সব মা সেরা মা

সালেক সুফী: আমার স্নেহময়ী মা প্রয়াত সৈয়দা ইফফাত আরা বেগম আমার জীবনের সেরা বন্ধু, খেলার সাথী, শিক্ষক আর দার্শনিক ছিলেন। আমার জীবনের যা কিছু সামান্য অর্জন তার পটভূমি গড়ে দিয়েছিলেন মা।সততা, মূল্যবোধ, নিজেকে চেনা, যে কোনো পরিস্থিতি ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করার দীক্ষা পেয়েছি মায়ের কাছে।প্রতিদিন শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুত নামাজ পড়া, সকালে নামাজের পর প্রাতরাশ করার বিষয়টি মজ্জাগত করিয়েছিলেন মা।মা যতদিন বেঁচেছিলেন,  নিশ্চিত ছিলাম মায়ের আশীষ আমাকে সংকটে, সমস্যায় ছায়া দিয়ে রাখছেন। এখনো যখন দুর্যোগের মুখোমুখি হই শয়নে-স্বপনে মায়ের অস্তিত্ব অনুভব করি।

জানি  সব মা এমনি।মা নামের মধুর শব্দটি সব দেশের সব মানুষের জীবনে সবচেয়ে মধুর।১০ মাস গর্ভে ধারণ করে মা জন্ম দেন সবাইকে।শিশুকালে সবকিছু দিয়ে, নিজের সব আরাম-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে শিশুকাল থেকে কৈশোর পর্যন্ত আগলে রাখেন বুকের ধনদের।

আমার মা ছিলেন ফরিদপুরের বনেদি সৈয়দ পরিবারের।নানা মরহুম সৈয়দ আব্দুল বাকি ছিলেন পীর।মামারা সবাই উচ্চশিক্ষিত হলেও মা-খালাদের বাসায় রেখে সব ধরনের শিক্ষা দিয়েছিলেন নানা।বাংলা, ইংরেজি, আরবি ফার্সি বলতেন শিক্ষিত মার্জিত অনেকের মতো।আমার পড়ালিখার হাতেখড়ি মায়ের হাতে।নামাজ, কোরান সবকিছু শিখিয়েছেন মা।স্কুলের সময় তো বটেই মা কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্দালয়ে পড়ার সময় আমার পড়ালিখা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতেন।বাবা ব্যস্ততার কারণে আমাকে ইংরেজি শিখাতেন, খেলাধুলোয় উৎসাহিত করতেন।

শিশু শ্রেণি থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত ১-৩ পজিশনের নিচে কখনো যাইনি তার মূল প্রেরণা ছিলেন মা।৭ম থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ফরিদপুর জিলা স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিলাম। খেলতাম সব খেলা, দেয়াল পত্রিকায় লিখা, আবৃতি, বিতর্কে, সাধারণ গান সব কিছুতেই পুরুস্কার পেতাম।প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষার পর প্রচুর পুরুস্কার পেতাম।মা মার যাওয়ার পর ফরিদপুর পৌঁছে দেখেছিলাম মা আমার পুরস্কার আর মা’কে লেখা আমার সব চিঠি সযত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।

১৯৬৯ আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার মাস খানিক আগে বাবা হঠাৎ করে পরপারে না চলে গেলে হয়তো ৫ লেটার সহ তারকা মার্কসের চেয়ে বড় অর্জন হতো।বাবা মারা যাবার পর আমি আর ছোট ভাই সাকীর সব দায়িত্ব মা কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।বাবা  ইফফাত মাঞ্জিল এবং মডার্ন ফার্মেসি ছাড়া কিছু রেখে যাননি।বড় ভাই (মালেক ভাই) পরিবার নিয়ে খুলনা থাকতেন।বড় আপা ( শেফালী আপা) থাকতেন পরিবার নিয়ে ঢাকায় আজমপুর কলোনিতে। ছোট আপা ( মুস্তারী আপা) ফরিদপুরে  সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল।

আমার মায়ের নামে নাম “ইফফাত মাঞ্জিলটি ” ছিল শান্তি সুখের নীড়।আগেই লিখছি ৬-৭ বছর বয়স থেকেই সকালে উঠে মায়ের সাথে নামাজ পড়া আর কোরান শরীফ পড়া আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আমরা অনেক বিদেশি হাঁস, মুরগি, কবুতর পালতাম। পাশের বাড়ির প্রতিবেশী সেলিম, তসলিমদের সঙ্গে প্রাতভ্রমণের পর বাসায় ফিরতেই চিড়া-দই-কলা দিয়ে নাস্তা করে যেতাম আমার প্রিয় শিক্ষক তারাপদ স্যারের কাছে অংক শিখতে।বাসায় ফিরে গোসল, কখনো গাছের কাঁচা পেঁপে ভর্তা, ডাল, ঘি দিয়ে খাবার খেয়ে হেঁটে হেঁটেই স্কোলে যেতাম।মা সব কিছু রুটিন করে দিয়েছিলেন।

আমি শুধু দুইবার মায়ের কথা শুনিনি।প্রথমবার মা’কে না বলে ১৯৭১ খুলনায় ভাইয়ের বাসায় যেয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে অংশগ্রহণ। আর মায়ের অমতে বিয়ে।মা অবশ্য আমার স্ত্রীকে মেনে নিয়েছিলেন। আর দুইবার আমাদের কুমিল্লা বাসায় ছুটে এসেছিলেন। আমার দুটি ছেলের নাম মায়ের দেওয়া।১৯৮৮ বড় ভাই হঠাৎ করেই মারা গেলেন। দেখেছি মা কিভাবে ভাইয়ের দুই শিশু সন্তান তারাক্কী, স্নিগ্ধাকে আগলে রেখেছেন।

শেষ বয়সে মায়ের চোখের জ্যোতি কমে আসছিলো। একটি ড্রপ আমি নিয়মিত পাঠাতাম। ১৯৯৪ কোবানির ঈদের আগে মা সবাইকে নিয়ে ফরিদপুর যাওয়ার কথা বলেছিলেন। তখন আমি বিজিএসলের একটি বিশেষ কাজে ব্যাস্ত ছিলাম।  ঈদের কিছু দিন পর মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন যখন আমি বাখরাবাদ-চট্টগ্রাম গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইনের অনস্ট্রাম পিগ্গিং কাজে ব্যাস্ত।দ্রুত কুমিল্লা পৌঁছে শুভ্র-অভ্র আর ঢাকা থেকে রিফাত-সোহানীকে নিয়ে ফরিদপুর পৌঁছলাম। আমার জন্য দাফন-কাফন অপেক্ষায় ছিল। জানাজা শেষে নিজ হাতে মা’কে কবরে নামিয়েছিলাম। মা’র মৃত্যু আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ফরিদপুরে গ্যাস পাইপ লাইন নির্মিত হলে আমি মায়ের এবং প্রবাসী আমেনা চাচির উনোনে গ্যাস শিখা জ্বালাবো। অপূর্ণ রয়ে গেলো সেই স্বপ্ন। তবে ইদানিং সিদ্ধান্ত নিয়েছি ইফফাত মঞ্জিল সংরক্ষণ করার।

রাবির হ্যাম হুম কাঁ রাব্বিয়ানি  সগীরা।  জগতের সব মায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা। মা শিখিয়েছিলেন মানুষ তার কৃতকর্ম সাথে নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মায়ের আদর্শ ধারণ করবো।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seventeen − eleven =