সালেক সুফী
বিস্মরণের স্মৃতি ঘেরা বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে সর্বাধিক ৩০৬/৮ রান করেও ৫ বারের বিশ্বকাপ জয়ী অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৮ উইকেটের বিশাল ব্যাবধানে হেরেছে টিম টাইগার্স। ১০ জাতির বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে ৭ পরাজয় নিয়ে বাংলাদেশের শেষ অবস্থান ৮ম। স্বস্তির কারণ ২০২৫ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে পারবে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে ক্রিকেটের ব্রাজিল অস্ট্রেলিয়া প্রথম দুই ম্যাচে হেরে বর্ণহীন থাকার পর ৭ ম্যাচ ক্রমান্বয়ে দাপুটে জয় দিয়ে আরো একটি বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম প্রধান দাবিদারে পরিণত। অস্ট্রেলিয়া কাল অনেকটা অনায়াসেই বাংলাদেশের ছুঁড়ে দেয়া ৩০৬/৮ টার্গেটের মোকাবিলায় ৪৪.২ ওভারে ৩০৭/২ করে ৮ উইকেটের বিশাল ব্যাবধানে জয়ী হয়েছে।
কাল মহারাষ্ট্রের পুনে শহরের মহারাষ্ট্র ক্রিকেট এসোসিয়েশন মাঠে টস জয় করে বাংলাদেশকে ব্যাটিং করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বাংলাদেশের চৌকষ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ম্যাচ আনফিট থাকায় দল ছেড়ে বাংলাদেশে। তার প্রতিস্থাপক হিসেবে উড়িয়ে নেওয়া আনামুল হক বিজয় আবারো উপেক্ষিত। কাল একজন পেসার কম খেলিয়ে দলে নেওয়া হয়েছিল দুই স্পিনার নাসুম আহমেদ এবং শেখ মাহেদিকে।
ব্যাটিং সহায়ক সহজ পেস উইকেটে দুরন্ত সূচনা করেছিল বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি তানজিদ তামিম (৩৬) এবং লিটন (৩৬)। রয়ে সয়ে ব্যাটিং করলে ওদের অন্তত একজন আরো বড় ইনিংস খেলতে পারতো। অসহিষ্ণু হয়ে দুইজন আউট হবার পর ভালো ব্যাটিং করছিলো নাজমুল শান্ত (৪৫) এবং তৌহিদ হৃদয় (৭৪) যোগাযোগে ৬৪ রান যোগ হচ্ছিলো বাংলাদেশ হয়তো ৩৪০-৩৫০ করতে পারবে। মতিভ্রম হলো বাংলাদেশ জুটির।
নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির খেসারত নিয়ে রান আউটে কাটা পড়লো শান্ত। বিশ্বকাপে নিজের শেষ ম্যাচে ব্যাটিং করা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ব্যাট হাতে ছিল ফুর ফুরে মেজাজে। ১ চার এবং ৩ ছক্কায় সাজানো ৩২ রানের ইনিংস দেখে রান ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছিলো রিয়াদকে। কিন্তু আবারো হৃদয়ের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউটের ফাঁদে পড়লো রিয়াদ। শেষ হলো পঞ্চ পাণ্ডবের অন্যতম ক্রিকেট বীর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের বিশ্বকাপ ক্রিকেট।
তার অন্যতম বিশ্বস্ত সাথী মুশফিকুর রহিম (২১) রাঙাতে পারলো না নিজের শেষ বিশ্বকাপ। ভালো ব্যাটিং করা তৌহিদ হৃদয় লেজের সারির ব্যাটসম্যানদের সাথী করে বাংলাদেশের ইনিংসটি মঞ্জিলে পৌঁছাতে পারেনি। উইকেট এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় কাল ৩৫০ হতে পারতো। তবুও বাংলাদেশ কাল টুর্নামেন্টে সেরা স্কোর (৩০৬/৮) করে সম্মানজনক টার্গেট গড়ে তুলেছিল। অন্তত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলাটি নিশ্চিত হয়েছিল।
ব্যাটিং, বোলিং, ফিলডিংয়ের মতো রানিং বিটুইন দি উইকেট একটি শিল্প এটি বাংলাদেশ শিখেনি। আরো অনুভব করেনি ম্যাচের কোন পর্যায়ে হাল ছেড়ে দেয় না ক্যাঙ্গারু বাহিনী। মার্নাস লেবুচাঙ্গ কাল তৎপরতার সঙ্গে ভালো খেলতে থাকা শান্ত এবং রিয়াদকে রান আউট করে বাংলাদেশ ইনিংসের ছন্দ পতন ঘটায়। এহেন উইকেটেও এডাম জাম্পা কিপ্টে বোলিং করে (২/৩২) নিয়ন্ত্রণের বাঁধনেই রেখেছিলো বাংলাদেশ ব্যাটিং। লম্বা লেজ নিয়ে বাংলাদেশ ইনিংস পাহাড় চূড়ায় ওঠাতে পারেনি। তওহীদ হৃদয় পারেনি ৭৪ রানের ইনিংসটি শত রানে টেনে নিতে।
অস্ট্রেলিয়া কাল আগের ম্যাচের খুনে ব্যাটিং করা গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে বিশ্রামে রেখেছিল। তবুও টুর্নামেন্টের শেষ সময়ে এসে নিজেদের দারুনভাবে ফিরে পাওয়া অস্ট্রেলিয়া অনেকটা হেসে খেলেই দারুণভাবে ৪৪.২ ওভারে ৩০৭/২ করে ৮ উইকেটের দারুন জয় অর্জন করে। যেভাবে ব্যাটিং করেছে মিচেল মার্শ ( ১৭৭*) , স্টিভ স্মিথ (৬৩*), ডেভিড ওয়ার্নার ( ৫৩) দেখে মনে হয়েছে বাংলাদেশ ৩৫০ রান করলেও হয়তো কাল জয় পেত না।
ট্রাভিস হেড শুরুতেই বিদায় নেওয়ার পর ওয়ার্নার এবং মার্শ ধীরস্থির ভাবেই নিজেদের শেকড় স্থাপন করে। ওদের যোগাযোগে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ১২০ রান যোগ হবার পর ৫৩ রান করে বিদায় নেয় ওয়ার্নার। কাল কিন্তু ভালো বোলিং করার মতো মোটামুটি পর্যাপ্ত পুঁজি পেয়েছিলো বাংলাদেশ। কিন্তু মার্শের খুনে ব্যাটিং (১৩২ বলে ১৭ চার এবং ৯ ছয়ে সাজানো অপরাজিত ১৭৭ রান) এবং পড়ন্ত স্টিভ স্মিথের অপরাজিত ৬৩ বাংলাদেশকে শিক্ষা দেয় বিশ্বমানের ক্রিকেট থেকে কতটা পিছিয়ে এখন বাংলাদেশ।
৯ ম্যাচে ৭ পরাজয় দিয়ে শেষ হয় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ। তবুও শেষ রক্ষা ৮ম স্থানে শেষ করা বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে পারবে। কেন বাংলাদেশ এবারের বিশ্বকাপে অচেনা বিবর্ণ, বিপর্যস্ত তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দায়দায়িত্ব নির্ধারণ অপরিহার্য মনে করি। বলার অপেক্ষা রাখে বাংলাদেশ এই বিশ্বকাপে যা করেছে সেটি বাস্তবতা।
বরাবরের শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া কিন্তু সঠিক সময়ে বিজয় ছন্দ খুঁজে পেয়েছে। এখন থেকে আরো একটি বিশ্বকাপ জয়ে ক্যাঙ্গারু বাহিনী কোমর কষে লড়াই করবে নিশ্চিত করেই বলা যায়।
সালেক সুফী: আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিশ্লেষক