সত্য ঘটনা অবলম্বনে ৭১ এর গেরিলা

মাসুম আওয়াল

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির শেকড়ের ইতিহাস। অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে এই সত্য ঘটনা অবলম্বন করে। ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানী শোষকদের হাত থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে ইতিহাসের সত্য ঘটনা অবলম্বনে। তেমনই একটি চলচ্চিত্রের ‘৭১ এর গেরিলা’। রঙবেরঙের নিয়মিত আয়োজনে এবার আমরা আলো ফেলতে চাই এই চলচ্চিত্রের উপর।

আগে কিছু কথা

‘৭১ এর গেরিলা’ চলচ্চিত্র নিয়ে বলার আগেই কিছু বিষয় জানা প্রয়োজন। গেরিলা কী? স্পেনের ভাষায় ‘গুয়েরিলা’ শব্দের অর্থ হলো ছোট যুদ্ধ বা খণ্ড যুদ্ধ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একটা বড় অংশই ছিল গেরিলা যুদ্ধ। গেরিলা যোদ্ধারা বলছেন, ‘যুদ্ধে গেরিলা নীতি হলো বিকল্প নীতি। যার জন্য বন্দুকের পরিবর্তে প্রচার চাই, বিমানের পরিবর্তে চাই বিধ্বংসী ক্রিয়া, অস্ত্র শিল্পের পরিবর্তে চাই রাজনৈতিক শিক্ষা এবং মেশিনের পরিবর্তে মানুষ।’ ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে তারা গেরিলা কায়দায় অপারেশনে যেতেন। গেরিলারা শুধু যুদ্ধের খাতিরেই যুদ্ধ করেন না, সঙ্গে তারা জনগণকে অনুপ্রাণিত করেন, সংগঠিত করে সশস্ত্র করে তোলেন এবং বৈপ্লবিক রাজনৈতিক শক্তির প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন। একাত্তরে বাঙালি জাতির যুদ্ধ জয়ের অন্যতম হাতিয়ার ছিল গেরিলা যুদ্ধ। পাকিস্তানি সৈন্যদের কুপোকাত করতে মোক্ষম ভূমিকা রেখেছিল যুদ্ধের বিশেষ এই কৌশল। গেরিলা যোদ্ধা কারা? গেরিলা যোদ্ধা তাদের বলা হয়, যারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে শত্রুদের বিপর্যস্ত করে তুলতো। যুদ্ধের সময় প্রত্যেকটি গেরিলা ঘাঁটি পরিচালিত হতো অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে।

মুক্তির আলোয় 

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গেরিলা যোদ্ধাদের কাহিনী নিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ঢালিউডে। এর মধ্যে অন্যতম একটি চলচ্চিত্র হলো, ‘৭১ এর গেরিলা’। সিনেমাটি সেন্সর বোর্ড থেকে ছাড়পত্র পেয়েছিল ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর। ২ ঘণ্টা ২৩ মিনিট দৈর্ঘ্যরে এই সিনেমাটি পরিচালনা করেন মিজানুর রহমান শামীম। রফিকুল ইসলামের ৭১ এর সত্য ঘটনা  কেন্দ্র করে নির্মাণ করা হয় এই সিনেমাটি। রফিকুল ইসলাম ও মোমেন উদ্দিন নিবেদিত ও মিজান সিনেমা সেন্টার প্রযোজিত সিনেমাটি ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর মুক্তি পায়।

সত্য ঘটনা অবলম্বনে

একজন মুক্তিযোদ্ধার সত্য ঘটনা অবলম্বনে ‘৭১ এর গেরিলা’ নির্মিত। সিনেমাটির কাহিনী, সংলাপ, চিত্রনাট্য লিখেছেন ও পরিচালনা করেছেন মিজানুর রহমান শামীম। অভিনয় করেছেন ঢাকাই সিনেমার ড্যাসিং হিরো সোহেল রানা, আলোকজান্ডার বো, খালেদা আক্তার কল্পনা, রাশেদা চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, হাজী আব্দুর রশীদ, নুপুর, আমির সিরাজী প্রমুখ।

মিজানুর রহমান শামীম বলেন ‘আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল মুক্তিযুদ্ধের উপর ছবি নির্মাণ করার। তাছাড়া আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমার মনে হয়, এই ছবিটি সুনাম অর্জন করার মতো। সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হলো আমি একটি সত্য ঘটনাকে সিনেমায় তুলে ধরতে পেরেছি। যা বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে তরুণ প্রজন্মকে সহযোগিতা করবে।’

সিনেমার আড়ালের মানুষেরা

‘৭১ এর গেরিলা’ সিনেমাটির সংলাপ চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক মিজানুর রহমান শামীম নিজেই। উপদেষ্টা পরিচালক হিসেবে ছিলেন মাসুদ পারভেজ। চিত্রগ্রহণ করেন জায়েদ হোসাইন খান। সম্পাদনা করেন মিঠুন ভট্টাচার্য ও মেহেদী হাসান ফাহাদ। সিনেমার কলাকুশলীদের রূপসজ্জায় ছিলেন ছোট খলিল ও অঙ্গসজ্জায় ছিলেন কামাল হোসেন। প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে ছিলেন রিপন বরিশালি এবং শব্দগ্রহণে ছিলেন মেহেদী হাসান ফাহাদ।

কী আছে সিনেমায়?

সিনেমাটির শুরুতেই দেখানো হয় একজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দেখা করতে আসে একদল তরুণ-তরুণী। তারা মুক্তিযোদ্ধার কাছে জানতে চায় সেই সময়ের কথা এবং সেই বিষয় নিয়ে গল্প লিখতে চায় সোমা নামের এক তরুণী। মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমি একজন একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা। আমি আমার সহকর্মীদের সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধ করেছিলাম। সেই গল্পটা বলতে পারব।’ এরপরে ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যায়। সাদাকালো ফ্রেমে ফুটে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ের দৃশ্য। সেøাগান ওঠে ‘জয় বাংলা। স্বাধীন কর স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ এরপর দেখানো হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। একটি দেশের গানের সঙ্গে দেখানো হয় বাংলার রূপবৈচিত্র্য।

এরপর কাহিনীতে প্রবেশ করেন পরিচালক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অতর্কিত হামলা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে তারা। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে দেশের সাধারণ মানুষ। বাংলার সাহসী সন্তানেরা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়ে। অনেকে ভারতে পাড়ি জমায় যুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়ার জন্য। টেনিং নিয়ে এসে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। কোনো মায়ের একমাত্র সন্তান লুকিয়ে যুদ্ধে চলে যায়। বাবা তাকে ফিরেয়ে আনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। মা মাসের পর মাস সন্তানের ফেরার অপেক্ষায় চোখের পানিতে আঁচল ভেজায়। কোনো ভাই তার বোনকে রেখে যুদ্ধে চলে যায়। ঘরের নারীরা ভয়ে কাঁপতে থাকে, কোন সময় দরজায় হাজির হয় পাক হানাদার বাহিনী। যুবতী নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের ধর্ষণ করে, হত্যা করে বনে জঙ্গলে ফেলে রাখে। কত নারী তার সম্ভ্রম হারায়। কত মা-বাবা তার সন্তানকে হারায়। কত শিশুর মৃত্যু হয় হানাদারদের গুলি খেয়ে। সেই সব নৃশংস দিনের প্রতিচ্ছবিই যেন ফুটে উঠেছে সিনেমায়। যা দেখলে শরীর মন শিহরিত হয়।

কমান্ডার ‘সোহেল রানা’

‘৭১ এর গেরিলা’ সিনেমায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ড্যাসিং হিরো সোহেল রানা। একজন শান্ত মানুষের চরিত্রে দেখা যায় তাকে, যার বুকের ভেতরে ঠাসা আগুন। চোখে মুখে বিজয়ের স্বপ্ন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধ চলতে থাকে। একের পর এক অপারেশনে সফলতা আসে। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রনেতার চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলেকজান্ডার বো। কমান্ডারের নির্দেশে একের পর এক গেরিলা হামলা হয় তারই নেতৃত্বে। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, আলেকজান্ডার রাজাকার লালুর হাতের কবজি দায়ের এক কোপে আলাদা করে দেয়। ছিটকে গিয়ে সেই হাতের কবজি লাফাতে থাকে। রাজাকারদের চোখে চোখে রাখে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের ধরে উত্তম মাধ্যম দেয়। অভিনেত্রী রেবেকা সুলতার দেখা মেলে এক মুক্তিযোদ্ধার মায়ের চরিত্রে। কেঁদে কেঁদে যার দিন কাটে। সব মিলিয়ে সিনেমাটি নায়ক-নায়িকা প্রধান নয়, কাহিনী প্রধান। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করে কাহিনীকে বেশ এগিয়ে নিয়ে গেছেন সোহেল রানা। বাস্তবেও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি।  শিক্ষাজীবনে একজন ছাত্রনেতা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নায়ক সোহেল রানা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। তার জন্ম ঢাকাতে হলেও পৈতৃক বাসস্থান বরিশাল জেলায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে মাসুদ পারভেজ এবং অভিনেতা হিসেবে সোহেল রানা নামে পরিচিত তিনি।

সিনেমার গান

একটি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। কখনো কখনো দেখা যায় গানের জন্যই দর্শকনন্দিত হয়েছে সিনেমা। ‘৭১ এর গেরিলা’ সিনেমায় গানও রয়েছে কয়েকটি। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন রিয়াজ মামুন। আবহসঙ্গীত করেছেন মোখলেসুর রহমান। গান লিখেছেন ও সুর করেছেন পরিচালক মিজানুর রহমান শামীম নিজেই। গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন  ফকির শাহাবুদ্দিন, শেখ রতন, বিউটি ও সাখাওয়াত সিদ্দিকী। এই সিনেমার একটি গানের কথা এমন ‘সোনালী সবুজ শস্য শ্যামল তোমার আমার লাল সবুজের দেশ, সে তো আমার জন্মভূমি প্রিয় বাংলাদেশ…।’ আরেকটি গানের কথা ‘বাংলা আমার জীবন মরণ বাংলা আমার প্রাণ, বাংলার রক্ষা করতে মোরা দিতে পারি জান…।’

শেষ কথা

সিনেমাটি উপভোগ করতে পারেন ইউটিউবে সার্চ করে। অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশ এগিয়ে যাক। ভালো থাকুক মায়ের মতো মমতাময়ী দেশটা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nine + 8 =