শীতের সুরক্ষা

ময়ূরাক্ষী সেন

প্রতি বছরই প্রকৃতি তার আপন নিয়মে বদলে যায়। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রায় আসে পরিবর্তন। চিরচেনা অভ্যাস থেকে বের হয়ে নতুন করে অভ্যাস তৈরি করতে হয়। তবে বাংলাদেশ গ্রীষ্মপ্রধান দেশ হবার কারণে শীতের মৌসুমটা সবাই উপভোগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৃতি উপভোগ করার পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়। শীতের সময় অনেকের ঠান্ডা কাশি কিছুতেই ভালো হতে চায় না, এটি যেন নিত্য সঙ্গী। শীতের মৌসুম নানা রকম রোগ নিয়ে পার করতে থাকে অনেকে। তাই বছরের অন্যান্য সময় থেকে এই সময়টা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নিতে হবে বাড়তি যত্ন। জেনে নেওয়া যাক প্রকৃতির এই পরিবর্তনের সময় নানা রকম অসুখ-বিসুখ থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ

ভিটামিন সি’তে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ইনফেকশন এবং কোষ ক্ষয় প্রতিরোধ করে। কো-এনজাইম হিসেবে ভিটামিন সি ক্ষত সারায়, ঔষধ এবং কোলেস্টেরলের বিপাকে ভূমিকা রাখে। ভিটামিন সি ঠান্ডা কাশি জ্বরের মতো রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। সব ধরনের ইনফেকশন থেকে শরীরকে দ্রুত সেরে উঠত সাহায্য করে। তাই আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় খাবারের পাতে প্রতিদিন ভিটামিন সি রাখতে হবে। কারণ ভিটামিন সি খুব দ্রুত শরীর থেকে বের হয়ে যায়। প্রতিদিন ভিটামিন সি গ্রহণ না করলে ভিটামিন সি’র ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়। ভিটামিন সি’র সবচেয়ে ভালো এবং সহজ উৎস হচ্ছে লেবু। ভাত খাওয়ার সময় প্রতিদিন লেবু খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। এছাড়া কমলা, মালটা, জাম্বুরা, পেয়ারা, টমেটো, ক্যাপসিকাম এমন ফল ও শাকসবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি। ক্যাপসিকাম, টমেটো, শসা, লেবু দিয়ে সালাদ তৈরি করে গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া যেকোনো টক ফলই ভিটামিন সি’র ভালো উৎস।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা

অনেকে আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় কিংবা ঠান্ডা পড়লে গোসল এড়িয়ে যায়। অনেকের মধ্যে আবার এ ধরনের ভুল ধারণাও রয়েছে যে, প্রতিদিন গোসল করলে শরীর খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু আবহাওয়া যেমনই হোক না কেন প্রতিদিন গোসল করার অভ্যাস রাখতে হবে। কারণ গোসল না করলে সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা সম্ভব নয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না থাকলে শরীরে নানা রকম রোগ বাসা বাঁধতে পারে। এছাড়া অপরিষ্কার শরীরে ছত্রাক সংক্রমণের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। তাই এই শীতে রোগ থেকে বাঁচার জন্য নিয়মিত গোসল করতে হবে কুসুম গরম পানি দিয়ে। গরম পানির পাশাপাশি জীবাণু ধ্বংস করার সাবান ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া খাবার গ্রহণ করার আগে অবশ্যই ভালো করে হাত পরিষ্কার করে নিতে হবে। কারণ এ সময় আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে প্রকৃতিতে অনেক ধুলাবালি থাকে, যা হাতে লেগে গিয়ে খাবারের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

ধুলাবালি থেকে বাঁচতে হবে

শীতের সময় পরিবেশ শুষ্ক হয়ে ধুলাবালির পরিমাণ বেড়ে যায়। ধুলাবালি মুখ ও নাক দিয়ে প্রবেশ করে। যাদের আগে থেকে হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য শীতের এই সময়টা প্রায় অভিশাপের মতো। তাই অবশ্যই ধুলাবালি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। ধুলাবালি যাতে শরীরে প্রবেশ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেসব স্থানে ধুলা জমে থাকে তা পরিষ্কার সুতির কাপড় দিয়ে মুছে ফেলতে হবে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। মাস্ক ব্যবহার করলে খুব সহজে নাক ও মুখ দিয়ে ধুলাবালি প্রবেশ করতে পারবে না।

রুটিন মাফিক জীবনযাপন

সুস্থ শরীরের জন্য রুটিন মাফিক জীবনযাপন করার বিকল্পে কিছুই হতে পারে না। সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করা, সময়মতো ঘুমাতে যাওয়া আবার ঘুম থেকে ওঠা ভীষণ জরুরি। কারণ ঘুম ও খাদ্যের প্রভাব আমাদের শরীরের উপর সরাসরি পড়ে। এই বিষয়ে কোনো ধরনের অবহেলা করলে শরীর ভালো রাখা সম্ভব নয়।

এর পাশাপাশি অবশ্যই শারীরিক পরিশ্রম এবং হালকা ব্যায়াম করার অভ্যাস করতে হবে। ব্যায়াম করতে না চাইলে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করা যেতে পারে। শুধুমাত্র সঠিক নিয়মে হাঁটার মাধ্যমে শরীর থেকে প্রচুর ক্যালরি কমানো এবং সুস্থ থাকা সম্ভব। সঠিক নিয়মে খাওয়া-দাওয়া ও ব্যায়াম করলে আমাদের মেটাবলিজম বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাই নিজের জীবনকে একটি রুটিনে নিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ।

সঠিক পোশাক পরা

এ সময় রোগ থেকে রেহাই পেতে পোশাক নির্বাচন হতে হবে সতর্ক। কারণ আবহাওয়া এই পরিবর্তনের সময় কখনও গরম লাগে কখনও বা ঠান্ডা। তাই দিনে ও রাতের পোশাকের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা থাকা প্রয়োজন। কারণ সন্ধ্যার পর হালকা ঠান্ডা আমেজ থাকলেও দুপুরের দিকে বেশ গরম অনুভব হয়। তাই ঠান্ডার সময় ভারী পোশাক এবং গরম অনুভুতি হওয়ার সময় পাতলা পোশাক পরতে হবে। তা না হলে শরীর ঘেমে সর্দি জ্বরের মতো নানা ধরনের রোগ দেখা দিবে।

খাবার নির্বাচনে সতর্কতা

চিকিৎসকদের মতে শীতের সময় অন্যান্য সময়ের তুলনায় গ্যাস্ট্রিক, পেটব্যথা, আলসারের মতো সমস্যা বেড়ে যায়। এর কারণ হচ্ছে বছরের অন্যান্য সময় থেকে এ সময় বিয়ে অনুষ্ঠান, দাওয়াতের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং এতে প্রচুর ক্যালোরিবহুল, তেল মশলা জাতীয় খাবার গ্রহণ করা হয়। যা শরীর ও পাকস্থলীর উপর প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত তেল মশলা জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে পেট ব্যথা এবং গ্যাস্ট্রিকের মতো সমস্যা হতে পারে। বিয়ের অনুষ্ঠান কিংবা দাওয়াতে উপস্থিত থাকলেও খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রতিদিন খাবারের পাতে বেশি করে শাক-সবজি, ডিম, মাছ, ডাল ও প্রোটিন জাতীয় খাবার রাখতে হবে।

ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে

এই সময় আরেকটি আতঙ্কের নাম হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বর। অনেকেই এখন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। তাই ডেঙ্গুর বিষয়েও সতর্ক থাকা জরুরি। ঘর বাড়ি পরিষ্কার রাখা, ঘরে পুরানো ভাঙা জিনিস না রাখা, সন্ধ্যার পর দরজা জানালা লাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ডেঙ্গু মশা থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে এই ঋতুতে জ্বর আসলে অবশ্যই প্রথমে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। ডেঙ্গু রোগ অবহেলা করলে মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকতে পারে।

চিকিৎসকের পরামর্শ

অনেকের জ্বর ঠান্ডা কাশি ইত্যাদিকে ছোট রোগ মনে করে অবহেলা করে এবং দিনের পর দিন তা নিয়েই ঘরে বসে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে ঠান্ডা কাশি ভালো না হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তা না হলে সাধারণ ঠান্ডা কাশিও নিউমোনিয়ার আকার ধারণ করতে পারে। বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুদের ক্ষেত্রে। বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। যাদের আগে থেকে হাঁপানির মতো রোগ আছে তাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে চলতে হবে। কারণ শীতের সময় শ্বাসকষ্টের পরিমাণ বেড়ে যায়। যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ আেেছ তাদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই এ সময়ের শরীর খারাপকে ছোট মনে করে ঘরে বসে থাকা যাবে না। কয়েক দিনের ঘরোয়া পদ্ধতিতেও যদি শরীর ভালো না হয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

thirteen − four =