শিশুর ওবেসিটি

ময়ূরাক্ষী সেন

দীপা ও সাইফুলের একমাত্র ছেলে জিহান। বয়স ছয় বছর। কিন্তু এ বয়সেই তার ওজন অনেক বেশি। তার সাইজের পোশাক সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ হাঁটলে কিংবা সিঁড়ি বেড়ে উঠতে তার কষ্ট হয়। জিহানের বাইরে খেলাধুলার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই, সে সারাদিন পিসিতে গেইম খেলে। তার পছন্দের খাবার বার্গার। প্রতিদিন স্কুল থেকে বের হয়ে তার প্যাকেটের জুস খেতেই হবে। ঘরে তৈরি কোনো খাবার সে খেতে চায় না। একবার স্কুল থেকে ফেরার পথে জিহানের শ্বাসকষ্ট হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানান অধিক ওজনের কারণে তার এই সমস্যা হচ্ছে।

লীনার বয়স ১৪ বছর। কিছুদিন আগেই তার মাসিক শুরু হয়েছে। কয়েক মাস নিয়মিত মাসিক হবার পর হঠাৎ তার মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। দুই মাস মাসিক বন্ধ থাকার পর আবার মাসিক শুরু হয়। লীনার মাসিক অনিয়মিত হওয়ার পরে তার মা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসক ওজন মেপে দেখেন লীনার ওজন অনেক বেশি। তিনি জানান, অত্যধিক ওজনের কারণে তার হরমোনের কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। হরমোনের সমস্যা দূর করার জন্য তাকে সবার আগে ওজন কমাতে হবে।

লীনা ও জিহানের মতো ঘটনা এখন ঘরে ঘরে। একটা সময় শিশুদের অপুষ্টিজনিত সমস্যা ছিল। কিন্তু এখন সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে ‘ওবেসিটি’ সমস্যা। ওবেসেটির বাংলা অতিস্থুলতা। শরীরে যখন অতিরিক্ত মেদ জমে যায় তখন সে অবস্থাকে ওবেসিটি বলে। যেকোনো বয়সের মানুষ ওবেসিটির শিকার হতে পারে। তবে আজ আমরা জানব কেন শিশুর ওবিসিটি বাড়ছে।

সাধারণত ৩০ এর পর সব মানুষের মেটাবলিজম ধীর হয়ে যায়। ফলে যেকোনো খাবার শক্তিতে রূপান্তরিত হতে সময় লাগে। তাই ৩০ এর পর কিছুটা ওজন বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু একজন শিশুর মেটাবলিজম খুব ভালো থাকে। কিন্তু এরপরেও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে তাদের ওজন।

শিশুদের ওজন বৃদ্ধির কিছু কারণ

জেনেটিকাল

অনেক সময় বাবা-মা কিংবা পরিবারের রক্তের সম্পর্কের কারো ওবিসিটি থাকলে বাচ্চা জন্মের পর থেকে অধিক ওজনের অধিকারী হয়। সেক্ষেত্রে বাচ্চার লাইফস্টাইলের কোনো ভূমিকা থাকে না।

হরমোনের সমস্যা

এটি বেশি লক্ষ্য করা যায় মেয়ে শিশুদের মধ্যে। পিসিওএসে কিংবা আরো কিছু হরমোনজনিত কারণে তাদের ওজন বৃদ্ধি পেতে থাকে। পিসিওএসে ইনসুলিন রেজিস্টেন্স হয়ে যায় ফলে খাবারকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে রক্তের অনেক সময় লাগে। এছাড়া থাইরয়েড, ডায়াবেটিস ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে অল্প বয়সের শিশুরা। শিশুদের ক্ষেত্রে হরমোনাল সমস্যা ধরা পড়তে কিছুটা সময় লাগে। কারণ বাবা-মা অনেক সময় হরমোনাল সমস্যাকে আমলে নেন না। অতিরিক্ত ওজনের কারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে শিশুদের মধ্যে হরমোনাল ইমব্যালেন্স লক্ষ্য করা যায়। হরমোনাল সমস্যা থাকার কারণে শিশুরা বারবার ক্ষুদা অনুভব করতে থাকে, ফলে তাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাবার গ্রহণ করা হয়ে যায়।

জীবনযাত্রা

শিশুদের ওজন বেড়ে যাওয়ার পিছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে তাদের জীবনযাত্রা। শিশুদের খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, পড়ালেখা সবকিছুর মধ্যে চলে এসেছে অনিয়ম। তাছাড়া শিশুরা এখন প্রচুর পরিমাণে জাংক ফুডের প্রতি আসক্ত। বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার এখন খুবই সহজলভ্য। স্কুল গেট থেকে বের হলেই নানারকম মুখরোচর অস্বাস্থ্যকর খাবার তাদের সামনে থাকে।

এখন বেশিরভাগ বাবা-মায়েরা কর্মজীবী হওয়ার কারণে তারা সন্তানকে ঘরে তৈরি খাবারের চেয়ে বাইরের খাবারের উপর নির্ভরশীল করছে। বাইরের খাবারে থাকে অতিরিক্ত তেল ও মসলা যা ওজন বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী। ক্ষুধা নিবারণের জন্য তারা নির্ভর করছে জুস চিপ চকলেটের মতো খাবারের উপর।

খেলাধুলার সুযোগ না থাকা

বাচ্চারা স্কুলে যাওয়া আরম্ভ করলেই তাদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। লেখাপড়ার পাশাপাশি তারা ড্রইং শেখা, গান শেখা, কোচিং ইত্যাদি আরো অনেক কিছুর সাথে যুক্ত হয়ে যায়। দিনের বেশিরভাগ সময় তাদের কোনো না কোনো কাজ করতে হয়, ফলে খেলাধুলার সময় হয়ে ওঠে না। এখন বেশিরভাগ বাড়ির সামনে খেলাধুলা করার কোনো উপযুক্ত জায়গা থাকে না এবং স্কুলেও দেখা যায় মাঠের ব্যবস্থা থাকে না। ফলে অবসরে শিশুদের বিনোদন বলতে থাকে মোবাইল, পিসি এবং টেলিভিশন। দীর্ঘ সময় এক স্থানে বসে টেলিভিশন কিংবা মোবাইল দেখার ফলে তাদের কোনো প্রকার শারীরিক পরিশ্রম হয় না। ফলে তারা যতোটা খাবার গ্রহণ করে ততোটাই মেদে পরিণত হয়ে যায়।

হজমে সমস্যা থাকলে

ওজন বেড়ে যাওয়ার পেছনে ৮০ ভাগ ভূমিকা খাবারের। অন্যান্য অনেক বিষয় থাকলেও খাবারের ভূমিকা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবার অভিযোগ থাকে শিশু কম খাচ্ছে, তারপরও তার ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে দেখা যায় শিশুর হজমে সমস্যা হচ্ছে। খাবার ঠিক মতো হজম না হলে সেই খাবার শক্তিতে পরিণত না হয়ে চর্বি আকারে জমে থাকে। শিশুর হজমের সমস্যা হচ্ছে এই ব্যাপারটা শনাক্ত করতেও পরিবারের কিছুটা সময় লাগে। হজমের সমস্যা জেনেটিক্যাল হলেও এর পিছনে লাইফস্টাইলও দায়ী। প্রতিদিন অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, খেলাধুলা না করা ও ঠিকমতো না ঘুমালে শিশুদের হজমের সমস্যা হতে পারে।

ওবেসিটির জটিলতা

শিশুদের ওবেসিটির ফলে খুব অল্প বয়সেই তারা নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে যায়। ওবেসিটির ফলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। ওজনের ফলে রক্তে সুগারের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া হরমোনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে মাসিকজনিত সমস্যা দেখা দেয়। হরমোনে সমস্যা দেখা দিলে অনেক শিশুর বয়সের আগেই মাসিক হয়ে যায় কিংবা দেরিতে মাসিক হয়। ওজন বেড়ে গেলে শিশুদের শ্বাসকষ্ট হয়। দেখা যায় কিছুক্ষণ খেলাধুলা কিংবা হাঁটাহাঁটি করলে তাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হয় ও সহজে হাঁপিয়ে যায়। এছাড়া শিশুদের কোমর ও জয়েন্টে ব্যথা হয়। অতিরিক্ত ওজনের ফলে শিশুদের হার্টের সমস্যা এবং উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়।

হীনমন্যতা

ওবিস শিশুরা সমাজে বডি শেইমিংয়ের শিকার হয়। বিশেষ করে স্কুলের সহপাঠীরা তাদের নিয়ে হাসি তামাশা করে। ফলে তারা স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। খেলাধুলায় অনেক সময় তাদের নিতে চায় না। ফলে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায় ও হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়। সহপাঠীদের এমন আচরণের ফলে তাদের মধ্যে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়।

পরিবারের করণীয়

শিশুর ওজন নিয়ে সচেতন হতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশের বাবা-মা’রা ওজন কমে গেলে চিন্তিত হলেও ওজন বৃদ্ধি পেলে তেমন চিন্তিত হন না। ওজন হঠাৎ কমে যাওয়া যেমন চিন্তার বিষয় তেমন ওজন বেড়ে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয়। তাই সন্তানের উচ্চতা ও বয়স অনুযায়ী তার আদর্শ ওজন কত সে সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। শিশুকে ধীরে ধীরে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে ওজন বেড়ে গেলে তার কি কি সমস্যা হতে পারে।

শিশুকে প্যাকেট জাতীয় খাবারের উপর নির্ভরশীল না করে পুষ্টিকর ফলমূল খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে। এই অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে খুব অল্প বয়স থেকে। হুটহাট ক্ষুধা নিবারণের জন্য চিপস কিংবা জুস না খেয়ে তাকে বাদাম কিংবা কলা ডিম ইত্যাদি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বাইরের খাবার না দিয়ে শিশুকে ঘরেই মজাদার খাবার তৈরি করে দিন।

শিশুর খাবারের একটি রুটিন তৈরি করুন এবং চেষ্টা করুন অধিকাংশ সময় তাকে ঘরের খাবার দেওয়ার। বাইরের যেসব খাবার শিশু খেতে পছন্দ করে সেসব খাবার ঘরে তেল কম দিয়ে তৈরি করে দিন। সারাক্ষণ ঘরে বসে না থেকে শিশুকে বাইরে খেলাধুলা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটার মতো ব্যায়ামের প্রতি উৎসাহ দিন। শিশুর ওজন কেন বেড়ে যাচ্ছে সে কারণটাও জানা খুব প্রয়োজন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে দেখতে পারেন তার কোনো হরমোনাল জটিলতা রয়েছে কি না। ওজন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বিশেষজ্ঞের কাছে পরামর্শ নিন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twenty − nine =