শিশুর জীবন রক্ষায় আসুক সাফল্য

সেলিনা আক্তার: জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে শিশু মৃত্যু অর্ধেকে অর্থাৎ ৩০ লাখে কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। পৃথিবীতে ১৮ শতাংশ শিশু মারা যায় অসংক্রামক রোগ যেমন ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা ইত্যাদি কারণে আর ৮২ শতাংশ শিশু মারা যায় সংক্রামক রোগে। এসব রোগ একটু সচেতন হলে সহজেই নিরাময় করা সম্ভব। অর্থাৎ আমারা চাইলেই এই ৮২ শতাংশ শিশুর জীবন রক্ষা করতে পারি।

নির্ধারিত সময়ের চার বছর আগেই পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু মৃত্যুহার কমানোর বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জন করে উন্নয়ন আইকন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি, প্রতিবছর জন্মের পর মারা যায় ৬২ হাজার নবজাতক। এসব শিশুর মৃত্যু হয় জীবনের প্রথম মাসে এবং অর্ধেকই মারা যায় পৃথিবীতে আসার দিনই। বাংলাদেশে নবজাতক মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অপরিণত অবস্থায় জন্ম, সংক্রমণ এবং শ্বাসকষ্টের মতো ডেলিভারিকেন্দ্রিক জটিলতা থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে। শিশুর মৃত্যুর জন্য প্রধান লক্ষনীয় বিষয় হলো  শিশুটি কোথায় কোনো পরিবেশে এবং কোনো ধরনের পরিবারের জন্ম নিয়েছে? প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার ২ শত নারীর মৃত্যু হয় গর্ভকালীন, প্রসবকালীন এবং সন্তান জন্মের পর সৃষ্ট জটিলতায়। প্রতিদিনি প্রায় ২৩০টি মতো মৃতসন্তান প্রসব হয়। অধিকাংশ মায়েরই মৃত্যু ঘটে কোনো চিকিৎসক বা দক্ষ ধাত্রী ছাড়া বাড়িতে সন্তান প্রসবের সময়। এছাড়া গর্ভধারণকালে নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে মাতৃত্বকালীন সেবা না নেওয়ার কারণেও অনেক মায়ের মৃত্যু হয়। গর্ভাধারিণী মায়ের পুষ্টির ঘাটতি এবং অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের কারণে অনেক নবজাতকের ওজন কম হয়।

অপুষ্ট মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া বেশির ভাগ শিশুও হয় অপুষ্ট। এরপর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পুষ্টিকর খাবারের অভাব, অসচেতনতা এসব বিষয় অপুষ্ট শিশুর স্বাস্থ্যকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, অপুষ্ট শিশুদের পরিপাকতন্ত্র সুগঠিত না হওয়ায় তাদের শরীরে খাবারের পুষ্টি পূর্ণমাত্রায় শোষিত হয় না। এর ফল খর্বত্বের মতো নিয়তি। দীর্ঘদিন অপুষ্টিতে ভোগা এসব শিশু হঠাৎ অসুস্থ হলে কিংবা প্রাকৃতিক বা মানবিক দুর্যোগে সৃষ্ট প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়লে তারা অপুষ্টির একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁছায়। খর্বকায় এসব শিশু তখন পড়ে শোচনীয়তম অপুষ্টির কবলে। পুষ্টিবিজ্ঞান যাকে বলে কৃশকায়। কৃশকায় শিশুরা থাকে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুঝুঁকিতে। বেঁচে গেলেও শারীরিক ও মানসিক রোগ্নতার কারণে তাদের পরবর্তী জীবনের সব সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়ে পড়ে। কিশোরী মায়েদের সন্তানদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরও বেশি থাকে।

সুস্থ, স্বাভাবিক সন্তান জন্মের জন্য গর্ভধারণকালে মাকে অবশ্যই চার বা তার বেশি বার এবং সন্তান জন্মের পর চার বার চিকিৎসকের কাজে যেতে হবে। তবে এ দুটোরই হার এখনও অনেক কম। গর্ভধারণকালে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন মা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করেন। স্বল্প শিক্ষিত মায়েদের সন্তানরা আরও বেশি অসহায়। তাদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ কম থাকে। দেখা গেছে এসব শিশুই বেশি জীবনবিনাশী রোগে আক্রান্ত হয়। শহরের বস্তির মায়েদেরও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ কম। কারণ এসব নারীদের অধিকাংশই নিম্ন মজুরিতে কাজ করেন, যা দিয়ে মৌলিক প্রয়োজন মেটানোই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শহরের বস্তিগুলোতে নবজাতক ও মায়ের স্বাস্থ্যসেবার চ্যালেঞ্জগুলো তীব্র। অশিক্ষিত মায়েদের সন্তানদেরই মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি। মৃত নবজাতকদের মায়েদের সম্পর্কে খবর নিলে দেখা যায়, মাধ্যমিক বা তার বেশি লেখাপড়া করা মায়েদের তুলনায় অশিক্ষিত মায়েদের সংখ্যা দ্বিগুণ।

নবজাতকের জীবন রক্ষায় সরকার সার্বক্ষণিক অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্যসেবা, আরও দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী এবং উল্লেখযোগ্য হারে জনগণের সুষ্ঠুভাবে হাইজিন ও স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার উপর গুরত্বারোপ করেছেন। ক্যাঙ্গারু তার শাবককে যেভাবে বুকে জড়িয়ে রাখে, তেমনি অকালিক ও কম ওজন নিয়ে জন্মানো নবজাতকের চিকিৎসায় ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ নামের প্রযুক্তি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। জন্মের পর কিছু নবজাতক নিশ্বাস নিতে পারে না। তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস শুরু করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘আম্বু ব্যাগ অ্যান্ড পেঙ্গুইন সাকার’ নামের প্রযুক্তি। শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে শ্বাসপ্রশ্বাসে জটিলতা হয়। শিশুদের শ্বাসপ্রশ্বাসের হার পরিমাপের জন্য সারা দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এখন ‘এআরই টাইমার’ ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে রক্তে অক্সিজেন কমে যায়। শিশুদের নিউমোনিয়া কোনো পর্যায়ে আছে, তা পরিমাপ করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ‘পালস–অক্সিমিটার’। আবার নিউমোনিয়ার মতো শ্বাসতন্ত্রের রোগে ভোগা শিশুদের ভেন্টিলেশন সহায়তার দরকার হয়। ভেন্টিলেশন সহায়তার জন্য ‘বাবল সিপাপ’ নামের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। যা শিশুদের জীবন রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২০০০ সালে ১৫ লাখের বেশি শিশু মারা গেছে নিউমোনিয়ায়। ২০১৯ সালে কম বেশি ৬ লাখ ৭০ হাজার শিশু মারা গেছে নিউমোনিয়। অর্থাৎ ৫৫ শতাংশ শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।  ঠিক একইভাবে দুই দশকে ডায়রিয়ায় ৫৮ শতাংশ শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে শিশুর মৃত্যুর কারণ ছিলো প্রায়৫ লাখ,এখন সেখান থেকে মৃত্যুর কারণ নেমে এসেছে ৮৭ শতাংশে।অর্থাৎ চিকিৎসা বিজ্ঞান ৬৫ হাজারেরও বেশি শিশু মৃত্যুর কারণ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।

শিশুর জীবন রক্ষায় টিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।বিশ্বব্যাপী শিশুর জীবন রক্ষার জন্য টিকা কর্মসূচি ব্যাপক সাফল্য অর্জন করছে। দেশে দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্হার উন্নয়ন ঘটছে। আমাদের দেশেও স্বাস্থ্য সেবায় ব্যপক উন্নয়ন হয়েছে। শতভাগ শিশুকে টিকার আওতায়আনা হয়েছে। শিশু মৃত্যু এবং মাতৃ মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ একে অপরের সাথে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি নিয়ে শিশুর জীবন রক্ষার বিষয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়করছে। স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ ও টিকা তৈরি করছে।

সরকার বাংলাদেশে জরুরি প্রসূতি সেবা চালু, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা গ্রহণে উৎসাহ প্রদান,মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিকিৎসক, নার্স, মিড ওয়াইফ এবং অন্যান্য কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। বর্তমানে দেশের সকল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল,৫৯ টি জেলা হাসপাতাল, ৩ টি জেনারেল হাসপাতাল,১৩২ টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৬৩ টি মাতৃ ও শিশু কল্যান কেন্দ্রে Comprehensive Emergency Obstetric National Care (CEmONC) এবং অবশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে Basic Emergency Obstetric National Care (BEmONC) সেবা চালু আছে। এসব সেবা চালুর ফলে মাতৃমৃত্যু প্রতি লাখে জীবিত জন্মে ১৬৩ এবং নবজাতকের মৃত্যু প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে ২৮ এ নেমে এসেছে।

প্রায় ৩ হাজার মিড ওয়াইফারির পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ২৫৫০ জনকে বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে পদায়ন করা হয়েছে। জনগণকে স্বাস্হ্য সেবা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্য বাতায়ন -১৬২৬৩ নামে কল সেন্টার চালু করা হয়েছে। দেশের সকল জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সকল হাসপাতাল থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে। ৯৬ হাসপাতালে উন্নত মানের টেলি মেডিসিন সেবা চালু আছে।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শিশু সুস্থ, সুন্দর ও সুরক্ষিত উপায়ে বেডে উঠুক, এটাই হোক আমাদের সকলের প্রত্যাশা।

পিআইডি ফিচার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × four =