সালেক সুফী
আজ ৩০ মার্চ ২০২৪। আজ থেকে ৫৩ বছর আগে এই মাসের ২৬ মার্চ ১৯৭১ সূচনা হয়েছিল সশস্ত্র হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। ২৫ মার্চ মাঝরাতে পাকিস্তানী বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট নামে পৈচাশিক আক্রোশে ঢাকা এবং প্রধান প্রধান শহরগুলোতে আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নির্মম গণহত্যায়। পিলখানা তৎকালীন ইপিআর সদরদপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরান ঢাকা অঞ্চলে নিরীহ ঘুমন্ত বাংলাদেশীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল জনপদ।
মাঝরাতের পরেই ইপিআর বেতারযন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে প্রচারিত হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। পরদিন সারাদিন নানা ভাবে নানাজন চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতের কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বোমার আক্রমণ থেকে বেতার ট্রান্সমিটার রক্ষা করে সাময়িক ভাবে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্থানান্তরিত করা হলে ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছে নানা সময়ে ঘোষণা দুটি নিজ কানে শুনার। ইতিহাস চলে নিজের গতিতে। ইতিহাসকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না।
আজ নানা ষড়যন্ত্রের পরিণতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট দুইজন নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে পরলোকে। নানাচ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশ এখন অনেক এগিয়ে গাছে। সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশী এখন ১৮ কোটি। দেশে প্রবাসে আজ নানা গৌরবে গৌরবান্বিত বাংলাদেশ। অথচ কিছু দিকভ্রান্ত মানুষ এখনো নানা বিতর্কে মেতে আছে। জাতি হিসাবে মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনো চলছে বিতর্ক বাহাস।
স্বীকার করে দ্বিধা নেই আজো স্বাধীন জাতি হিসাবে আমরা দেশকে সঠিক ভাবে ভালোবাসতে শিখিনি। জনগণের মৌলিক অধিকার সত্যিকার অর্থে অর্জিত হয়নি। মীমাংসিত অনেক বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল আপামর জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণে একটি জনযুদ্ধ। প্রতিবেশী ভারতের সক্রিয় সহায়তায় সাড়ে নয় মাসে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৩০ লক্ষ বীর শহীদের আত্মদান এবং লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে এখনো মুক্তিযুদ্ধ বিতর্কিত হয়ে রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অবর্তমানে তার আদর্শ এবং নির্দেশনায় মুজিবনগর সরকারের সুযোগ্য পরিচালনায় অর্জিত স্বাধীনতার মূল নায়কদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। দেশে অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সরকারী সুবিধা ভোগ করলেও অনেক সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা নিদারুন দুঃখে কষ্টে দিন পার করছে। দেশে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলাচ্ছে ফসল, শ্রমিকের ঘামে অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু প্রভাবশালিদের পৃষ্ঠপোষকতায় শোষক শ্রেণী অবাধ লোপাটের মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করে দেশের বাইরে পাচার করছে।
সুশাসন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গণতন্ত্র এখনো বাধা পাচ্ছে পদে পদে। এমন দেশের জন্য জাতির জনক আজীবন সংগ্রাম করেননি। এই দেশ এই সমাজ ব্যাবস্থার জন্য ৩০ লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা আত্মাহুতি দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধ কারো দয়ার দান ছিল না, ছিল না কোনো রূপকথা। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সংগ্রাম ছিল পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শোষণ নিপীড়ণের বিরুদ্ধে। তিনি পাকিস্তানের কোটিপতি ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আজ দেশে ২,২২০০০ পরিবার কোটিপতি সুশাসনের অভাবে।
অথচ সাধারণ মানুষ অধিকার বঞ্চিত, রাজনীতি এখন জনস্বার্থ সংরক্ষণের পরিবর্তে অবৈধ লোপাটের বাণিজ্যে পরিণত। বঙ্গবন্ধু নিজে বলতেন আমার কৃষক, আমার শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ যেন বঞ্চিত না হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি সারাক্ষণ যারা মুজিব বন্দনায় মুখে ফেনা তুলছে তারাও অনেকে মুজিব আদর্শ বিচ্যুত।
অস্বীকার করা যাবে না বঙ্গবন্ধু কন্যা জীবন বাজী রেখে দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে একটি পর্যায়ে টেনে তুলেছেন। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে তাঁকে কৌসুলি হতে হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই আপোষ করেছেন কিছু মহলের সাথে। কিন্তু সেই সুযোগে দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সামরিক-বেসামরিক আমলা গোষ্ঠী জনগণের সম্পদ লোপাট করেছে। সরকার প্রধানকে মাঝে মাঝে অসহায় একাকী মনে হচ্ছে। তাঁর ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ মুখ থুবড়ে পড়েছে।
এভাবে চললে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট একসময় দেশের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশ কিন্তু আবারো শাসক এবং শোষক শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান অবস্থায় আমি মনে করি সরকার প্রধান নিজে উদ্যোগ নিয়ে দেশের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে সংলাপ করে বর্তমান অবস্থায় করণীয় বিষয়ে সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ। দেশের অগ্রসরমান চিন্তাধারার তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশ গোড়ার নতুন মুক্তিযুদ্ধ এখন সময়ের দাবি। স্বাধীনতা সংগ্রাম সূচনার মাসে একজন সচেতন বাংলাদেশী হিসাবে এটি কামনা করি।