুযায়ী কোনো ইমারতের নকশা অনুমোদনের আগে সেখানে বাধ্যতামূলক ১২ ফুট চওড়া রাস্তা থাকতে হবে, এক্ষেত্রে ইমারত পরিদর্শকরা মোটা উৎকোচ নিয়ে ৮ ফুট রাস্তা কাগজে-কলমে বড় দেখিয়ে ইমারতের নকশা অনুমোদন দিয়েছে। এখন আবার আইন ভাঙার অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে উচ্ছেদ, মামলা এবং জরিমানা করা হচ্ছে। এ ধরনের মামলার সংখ্যা হাজার হাজার।
দুর্নীতি ও রাজউক একাকার এবং সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। চার বছর আগে ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক): সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে তিনি বলেছিলেন, ‘রাজউক গড়ার সময় এর গোড়ায় গলদ ছিল। ফলে প্রতিষ্ঠানটি জনবান্ধব না হয়ে জনবিরোধী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হলেও গরিবের আবাসন নিশ্চিত করতে পারেনি, তারা এখন মুনাফাখোর ব্যবসায়ীর ভূমিকা পালন করছে। দুর্নীতি ও রাজউক একাকার এবং সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
টিআইবির এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজউকে ভবন নির্মাণের ছাড়পত্র, নকশা অনুমোদন ও বাস্তবায়ন সম্পর্কিত সেবা পেতে বিভিন্ন পর্যায়ে একজন ব্যক্তিকে দুই হাজার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা এবং আবাসন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে দুই হাজার থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া প্রকল্প সম্পর্কিত সেবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করেন রাজউকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রাজউকের কর্মকর্তা, দালাল ও সেবাগ্রহীতাদের একাংশের যোগসাজশের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে।
এমনই এক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত প্রতিষ্ঠানের হাতে ঢাকাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রাজউককে বদলাতে হবে। এ প্রতিষ্ঠান যেহেতু প্লট আর ফ্ল্যাটের বাণিজ্য করে তাই তার হাতে রেগুলেটরি ক্ষমতা থাকা একেবারেই যৌক্তিক নয়। আইন ও বিধিমালায় সময়োপযোগী সংস্কার করে আবাসন ও রিয়েল এস্টেটসংক্রান্ত কর্মকাণ্ড রাজউকের কাছ থেকে সরিয়ে ভিন্ন কোনো কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত করা এখন সময়ের দাবি। কেবল পরিকল্পনা ও উন্নয়নমূলক কাজে রাজউককে নিয়োজিত করে রাজউকের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি বৃদ্ধি করা জরুরি।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিন দিন