রেইনকোট এলো যেভাবে

গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত

মূলত বর্ষার দিনে নিজেকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা বর্তমানে অনেকেই রেইনকোট ব্যবহার করে থাকি। কীভাবে আসলো রেইনকোট তা নিয়ে এবারের আয়োজন। দৈনন্দিন জীবনে নানান সমস্যা পোহাতে হয় বৃষ্টির জন্য। শহুরে মানুষের থেকে গ্রামের মানুষের কষ্ট দুর্দশা অত্যধিক। রোজকার দিনের খানিকটা সমাধান ছাতা ও রেইনকোট। আপনি কি জানেন প্রথম কবে রেইনকোট ব্যবহার করা হয়?

রেইনকোর্ট শব্দের প্রতিশব্দ হলো বর্ষাতি। রেইনকোট হলো জলরোধী বা জল-প্রতিরোধী পোশাক যা পরিধান করলে বৃষ্টি থেকে শরীর রক্ষা করা যায়। রেইনকোট মূলত কোমর দৈর্ঘ্যরে লম্বা হাতাসহ পোশাক যা সারা শরীরকে ঢেকে রাখে। প্রায় ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বে ওলমেক নেটিভ আমেরিকান সভ্যতারা রেইনকোট তৈরি করে। তখন ছোট, বড়, মাঝারি আকৃতির বাহারি রঙের রেইনকোট তৈরি করা হয়। হাজার বছর পূর্বে প্রথম আবিষ্কার হওয়া রেইনকোট এখন বৃষ্টির দিনে আমাদের অন্যতম সঙ্গী।

ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যায় প্রায় ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বে ওলমেক নেটিভ আমেরিকান সভ্যতা প্রথম রাবার আবিষ্কার করেছিল। তারা রাবারের সাথে তুলা ও রাবার গাছের রেজন দিয়ে বিশ্বের প্রথম জলরোধী কাপড় তৈরি করেছিল। যা আধুনিক রেইনকোট তৈরিতে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখে। এছাড়া উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের আদিবাসীরাও বোনা সিডার নামক ফাইবার দিয়ে তৈরি জলরোধী পোশাক পরিধান করতো। যা ছিল ঘন, জলরোধী, নরম ও আরামদায়ক। উত্তর আমেরিকা এবং মধ্যপশ্চিমাঞ্চল দেশের মানুষরা উষ্ণ ও শুষ্ক থাকার জন্য জলরোধী কাপড় তৈরি করতো। বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া ব্যবহার করতো তারা সেই পোশাক তৈরি করতে। মেক্সিকোতে খড় দিয়ে তৈরি করা রেইনকোটগুলো দেখতে অনেকটা পাখির পালকের মতো লাগতো। সেই পোষাকগুলোকে ‘চীন দে পালমা ট্রেনজাদা’ বলে ডাকা হতো। এগুলো বৃষ্টি থেকে মানুষকে রক্ষা করতো এবং একই সাথে সূর্যের তাপ থেকেও রক্ষা করতো।

ইউরোপে শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পশম দিয়ে বিশেষ ধরনের পোশাক তৈরি করা হতো, যা রেইনওয়্যার নামে পরিচিত ছিল। তখনকার সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল পশম দিয়ে তৈরি এসব রেইনওয়্যার। মধ্যযুগে এসব রেইনওয়্যারের কদর কমতে শুরু করে। তখন পশমের জায়গায় উল ব্যবহার করা হতো। কারণ উল ভেজা থাকা অবস্থায় পরিধানকারীকে উষ্ণ রাখার জন্য পরিচিত থাকলেও তাদের তৈরি সেই রেইনওয়্যার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এশিয়া মহাদেশের দেশগুলো যেহেতু বেশিরভাগই কৃষিনির্ভর ছিল। তাই তারা প্রাকৃতিকভাবে জলপ্রতিরোধী হিসেবে উদ্ভিদ ফাইবার যেমন খড়ের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই করতো। আর্কটিক মহাসাগরের যেহেতু বৃষ্টিনির্ভর। তাই সেখানকার জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য জলরোধী পোশাকের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। আর্কটিক অঞ্চলের ইনুইট, আলেউটস এবং অন্যান্য অনেক মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে সীল, সামুদ্রিক ওটার, মাছ এবং পাখির চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরিধান করতো। বার্ডস্কিন শার্ট (পালকসহ) বৃষ্টি থেকে চমৎকার সুরক্ষা প্রদান করতো।

যদি জানতে চাই, আধুনিক পরিপূর্ণ রেইনকোট তৈরি করেছিলেন কে; তবে শুরুতেই বলতে হবে স্কটিশ রসায়নবিদ চার্লস ম্যাকিনটোশের কথা। ১৮২৪ সালে চার্লস ম্যাকিনটোশ টারপলিন ফ্যাব্রিকের পেটেন্ট পাওয়ার পর প্রথম আধুনিক জলরোধী রেইনকোট তৈরি করেছিলেন। দুটি কাপড়ের মাঝে ন্যাফথা দিয়ে সেলাই করে তিনি সেটি তৈরি করেছিলেন। যার স্তরগুলো দেখতে হয়েছিল স্যান্ডউইচের মতো। কিন্তু সমস্যা দেখা গেল, কিছুদিন পর কাপড়গুলো অনবরত ভেজার কারণে তা থেকে গন্ধ বের হতো এবং শক্ত হয়ে যেতো। শরীরের প্রাকৃতিক তেল এবং গরম আবহাওয়ার কারণে কাপড়টি খুব একটা খাপ খাওয়াতে পারেনি। যার ফলে অনেক দর্জি তার তৈরি কাপড় দিয়ে রেইনকোট তৈরি করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। এরপরও চার্লস দমে যাননি। নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমে তার নিজস্ব কোম্পানি স্থাপন করেন। অবশেষে ১৮৪৩ সালে তার তৈরি করা রেইনকোটে ‘ভলকানাইজড’ নামক রাবার যোগ করে সমস্যাটির সমাধান করেন। তারপর আর চার্লসকে পেছনে তাকাতে হয়নি। তখনকার সময় ডাক্তারদের কোট থেকে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হতো তার কোম্পানির তৈরি রেইনকোট। ‘স্লিকার’ নামে সম্পূর্ণ রাবার দিয়ে তৈরি শক্ত রেইনকোট পাওয়া যেত তখন। এইসব রেইনকোট সেই সময়ের ফ্যাশন অনুসরণ করেছিল। দীর্ঘ দৈর্ঘ্যরে, আলগা বেল্ট, উচ্চ রোল, পরিবর্তনযোগ্য কলার, বড় পকেট এবং আরামদায়ক করার করার জন্য প্রায়শই নন-রাবারাইজড তুলা বা উলের আস্তরণ দিয়ে সেলাই করা হতো রেইনকোট।

সময়ের পরিক্রমায় রেইনকোটের জনপ্রিয়তা এবং বাণিজ্যিকভাবে এর উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ১৯২০ সালে মাস্টার দর্জি জোহান ক্লেপার বিশেষ এক ধরনের রেইনকোট তৈরি করেন। যা লম্বায় গলা থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত তৈরি করা হতো। যার নাম ছিলো ক্লেপার কোট। যা সেসময় খেলাধুলা থেকে শুরু করে ফ্যাশন এবং নিত্যকার কাজকর্মের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। ক্লেপার কোটটি এতোটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো যে তা জার্মানির ইতিহাসে মাইলফলক স্থাপন করেছিল।

১৯১০ থেকে ১৯২০ এর দশকে, জেঙ্কেস স্পিনিং কোম্পানি টেক্সটাইল ফিনিশিং কারখানায় গ্যাস এবং বাষ্প ফ্যাব্রিক রাবারাইজেশন মাধ্যমে রাবারাইজড জলরোধী কাপড় তৈরি করা হয়েছিল যা নরম, আরও নমনীয় এবং আরও আরামদায়ক ছিল। সম্পূর্ণ রাবার দিয়ে তৈরি শক্ত রেইনকোট পাওয়া যেত সেসময়। এই রেইনকোট সেসময়ের রেইনকোট ফ্যাশনে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। জনপ্রিয় রেইনকোটের রঙ ছিল ট্যান, নেভি ব্লু এবং ধূসর।

বৃষ্টিরোধী হিসেবে পশুর চামড়া বেশ সুপরিচিত ছিল একটা সময়। তবে ১৯৫০ সাল থেকে রেইনকোটে পলিভিনাইল ক্লোরাইড ব্যবহার করে দেখা যায়। বেশ হাল্কা, খরচ কম ও সহজলভ্য হওয়ার কারণে তা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চামড়া বেশ ভারী ও তা পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য এবং উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়া কারণে চামড়ার রেইনকোটের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। ১৯৪০ এবং ১৯৫০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডুপন্ট নাইলন দিয়ে এমন একটি কাপড় তৈরি করা হলো যা ওজনে হালকা এবং জল প্রতিরোধী। যা রেইনওয়্যারের জন্য উপযুক্ত। ১৯৬০ এর দশকের গোড়ার দিকে রেইনকোট উজ্জ্বল, আকর্ষণীয়ভাবে তৈরি করা হতো। যার ফলে সকল শ্রেণির মানুষের কাছে তখনকার সময় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল রেইনকোট।

রেইনকোটের কাজ বৃষ্টি থেকে রক্ষা করা হলেও ফ্যাশনেও এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বাইরে মেঘ করে বৃষ্টি নামলেই আমরা পোশাক নিয়ে উদাসীন হয়ে পড়ি। তখন আর নতুন কিংবা নিজের প্রিয় পোশাক পরে বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে থাকে না। তবে চাইলে রেইনকোট পরেও কিন্তু ফ্যাশন করা সম্ভব। এখন রেইনকোট শুধু বৃষ্টি থেকে রক্ষা করছে তা কিন্তু না। শীতপ্রধান দেশে বরফ থেকেও রক্ষা করছে। বেশ কিছু স্বনামধন্য ফ্যাশন ব্রান্ড নিজস্ব ডিজাইনে রেইনকোট বাজারজাত করছে। এছাড়া বর্তমানে সুরক্ষা স্যুট তৈরি হচ্ছে যা সামরিক ও বৈজ্ঞানিক কাজসহ আরো বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হচ্ছে। তাছাড়া বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে ব্যস্ত রাস্তায় চলাফেরা করা মুশকিল।

মূলত কয়েক ধরনের রেইনকোট বাজারে পাওয়া যার। তার মধ্যে একটি হলো পঞ্চু রেইনকোট। এটি ছেলে মেয়ে সবাই পরিধান করতে পারে। কিছুটা ঢিলেঢালা হয় এই রেইনকোট। ভ্যাপসা গরমে ঝুম বৃষ্টিতে খুব সহজে পরা যেতে পারে পঞ্চু রেইনকোট। এছাড়া আছে সফট মেটালিক রেইনকোট। এই রেইনকোটগুলো খুব উজ্জ্বল রঙের হয়ে থাকে। যেমন গোলাপি, লাল, সবুজ ইত্যাদি। তাই বৃষ্টিস্নাত দিনে এই রেইনকোট মন চনমনে রাখতে পারে। এখন বেশ ট্রেন্ডে আছে স্বচ্ছ রেইনকোট। এটি দেখতে অনেকটা প্লাস্টিকের মতো। তাই আপনি রেইনকোটের নিচে কেমন পোশাক পরেছেন তা সহজেই বোঝা যাবে। বাচ্চাদের কথা মাথায় রেখে অনেক ব্রান্ড বিভিন্ন ডিজাইনের রেইনকোট তৈরি করছে যা শিশুদের নজর কাড়তে সক্ষম। বলতেই হয় সময়ের সাথে সাথে রেইনকোট সিলেকশন ফ্যাশনের একটা অংশ হয়ে উঠেছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

13 + 11 =