ষোড়শ থেকে বিংশ শতাব্দীতে শালের ব্যবহার

শীত তার আগমনী বার্তা নিয়ে এসে গেছে। এমনটা জানাচ্ছে আবহাওয়া আর পরিবেশ। বাংলাদেশ গরম প্রধান দেশ হবার কারণে শীতকে ঘিরে সবার থাকে নানা আয়োজন। পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে অনেকে তো নতুন করে কেনাকাটাও করে। তাই তো দেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো শীতের পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসে। প্রতি বছর ফ্যাশন প্রেমীদের জন্য নতুন সব ভিন্নধর্মী শীতের পোশাক তৈরি করা হলেও শীতের সময় শালের কদর কখনো কমবে না বলেই মনে হয়। ঠান্ডা অনুভূত হলেই গায়ে জড়িয়ে নেওয়া যায় শাল। নাহিন আশরাফের প্রতিবেদন

জনপ্রিয় এই শালের ইতিহাস কিন্তু অনেক পুরানো। শাল শুধু শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি পোশাক নয়। এর সাথে জড়িয়ে থাকে অনেক আবেগ ও গল্প। তাই তো দেখা যায় দাদী কিংবা নানীর অনেক বছর পুরানো সাদামাটা শালও যত্নে আগলে রাখে অনেকে। সেই ১১শ শতাব্দীতেও ছিল শালের ব্যবহার। মাটি কিংবা কাঠে খোদাই করা মূর্তিতে শাল পরা মানুষের ছবি পাওয়া যায়। তবে ষোড়শ শতাব্দী থেকে শালের ব্যবহার দেখা যায়। জমিদার ও রাজা-বাদশার মতো বিত্তবান ব্যক্তিদেরই শুধু শাল জড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তখন শাল কিছুটা বিলাসবহুল পোশাক ছিল। ১৭৮৪ সালে ফ্রান্সেও শালের ব্যবহার দেখা যায়। ফ্রান্সে শালকে আভিজাত পোশাক বলা হতো। শুধুমাত্র দেশের কুইন ভিক্টোরিয়া শাল ব্যবহার করতেন। ইউরোপে বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠানে গাউনের উপর রাজ পরিবারের মেয়েরা বাহারি শাল জড়িয়ে রাখতেন। সুতরাং শালকে অনেকে দেশীয় পোশাক মনে করলেও এর বিস্তার রয়েছে সারা পৃথিবীতেই।

বাণিজ্যিকভাবে শাল নিয়ে কাজ শুরু হবার পরে শাল বাঙালির কাছে কিনে এসেছে। এক সময় ভারত ও পাকিস্তান থেকে শাল নিয়ে আসা হলেও এখন আমাদের দেশের তাঁতীরা তৈরি করছেন চমৎকার ডিজাইনের শাল। তাই শালের জন্য ভারতের আশায় বসে থাকতে হয় না। শালকে অনেকে মনে করে থাকেন সাদামাটা পোশাক। আবার অল্পবয়সী ছেলে মেয়েরা যেকোনো পোশাকের সাথে শাল পরিধান করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। তাই তো একঘেয়ে নকশা ও রঙ থেকে বের হয়ে শালেও নিয়ে আসা হচ্ছে নানা বৈচিত্র্য। যাতে করে যেকোনো বয়সীরাই শাল পরতে পারে। অনেকের পছন্দের তালিকায় রয়েছে কাশ্মীরি শাল। শালের তিনটি ভাগ রয়েছে শাহতুষ, পশমিনা ও রাফল। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে পশমিনা। ছাগলের পশম দিয়ে এই শাল তৈরি করা হয়ে থাকে। ফলে শাল হয় অত্যন্ত মিহি। তবে এখন বাজারে আসল কাশ্মীরি শাল হারিয়ে যাচ্ছে, মেশিনে বোনা নকল শালে। অনেকে তো আসল কাশ্মিরি শাল বলে নকল শাল চড়া দামে বিক্রি করছে। আসল কাশ্মীরি শাল পরলে গায়ে কখনো অস্বস্তি অনুভূতি হবে না। কাশ্মীরি শালে আলাদা করে সুতা মেশানো হলে রোদ লাগলে চকচক করে, তখন বুঝতে হবে এটি আসল কাশ্মিরি শাল নয়। আবার কাশ্মীরি শাল থেকে একটু সুতা নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে নিন। সেই সুতা থেকে চুলের গন্ধ বের হলে বুঝতে হবে এটি আসল কাশ্মীরি শাল। যেহেতু এটি তৈরি করতে অনেক শ্রম দিতে হয় তাই এই শাল ব্যয়বহুল।

আমাদের দেশে এখন তৈরি হচ্ছে জামদানি শাল। জামদানি শাল চাকমা উপজাতীরা বুনন করতেন। ধীরে ধীরে দেশে জামদানি শালের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেলে সর্বস্তরের কারিগররাই জামদানি শাল তৈরি করতে থাকেন। জামদানি শাড়ির মতো শালেও কাউন্ট সুতা মেইনটেইন করা হয়। তাই এই শাল তৈরি হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। এছাড়া এখন পাওয়া যায় জামদানি মোটিফের শাল। এক্ষেত্রে শালের উপর জামদানি নকশার কাঠ ব্লকের কাজ করা হয়। শালের উপর করা হচ্ছে নানা নকশার স্ক্রিন প্রিন্ট। এর ফলে শাল হয়ে উঠছে আরো আকর্ষণীয়। অনেকেই মনে করেন শাল শুধু দেশীয় সাজের সাথে মানানসই। কিন্তু এখন জিন্স, টি-শার্ট এবং নানা ধরনের ওয়েস্টার্ন পোশাকের উপরেও শাল পরিধান করছেন। তাই শালে বৈচিত্র্য আনতে করা হচ্ছে বিভিন্ন মোটিফের কাজ। শালে বসানো হচ্ছে সিনেমার প্রিন্ট কিংবা গান বা কবিতার লাইন। নান্দনিকতা ফুটিয়ে আনতে শালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও সত্যজিৎ রায়ের মতো লেখকদের ছবি স্ক্রিন প্রিন্ট করা হচ্ছে। এইসব শাল ছেলেমেয়ে উভয়েই পরতে পারে।

দেশে সিল্ক, উল ও কটন সুতা দিয়ে শাল তৈরি করা হয়ে থাকে। কটনের শালগুলো হালকা শীতেও পরিধানযোগ্য। শালের মধ্যে করা হয় নানা ধরনের লেসের ব্যবহার। এক রঙা শালের সাথে বিভিন্ন রঙের লেস যুক্ত করে দেওয়া হয়। শীতের সময় নারীরা বেশি বিভ্রান্ত থাকে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে শাড়ির সাথে শীত পোশাক হিসেবে কি পরা যায়। সেক্ষেত্রে পার্টিতে পরার জন্য অনেক ধরনের স্টোন ও চুমকি দিয়ে শাল তৈরি করা হয়। গর্জিয়াস শালগুলোতে করা হয় মিরর ওয়ার্ক। শালের পাড়ে যোগ করা হয় বিভিন্ন রঙের টারসেল। শালের মধ্যে ভিন্নতা নিয়ে আসতে দু’রঙের কাপড় দিয়ে তৈরি করা। যার ফলে যখন যে রঙের ইচ্ছে হবে সেদিকটি উপরে রেখে ব্যবহার করা যাবে।

শালে করা হচ্ছে নিখুঁত হাতের কাজ। নকশি কাঁথা থিমেও করা হয় শাল। মূলত আমরা যেসব শাড়ি কিংবা পোশাক পরে থাকি সবকিছু থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে শালের থিম করা হয়ে থাকে। শাল নির্বাচনের ক্ষেত্রে আবহাওয়া এবং বয়স উভয় দিক খেয়াল রাখতে হবে। শীতের শুরুতে হালকা ঠান্ডা থাকবার কারণে পাতলা শাল বেছে নিতে হবে। ওয়েস্টার্ন পোশাকের সাথে শাল পরতে চাইলে ভিন্নধর্মী থিমের শাল পরা যেতে পারে। এছাড়া পোশাকের রঙের সাথে মিলিয়ে অনেকে শাল পরে থাকেন। আবার পোশাক উজ্জ্বল হলে বেছে নিতে পারেন হালকা রঙের শাল। সাদা, কালো, রয়েল ব্লু ও খয়েরির মতো রঙ যেকোনো রঙের পোশাকের সাথেই মানানসই। শালের মধ্যে ফুল, পাখি ও লতাপাতার এমব্রয়ডারি করা হয়ে থাকে।

এছাড়া এখন ট্রেন্ডে রয়েছে প্যাচওয়ার্কের শাল। হাল ফ্যাশনে প্যাচওয়ার্ক এখন বেশ জনপ্রিয়। এটি হচ্ছে জোড়াতালি। ছোট ছোট বিভিন্ন রঙের কাপড়ের টুকরা দিয়ে এটি করা হয়, যার ফলে শাল হয় বেশ কালারফুল। আরো রয়েছে খাদি শাল। এই শালে ভ্যারিয়েশন নিয়ে আসার জন্য ব্লকের কাজ করা হয়ে থাকে। কটন শালের মধ্যে করা হয় হ্যান্ডপেইন্ট। বাটিকের শাড়ি ও কামিজের সাথে তো আমরা সবাই পরিচিত। তেমনি রয়েছে বাটিকের শালও। এই শালে কেমিকেল ও প্রাকৃতিক রঙ দুটোই দেওয়া হয়ে থাকে। বাটিক সবচেয়ে বেশি কটনের শালে করা হলেও সিল্ক, তসর সহ সব ধরনের মেটারিয়ালেই করা হয়ে থাকে।

আরো পাওয়া যায় মনিপুরী শাল। এ শালগুলো উলের সুতায় বোনা হয় বলে বেশ ভারী হয়ে থাকে। উলের তৈরি শাল বেশি ঠান্ডায় পরা উচিত। দেশীয় ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে তৈরি করা হয় পাটের শাল। এই শাল তৈরি করতে তাঁতীদের ৭ থেকে ১০ দিন অবধি সময় লেগে যায়। পাটের শালের উপর ফুল ও লতাপাতার নকশা করা হয়ে থাকে। নকশায় এতো বৈচিত্র্য শালের চাহিদা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। তরুন-তরুনীরা এখন শাল পরতে পছন্দ করে।

শীতের মৌসুমে যেকোনো মার্কেটে খুব সহজে বাহারি শাল পাওয়া যায়। দেশীয় বিভিন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ড শীতের জন্য নিয়ে আসে শালের কালেকশন। শালে দেশীয় ছোঁয়া রাখতে চাইলে আড়ং, অঞ্জনস ও বিশ্ব রঙ-এর শাল বেছে নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া নিউ মার্কেট, বসুন্ধরা ও যমুনা ফিউচার পার্ক-এ রয়েছে শালের কালেকশন। অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন পেইজেও পেয়ে যাবেন নানা থিমের শাল। যেমন কইন্যা, শরদিন্দু, হরতকী ইত্যাদি। শালের দাম নির্ভর করছে তার মানের ওপর। তবে ৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকার মধ্যে ভালো মানের দেশীয় শাল পাওয়া যায়। কিন্তু কাশ্মিরী শাল কিংবা বিভিন্ন পাকিস্তানি অরিজিনাল শাল কিনতে চাইলে গুনতে হবে মোটা অংকের টাকা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ফ্যাশন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nineteen − 14 =