শাওনের বহুমুখী প্রতিভা

মৌ সন্ধ্যা

একসঙ্গে অনেক প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন মেহের আফরোজ শাওন। নিজের নানা গুণ দিয়ে দর্শক শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রেখেছেন তিনি। একাধারে তিনি একজন অভিনেত্রী, পরিচালক, গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী। দক্ষতার ছাপ রেখেছেন তার প্রতিটি কাজেই। অভিনেত্রী হিসেবে যখন যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন সেটাই হয়ে উঠেছে সাবলীল। গ্রামীণ চরিত্রগুলোতেও তিনি স্বতস্ফূর্ত পাশাপাশি শহুরে চরিত্রেও ন্যাচারাল সব সময়। পরিচালক হিসেবেও তাকে পাওয়া গেছে। আবার গান গেয়ে এমনকি খালি কণ্ঠে গান গেয়েও তাক লাগিয়ে দিতে পারেন তিনি। নৃত্যশিল্পী হিসেবেও শাওনের অর্জন অনেক। অক্টোবর মাসে জন্মেছিলেন তিনি। গুণী এই মানুষটিকে রঙবেরঙের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে এই নিবেদন।

জামালপুরের সেই মেয়েটি

১৯৮১ সালের ১২ অক্টোবর জামালপুর জেলায় মোহাম্মদ আলী ও তহুরা আলীর ঘর আলোকিত করে পৃথিবীতে আসেন মেহের আফরোজ শাওন। তার মা তহুরা আলী জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য ছিলেন। বলা যায় সোনার চামচ মুখে নিয়েই শাওনের জন্ম। তবে জীবন জুড়ে অনেক গল্প তার। এক জীবনে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা যেমন পেয়েছেন তেমন বাঁকা কথাও শুনতে হয়েছে অনেক। তবে সব কিছু ছাপিয়ে একজন শিল্পী ও মা হিসেবে লড়াকু নারীর ভূমিকাতেই পাওয়া যায় তাকে।

শাওনের ছোটবেলা

অনেকের কাছেই অজানা তার ছোটবেলার গল্প। এক টিভি অনুষ্ঠানে মেহের আফরোজ শাওনের ছোটবেলার গল্প শুনিয়েছিলেন তার মা তহুরা আলী। তার ভাষ্য অনুযায়ি, শাওন ছোটবেলায় ছিলেন ভীষণ শান্ত প্রকৃতির। মায়ের কথার অবাধ্য হতেন না কখনো। মা পূব দিকে তাকিয়ে থাকতে বললে পূব দিকে কিংবা পশ্চিমে তাকাতে বললে পশ্চিমেই তাকিয়ে থাকবেন। পড়ালেখাতেও বেশ মনযোগি ছিলেন। ছোটবেলায় তার বন্ধু সংখ্যাও ছিল কম। তবে শাওন বলেন, মায়ের ঠিক উল্টোটা। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় মাকে খুব জ্বালাতন করতাম।’ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই বেড়ে ওঠা শাওনের। আর তার গুণগুলো নাকি মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া। মা তহুরা আলী প্রফেশনাল শিল্পী ছিলেন না ঠিকই কিন্তু গান-অভিনয় ভীষণ ভালবাসতেন। শাওন বলেন, তার মা’র যেসব ইচ্ছা ছিল সেগুলোই শাওনের মাধ্যমে তিনি পূরণ করতে চেয়েছেন। মায়ের কারণে আজ তিনি শিল্পী হতে পেরেছেন।

শাওনের শিক্ষা জীবন

শাওন পড়ালেখায় বেশ ভালো ছিলেন। ছাত্রী হিসেবেও বেশ মনোযোগী ছিলেন তিনি। শাওনের শিক্ষা জীবনের পুরোটাই কেটেছে ঢাকা শহরে। পড়েছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজে। পরে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক থেকে স্থাপত্য প্রকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেছেন।

অভিনয় জীবন

শাওন ১৯৯৬ সালে হুমায়ূন আহমেদের ‘নক্ষত্রের রাত’ ধারাবাহিক নাটক দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করেন। তার অভিনীত নাটক দর্শক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। শাওন অভিনীত জনপ্রিয় নাটকের সংখ্যাটি বেশ লম্বা। এখনো হুমায়ূন আহমেদের নাটকের জনপ্রিয়তাকে কেউ ছুঁতে পারেনি কেউ। হুমায়ূনের অনেক জনপ্রিয় নাটকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাওন। ১৯৯৯ সালে বিটিভিতে প্রচারিত সুপার হিট ধারাবাহিক নাটক ‘আজ রবিবার’। এ নাটকে তিতলি চরিত্রে অভিনয় করেন শাওন। ১৯৯৯ সালের ‘সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড’। এতে মিতু চরিত্রে অভিনয় করেন শাওন। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘উড়ে যায় বক পক্ষী’র পুষ্প চরিত্রটিও অনন্য। শাওন অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য  ‘চন্দ্র কারিগর‘, ‘স্বর্ণ কলস’, ‘আজ জরির বিয়ে’, ‘নীল তোয়ালে’, ‘যমুনার জল দেখতে কালো’, ‘চৈত্র দিনের গান’,  ‘আমি আজ ভেজাবো চোখ সমুদ্র জলে’, ‘এই বর্ষায়’, ‘ছেলে দেখা’, ‘তিন প্রহর’, ‘পাপ’, ‘পুষ্পকথা’, ‘লেখকের মৃত্যু’, ‘নয়া রিকশা’, ‘কনে দেখা’ প্রভৃতি।

চলচ্চিত্রে শাওন

বেশ কিছু চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন মেহের আফরোজ শাওন। হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ (১৯৯৯) সিনেমায় কুসুম চরিত্রে, ‘দুই দুয়ারী’ (২০০১) সিনেমায় তরু, ‘চন্দ্রকথা’ (২০০৩) সিনেমায় চন্দ্র, ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৪) সিনেমায় আশা লতা ও ‘আমার আছে জল’ (২০০৮) সিনেমায় নিশাদ চরিত্রে অভিনয় করেন শাওন।

পরিচালক শাওন

নির্মাতা হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছেন মেহের আফরোজ শাওন। ২০০৯ সালে ‘নয়া রিকশা’ নামের একটি টিভি নাটক নির্মাণ করেন মেহের আফরোজ শাওন। সে বছর ঈদ-উল-ফিতরে একটি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছিল নাটকটি। ২০১১ নির্মাণ করেন ‘স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ’, ২০১৪ সালে ‘এভারেস্ট জয়’। এরপর ‘অসময়ে চৌধুরী খায়েকুজ্জামান’, ‘বিভ্রম’সহ অনেক নাটকের নির্মাতা তিনি। ২০১৬ সালে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘কৃষ্ণপক্ষ’।

নৃত্যশিল্পী শাওন

শিশুদের জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে নৃত্যশিল্পী হিসেবে শাওন ‘নতুন কুঁড়ি’তে বিজয়ী হন। বিভিন্ন সময় টেলিভিশন চ্যানেলের বিশেষ নাচের অনুষ্ঠানে পাওয়া যেত তাকে।

গায়িকা শাওন

শাওনের গায়িকা পরিচয়টি তার ভক্তদের কাছে খুব প্রিয়। হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম প্রিয় শিল্পী ছিলেন তিনি। শাওনের গান মুগ্ধ হয়ে শুনতেন মিসির আলীর লেখক। শাওন উপহার দিয়েছেন বেশ কিছু শ্রোতাপ্রিয় গান। ২০১৬ সালে সেরা গায়িকা হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

হুমায়ূন ও শাওনের বিয়ে

মেহের আফরোজ শাওন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী। ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে নিজের বিয়ের গল্প বলেছিলেন শাওন। তুলে ধরা হলো গল্পটি। নন্দিত এই অভিনেত্রী বলেছিলেন:  ‘১৩ সংখ্যাটা আমার জন্য সবচেয়ে শুভ। আমার জীবনের প্রিয় মানুষটির জন্ম ১৩ তারিখ। আমাদের বিয়ের তারিখও ১৩ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ হুমায়ূন ভাবলেন, এক দিন আগেই বিয়ে করবেন। ১২ ডিসেম্বর, আমাদের বিয়ের তারিখ।’

২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর হুমায়ূন আহমেদ ও শাওন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের ১৩তম বার্ষিকীতে বিয়ের দিনের কিছু গল্প তিনি তুলে ধরেন। শাওন লিখেছেন, ‘খুব সাদামাটাভাবেই হওয়ার কথা ছিল আমার বিয়েটা। ভেবেছিলাম কোনো রকম একটা শাড়ি পরে তিনবার কবুল বলা আর একটা নীল রঙের কাগজে কয়েকটা সাইন।’ হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ করে শাওন লিখেন, ‘আজ ১২ ডিসেম্বর। ২০০৪ সালের এই দিনে কুসুম (‘শ্রাবণ মেঘের দিনে’ ছবিতে শাওনের চরিত্রের নাম) আর হুমায়ূন নতুন জীবন শুরু করে। কুসুম তার জীবনের সবচেয়ে শুভ ১৩ বছর পার করেছে। কুসুমকে শুভেচ্ছা। কুসুমের হুমায়ূনকে শুভেচ্ছা।’

নিজের বিয়ের আগের দিনের গল্প বলতে গিয়ে শাওন লিখেছেন, “১১ ডিসেম্বর হুমায়ূন আমাকে জোর করে পাঠালেন নিউ মার্কেটে, উদ্দেশ্য একটা হলুদ শাড়ি কিনে আনা, যেন সন্ধ্যায় আমি হলুদ শাড়ি পরে নিজের গায়ে একটু হলুদ মাখি। বললেন, ‘তোমার নিশ্চয়ই বিয়ে নিয়ে, গায়ে হলুদ নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। আমাকে বিয়ে করার কারণে কোনোটাই পূরণ হচ্ছে না। আমি খুবই লজ্জিত। তারপরও আমি চাই, আজ সন্ধ্যায় তুমি হলুদ শাড়ি পরে ফুল দিয়ে সাজবে, নিজের জন্য, তোমার ভবিষ্যৎ সন্তানের জন্য, আমার জন্য। আমরা দুজন মিলে আজ গায়েহলুদ করব।’ আমি একা একা শাড়ি কিনেছি। গাঁদা ফুলের মালা কিনেছি। কী মনে করে একটা লাল পাঞ্জাবিও কিনেছি।”

শাওন আরও লিখেছেন, ‘সন্ধ্যায় নিজে নিজে সেজেছি। বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে আমার চোখ ফেটে পানি চলে আসে। চোখ মুছে খোঁপায়-কানে গাঁদা ফুলের মালা গুঁজেছি। হঠাৎ শুনি দরজায় ধুমধাম শব্দ। দরজা খুলে বেরিয়ে দেখি ডালা কুলো হাতে মাজহার ভাইয়ের স্ত্রী স্বর্ণা ভাবি, পাশে তিন বছরের ছোট্ট অমিয়, একটু দূরে লাল পাঞ্জাবি পরে হুমায়ূন ঠোঁট টিপে হাসছেন। হইহই করে ঘরে ঢুকলেন হুমায়ূনের আরও বন্ধু আর তাঁদের স্ত্রীরা। তাঁরা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যান পাশের রুমে।’

সেদিন যারা এসেছিলেন, তাদের কথা মনে করে শাওন লিখেছেন, ‘চার-পাঁচটা প্রদীপ দিয়ে সাজানো ছোট্ট একটি রুমের পাশ। সেখানে হলুদের কী স্নিগ্ধ ছিমছাম আয়োজন! লেখক মইনুল আহসান সাবের ভাইয়ের স্ত্রী কেয়া ভাবি আর মাজহার (প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম) ভাইয়ের স্ত্রী স্বর্ণা ভাবি আমার আর হুমায়ূনের হাতে রাখি পরালেন। সে কী খুনসুটি! সে কী আহ্লাদ! সে এক অন্য রকম গায়ে হলুদ। আরেক ভাবি নামিরা সব মেয়ের হাতে মেহেদি দিয়ে দেন। আমার আর হুমায়ূনের দুই গাল কাঁচা হলুদে রাঙা।’

শাওনের পরিবার

প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ ও শাওনের দুই সন্তান।  নিষাদ বড় ও নিনিত ছোট। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই না ফেরার দেশে চলে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার পর থেকে শাওন একাই মানুষ করছেন দুই ছেলেকে। একাই পালন করছেন মা ও বাবার ভূমিকা।

লেখক শাওন

হুমায়ূন আহমেদকে কেন্দ্র করে দুইটি বই লিখেছেন শাওন। একটি বইয়ের নাম ‘নদীর নামটি ময়ূরাক্ষী’, অন্যটি ‘কৃষ্ণপক্ষ’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যর ওপর ভিত্তি করে লেখা। নদীর নামটি ময়ূরাক্ষী বইটির উপজীব্য হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের লেখা অসংখ্য জনপ্রিয় গান লেখার পেছনের গল্প।

শাওনের দুইটি বড় স্বপ্ন

দীর্ঘ দিন ক্যান্সারে ভুগেছেন হুমায়ূন আহমেদ। পাশেই ছিলেন শাওন। ‘নিউ ইয়র্কের আকাশে ঝকঝকে রোদ’ নামের একটি বইয়ে শাওনের বিষয়ে অনেক কথা লিখে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ।

মেহের আফরোজ শাওন অনেক বড় দুইটি স্বপ্ন নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। তার মধ্যে একটি হলো নিজের দুই ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা ও অন্যটি হলো হুমায়ূন আহমেদের শেষ ইচ্ছা পূরণ করা। মৃত্যুর আগে একটা ক্যান্সার হাসপাতাল গড়তে চেয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু কাজ শুরু করার আগেই তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। ভালোবাসার মানুষের সেই ইচ্ছা পূরণ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শাওন।

শেষকথা

সব শেষে আবারও রঙবেরঙের পক্ষ থেকে রইলো জন্মদিনের শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন মেহের আফরোজ শাওন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

12 − 6 =