শাকসবজিতে শিশুর অনীহা ও করণীয়

শাকসবজি প্রতিটি মানুষের শরীরের জন্য উপকারী। তারপরও অনেক সময় শিশুরা শাকসবজি খেতে অনীহা প্রকাশ করে থাকে। আজ আমরা তার কারণ অনুসন্ধান ও সমাধান করার চেষ্টা করবো।

শিক্ষা-মনোবিজ্ঞানী হিসেবে আমরা শিশুদের যে কোন আচরণ পরিবর্তনের জন্য ‘বিহেভিয়ার মডিফিকেশন’ নামে একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকি। এ পদ্ধতির আলোকে লেখা নিচের পরামর্শগুলো অনুসরণ করলে শিশুর শাকসবজির প্রতি অনীহাকে ভালোবাসায় রূপান্তর করা যাবে বলে আশা করি।

শিশুরা বাবা-মা বা তার কাছের মানুষদের বিভিন্ন আচরণ অনুকরণ করতে ভালোবাসে। এজন্য শিশুরা বড়দের খাবার নির্বাচন করা দেখে নিজেরা খাবার নির্বাচন করতে শেখে। তাই শিশুকে শাকসবজি খেতে উৎসাহিত করতে সবচেয়ে ভালো পন্থা হলো যখন মা-বাবা বা পরিবারের অন্য সদস্যরা শিশুর সামনে শাকসবজি খাবে ও তা উপভোগ করবে।

শিশুকে শাকসবজি খাওয়ানো শেখাতে উপযুক্ত কাজটি হলো পরিবারের সবাই একসঙ্গে খাবার খাওয়া। যুক্তরাজ্যে একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২ থেকে ৫ বছরের শিশুরা তাদের মা-বাবাকে অনুকরণ করে একই ধরণের সবজি খেয়ে থাকে। ঘরে তৈরি খাবার যেমন তরকারি, স্যুপ, চপ বা সালাদ এসব কিছুতেই সবজির ব্যবহার করা যায়। যখন শিশু দেখবে মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা প্লেটে শাকসবজি নিয়ে খাচ্ছে ও উপভোগ করছে, তখন শিশুও অন্যদের অনুকরণ করে একই কাজ করবে।

অনেক শিশু প্রথমবার কোন একটি সবজি খেয়ে তা পছন্দ নাও করতে পারে। যা খুবই স্বাভাবিক। যদি আপনার শিশু কোন নির্দিষ্ট সবজি অপছন্দ করে, তাহলে পরবর্তীতে শিশুর পছন্দনীয় একটি স্বাস্থ্যকর খাবারের সঙ্গে শিশুকে অল্প পরিমানে কম পছন্দের সবজিটি খেতে দিন। এতে শিশুর বেশির ভাগ মনোযোগ পছন্দের খাবারের প্রতি থাকবে৷ সবজি দেখে শিশু কান্না করবে না, উত্তেজিত হবে না। শিশুকে কম পছন্দের শাকসবজি অল্প পরিমান চেখে দেখতে উৎসাহ দিন।

শিশু যখন শাকসবজি খাবে বা চেখে দেখবে তখন শিশুর প্রশংসা করুন। প্রশংসা শিশুকে আবারও শাকসবজি খেতে উৎসাহিত করবে। দেরিতে প্রশংসা করলে অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না তাকে ঠিক কী কারণে প্রশংসা করা হচ্ছে। শিশুকে নির্দিষ্ট কাজের জন্য নির্দিষ্টভাবে প্রশংসা করলে তা সবচেয়ে ভালো কাজ করে। যেমন, ‘তুমি লাউয়ের তরকারি খাওয়ায় আমি অনেক খুশি হয়েছি’। চেষ্টা করুন খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশংসা করতে।

শাকসবজি না খাওয়ার জন্য শিশুকে শাস্তি প্রদান করলে (বকাঝকা বা মারধর করা) শাকসবজি শিশুর কাছে নেতিবাচক বা অপছন্দের বিষয় হয়ে যায়। যদি শিশু সবজি খেতে অসম্মতি জানায় তাহলে শিশুকে শাস্তি প্রদান করা থেকে বিরত থাকুন। পরবর্তী খাবারের সময় আবারও শিশুকে শাকসবজি খেতে দিন। ২০১৯ সালে মউরিনস্পিল ও অন্যান্য গবেষকেরা যুক্তরাষ্ট্রে একটি সিস্টেমেটিক রিভিউ প্রকাশ করে। এ রিভিউ অনুযায়ী, শিশুকে যে কোন সবজি প্রতিদিন একবার করে ১০ দিন দিলে শিশুটি একসময় সবজিটি খেতে শুরু করে।

খাবার খাওয়াকে শর্ত হিসেবে ব্যবহার করবেন না। যেমন- ‘তুমি যদি করলা খাও, তাহলে আমি তোমাকে কেক খেতে দেবো’। এ ধরনের কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। খাবারকে (শাকসবজি) শর্ত হিসেবে ব্যবহার করলে শিশু স্বাস্থ্যকর খাবারের তুলনায় তুলনামূলক অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি বেশি আগ্রহী হবে৷ এছাড়া শিশু মনে করবে সবজি কম স্বাদের খাবার এবং সবজি খেলে আরও ভালো কোন খাবার পাওয়া যাবে।

অনেক শিশুর কাছে শাকসবজি খাওয়ার জন্য শর্ত হিসেবে কোন ডেজার্ট পেলে তার মনে হতে পারে শাকসবজি খাওয়া এমন একটি কাজ যার জন্য ডেজার্ট পুরস্কার হিসেবে পাওয়া যায়৷ তখন শিশু ডেজার্টকে পুরস্কার হিসেবে পেতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার খাওয়া বাড়িয়ে দিতে পারে (ওভারইটিং)।

শাকসবজি দিয়ে রকমারি নাস্তা বা স্ন্যাকস বানানো সম্ভব। ঘরে অস্বাস্থ্যকর নাস্তা কমিয়ে শাকসবজি দিয়ে বেশি বেশি মজাদার নাস্তা তৈরি করুন। এতে শিশুর ক্ষুধাভাব হলে শিশু শাকসবজির তৈরি নাস্তা খাবে যা শিশুর শাকসবজি খাওয়া বাড়িয়ে দেবে।

শিশুকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন আকার, রং, গঠন এবং স্বাদের শাকসবজি খেতে দিন। ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের শাকসবজি দেখে শিশু খেতে আগ্রহ পাবে। এছাড়া সবসময় মনে রাখতে হবে খাবারের স্বাদ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন অনেক শিশুর কাছে ভাজা সবজি বেশি পছন্দ।

শিশু যে খাবারগুলো পছন্দ করে তা তৈরির সময় সবজি ভিন্নভাবে দিতে পারেন। যেমন শিশু নুডলস খেতে ভালোবাসলে, নুডলসে সবজি মিহি কুচি করে বা বেটে দেওয়া যেতে পারে। এভাবে খাবারে সবজি ব্যবহার করলে শিশু তা খেয়াল করবে না বা বুঝতে পারবে না। তবে এভাবে সবজি দিলে শিশুর সবজি খাওয়া হবে ঠিকই কিন্তু সবজির প্রতি অনীহা কমবে না। তাই শিশুকে এর পাশাপাশি সরাসরি সবজি খেতেও উৎসাহিত করতে হবে৷

শিশুকে শাকসবজি জাতীয় খাবার পরিবেশনের সময় সৃজনশীল হোন।

শিশুকে শাকসবজি খেতে জোর করবেন না। শিশুকে সবজি খেতে দেওয়ার পর, শিশু কতটুকু সবজি খেলো তা দেখার প্রয়োজন নেই। মনে রাখবেন, একজন শিশু নিজে ভালো বুঝতে পারে তার পেটে ক্ষুধা আছে কি নেই, থাকলেও কতটুকু ক্ষুধা আছে।

শিশুকে সবজি রান্নার কাজে অংশগ্রহণ করতে দিলে শিশুরা সবজি খেতে উৎসাহিত হয় ৷ কারণ শিশু মনে করে রান্নাটি সেই করেছে! সবজি কেনার সময় বা রান্না করার পূর্বে শিশু কোন শাক বা সবজি খেতে চায় তা শিশুর কাছে থেকে জেনে নিন। এখানে শিশু নিজের মতামত দেওয়ায় খুশি থাকবে ও খাবারের প্রতি আগ্রহবোধ করবে।

সবজি কাটার সময় শিশু যদি বড় হয় তাকে পাশে রাখুন। শিশু সবজি কুচি করতে বা কাটতে পারলে তাকে সবজি কাটার দায়িত্ব দিন। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই পরিবারের একজন বড় সদস্যকে আশপাশে থাকতে হবে। বড় শিশুকে রান্নার কাজে অংশগ্রহণ করতে দিন। এতে শিশুটির আত্মবিশ্বাস বাড়বে, পাশাপাশি সে নতুন একটি কাজও শিখবে।

শিশুর কোন খাবারে এলার্জি হলে অবশ্যই একজন পুষ্টিবিদ ও শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। সবসময় মনে রাখতে হবে, শিশুকে যথাযথ উৎসাহ দিলে শিশুর শাকসবজি খাওয়া বাড়ে। তাই আসুন সন্তানের পাশে থাকি। তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে বেড়ে ওঠতে সহায়তা করি।

বিডিনিউজ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × three =