রাশমিকা মান্দানা: ভারতের জাতীয় ক্রাশ

অপরাজিতা জামান

শৈল্পিক সৌন্দর্যের অধিকারী রাশমিকার জন্ম কর্নাটকে। তিনি ১৯৯৬ সালের ৫ এপ্রিল কর্নাটকের কোড়গু জেলার বিরাজপেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সুমন মান্দানা পেশায় একজন ব্যবসায়ী। আর মা মাদান মান্দানা একজন গৃহিণী। শুধু সৌন্দর্যে সেরা নন রাশমিকা; তিনি উচ্চশিক্ষিতও বটে। জন্মস্থান কোড়গুতেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু সেখান থেকেই। কোড়গু পাবলিক স্কুলে পড়ালেখা করেছেন এ অভিনেত্রী। উচ্চশিক্ষার জন্য প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্স করতে রশ্মিকা মাইসুরুর ইনস্টিটিউট অফ কমার্স অ্যান্ড আর্টস-এ ভর্তি হন। এর পর বেঙ্গালুরুর রামাইয়া কলেজ অফ আর্টস সায়েন্স অ্যান্ড কমার্সে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। মনোবিজ্ঞান, ইংরেজি সাহিত্য এবং সাংবাদিকতায় ডিগ্রি অর্জন করেছেন রশ্মিকা।

শোবিজে রাশমিকার বিচরণ ছাত্রাবস্থায়। এর শুরুটা হয়েছিল মডেলিংয়ের মাধ্যমে। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ২০১২ সাল। বছরটি ক্যারিয়ার গঠনের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাশমিকার। সেবার তিনি জিতে নিয়েছিলেন ‘ক্লিন অ্যান্ড ক্লিয়ার ফ্রেশ ফেস অব ইন্ডিয়া’ খেতাব। এই খেতাব তার শোবিজ যাত্রা অনেকটাই সুগম করে দিয়েছিল। এর বছর দুয়েক পর আরও একটি প্রতিযোগিতায় বিজয়ীর মুকুট পরেন তিনি। এটি ছিল ‘লামোডে বেঙ্গালুরু টপ মডেল হান্ট’। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নিজের সেরাটা ধরে রাখেন রাশমিকা। জিতে নেন প্রথম স্থান। এর পরপরই মেলে তার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের টিকিট। টপ মডেল হান্টে রাশমিকাকে দেখেই পছন্দ করেছিলেন তার প্রথম সিনেমা ‘কিরিক পার্টি’ সংশ্লিষ্টরা। তারা রাশমিকার স্থিরচিত্র দেখে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

২০১৬ সালে কিরিক পার্টি ছবিটির মাধ্যমে কন্নড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যারিয়ার শুরু করেন রাশমিকা। ভাগ্যদেবতার যেন বেশ সহানুভূতি ছিল এ অভিনেত্রীর প্রতি। ফলে ডেব্যু ফিল্ম দিয়েই পেক্ষাগৃহে আলোড়ন তোলেন তিনি। চলচ্চিত্রটি ব্যবসাসফল হওয়ার পাশাপাশি একটি বার্তা দিয়ে যায়। বার্তাটি হলো, দক্ষিণের চলচ্চিত্রে রাজ করতে এসেছেন রাশমিকা। ছবিটিতে শুধু দর্শকের ভালোবাসা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়নি নবাগতা রাশমিকাকে। পুরস্কারও পেয়েছিলেন। প্রথম সিনেমা দিয়েই জিতে নিয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বাড়তি অর্জন হিসেবে তিনি আরও জেতেন সাউথ ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। এ ছবি নিয়ে সেসময় নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে রাশ বলেছিলেন, আমি যখন চলচ্চিত্রটির শুটিং করি তখন ১৯ বছরের তরুণী। আমি সত্যিকার জীবনে এ ছবির চরিত্রের মতোই বয়সের তুলনায় অধিক পরিপক্ক। তাই চরিত্রটি কঠিন মনে হয়নি।

এদিকে ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমা সফলতার মুখ দেখার পরের বছর আরও দুটি ছবিতে কাজ করেন তিনি। এই ছবি দুটির নাম ‘চমক’ ও ‘আঞ্জানি পুত্রা’। রোমান্স ও হাস্যরসাত্মক উপাদানে ভরপুর ছিল চমক। অন্যদিকে আঞ্জানি পুত্রা ছিল সম্পূর্ণ অ্যকশনধর্মী সিনেমা। দুটি ছবিতেই রাশমিকার উপস্থিতি মন ভরিয়ে দেয় দর্শকের। চলচ্চিত্র দুটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরপর তিনটি ছবির এই সফলতা এ অভিনেত্রীর পথচলা অনেকটাই সুগম করে দেয়। রাশমিকার ক্যারিয়ারের ঊর্ধ্বগতিতে অভিনয় দক্ষতা ও সৌন্দর্যের পাশাপাশি সৌভাগ্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ক্যরিয়ারের শুরু থেকেই সাফল্য পেয়ে যান তিনি।

২০১৮ সালে এ কন্নড় অভিনেত্রীর তেলেগু সিনেমায় অভিষেক হয়। সম্পূর্ণ ভালোবাসার গল্পে মোড়া ‘চলো’ নামের একটি ছবিতে রাশমিকার বিপরীতে ছিলেন নাগা শৌর্য। এ ছবির সফলতা বলে দেয় তেলেগু ইন্ডাস্ট্রিও রাশমিকার এ আগমনকে ইতিবাচকভাবে দেখেছিল। পরিচালক ভেঙ্কি কুড়ুমুলা নির্মিত এ ছবি রাশমিকার সামনে চলাকে আরও তরান্বিত করে। মান্দানা এরপর অভিনয় করেন ‘গীতা গোবিন্দ’ নামের আরও একটি তেলেগু ভাষার ছবিতে। ছবিটি তার ও তেলেগু সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিন জন্য ছিল অনেকটা আশীর্বাদ স্বরুপ। ছবিটি এতটাই দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করে যে আয় হয় আশাতীত। তেলেগু ইন্ডাস্ট্রির সর্বোচ্চ আয়কারী ছবির তালিকায় যুক্ত হয় গীতা গোবিন্দ’র নাম। একইসঙ্গে ছবিটির নায়িকা হিসেবে রাশমিকাও তেলেগু সিনে দুনিয়ায় সফল অভিনেত্রী হিসেবে নিজের পরিচিতি ও আসন মজবুত করে নেন। কন্নড় ছবিতে পরপর তিনটি ব্যবসাসফল ছবি দিয়ে হ্যাট্রিক করে তেলেগুতে নাম লিখিয়েছিলেন রাশমিকা। এখানেও সাফল্য পান তিনি। পরপর দুটি ছবির পর হাতে নেন ‘দেভদাস’ ছবির কাজ। দেভ ও দাস নামের দুজন ব্যক্তিকে নিয়ে গড়ে ওঠা এ চলচ্চিত্রে পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করেন রাশ। এবারও তিনি মুখ দেখেন সাফল্যের। পরপর তিনটি ছবিতে হ্যট্রিক করে রীতিমতো কাঁপিয়ে দেন তিনি। দেভদাসের পর ‘যাজামনা’ নামের আরও একটি ছবি দিয়ে বছর শেষ করেন রাশমিকা।

২০১৯ এ তিনি খাতা খোলেন ‘ডিয়ার কমরেড’ নামের একটি ছবি দিয়ে। এই চলচ্চিত্রে তার সঙ্গে পর্দা ভাগ করেন দক্ষিণি তারকা বিজয় দেরাকোন্ডা। ভরত কম্মা নির্মিত অ্যাকশন ও রোমান্স দুই উপাদানে ভরপুর ডিয়ার কমরেডে বিজয়-রাশমিকার রসায়ন মুগ্ধ করে দর্শকদের। পাশাপাশি মিষ্টি হাসির রাশমিকা পরিচিত পান ‘দক্ষিণি ক্রাশ’ হিসেবে। সে বছর ‘সারিলেরু নিকেভ্যারু’ ও ‘ভীষ্ম’ নামের আরও দুটি ছবি করেন এই দক্ষিণি ক্রাশ। ১৬৯ মিনিটের মারকাটারি এ ছবিতে রাশমিকা পর্দা ভাগ করেন মহেশ বাবু, তামান্না ভাটিয়াদের সাথে। এ ছবিও বিমুখ করেনি তাকে। ৭৫ কোটি রুপিতে নির্মিত সারিলেরু নিকেভ্যারু ঘরে তুলে নেয় ২৫০ কোটি রুপি। ফলে বিজয় রথ আগের মতোই দুর্বার গতিতে ছুটতে থাকে রাশমিকার। তবে ভীষ্মের ক্ষেত্রে ভাগ্যদেবতা অতটা উদারতা দেখাননি রাশমিকার প্রতি। মাত্র ৩৮ কোটি টাকা আয় নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেই বছর শেষ করতে হয় তাকে।

অনেক ব্যবসাসফল সিনেমায় দ্যুতি ছড়ানো রাশমিকার ক্যারিয়ারে ২০২১ সালটি দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এক, বছরটিতে ‘সুলতান’ সিনেমার মাধ্যমে তামিল চলচ্চিত্রাঙ্গনে নাম লেখান তিনি। দুই, এ বছরই রাশমিকা অভিনীত চলচ্চিত্রের আয় হাজার কোটির ঘরে প্রবেশ করে। সিনেমাটি ছিল ‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’। দক্ষিণি সিনেমা জগতের আলোড়ন তোলা এ ছবিতে অভিনয়ে দেখা যায়নি তাকে। শুধু কয়েক মিনিটের জন্য আইটেম গানে দেখা দিয়েছিলেন। তাতেই হইচই পড়ে গিয়েছিল চারদিকে। পুষ্পা ছবির মাধ্যমে পুরো উপমহাদেশে পরিচিতি পান রাশমিকা। এবার রাশমিকার সৌন্দর্য ও অভিনয় দক্ষতা বলিউড নির্মাতাদের ভাবিয়ে বসে। ততদিনে তিনিও প্রস্তুত আলিয়া-দীপিকাদের সাথে টেক্কা দিতে। বলিউডে তিনি নাম লেখান ‘গুডবয়’ সিনেমার মাধ্যমে। শুরুতেই সহশিল্পী হিসেবে পান বি-টাউনের মহাতারকা অমিতাভ বচ্চনকে। যদিও বক্স অফিসে সাড়া ফেলতে পারেনি ছবিটি। তবে রাশমিকার অভিনয় বেশ প্রশংসিত হয় এতে। এরপর তিনি অভিনয় করেন ‘মিশন মজনু’ নামের একটি সিনেমায়। এতে জুটি বাঁধেন সিদ্ধার্থ মালহোত্রার সঙ্গে।

বর্তমানে রাশমিকার পাইপলাইনে বলিউডের আরও কিছু ছবি রয়েছে। এর একটি ‘অ্যানিমল’। এতে তার সঙ্গে জুটি বাঁধবেন রণবীর কাপুর। এরইমধ্যে ছবিটির পূর্ব প্রস্তুতি সব চুড়ান্ত। শহীদ কাপুরের সঙ্গে আরও একটি ছবিতে জুটি বাধার কথার রাশমিকার। এটি প্রযোজনা করবেন একতা কাপুর। শোনা গেছে, এ ছবিতে দ্বৈত চরিত্রে দেখা যাবে শাহিদকে। তবে এখনও নির্মাতা বা প্রযোজনা সংস্থা থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। কিন্তু ধারনা করা হচ্ছে, জনপ্রিয়তার কথা ভেবে রাশমিকাকেই পছন্দের তালিকায় রাখছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে দক্ষিণেও সমানতালে অভিনয় করছেন রাশমিকা। তবে বেছে বেছে। আগের মতো সব পরিচালককে হ্যাঁ বলতে রাজি নন। নতুন ছবির ক্ষেত্রে একটু বুঝে শুনেই পা ফেলতে চান তিনি। এদিকটা ভাবতে গিয়ে বাঘা বাঘা পরিচালককে ফিরিয়ে দিতেও পিছপা হচ্ছেন না। এমনকি পুষ্পার নির্মাতাকেও ফিরিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। আগের বারের মতো ছবিটির সিকুয়েলেও তাকে আইটেম গানে নাচার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে এবার আর রাজি হননি।

অভিনেতা অভিনেত্রীদের রিয়েল লাইফ সবসময় আলোচনায় থাকে। অনুরাগীরা প্রিয় তারকাদের রিয়েল লাইফ সম্পর্কেও কম আগ্রহী নন। রাশমিকা প্রথম সিনেমা ‘কিরিক পার্টি’ সহশিল্পী রক্ষিত শেঠির সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। দুজন একই ছাদের নিচের বসবাস করতে ২০১৭ সালে সেরেছিলেন বাগদান। তবে শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। এক বছরের মধ্যে সম্পর্ক ভেঙে যায় তাদের। এরপরই রাশমিকার সঙ্গে জড়ায় দক্ষিণি তারকা বিজয় দেবেরাকোন্ডার নাম। তবে সহজে ধরা দিচ্ছিলেন না তারা। শুরুতে একে অপরকে ভালো বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দেন এ জুটি। গত বছর তাদের একসঙ্গে বিমানবন্দরে দেখে গুঞ্জন আরও ডানা মেলে। পরে জানা যায়, একসঙ্গে মালদ্বীপে ছুটিও কাটিয়েছেন তারা। সম্প্রতি বিজয় রাশমিকার পরিবারের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছে। এতে সবার ধারণা, হয়তো বিয়ের বন্দোবস্ত করতেই বসেছিলেন তারা। যদিও এ ব্যপারেও কোনো মন্তব্য করেননি তারা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × 5 =