সানজিদা নূর: ২১তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশ প্যানোরমা সেকশনে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার অর্জন করলো ‘সাঁতাও’ সিনেমা। ২২ জানুয়ারি উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে পুরস্কার গ্রহণ করেন নির্মাতা খন্দকার সুমন। এছাড়া ভারতের মহারাষ্ট্রে ‘অজন্তা-ইলোরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে’র অষ্টম আসরের ফিপ্রেসকি বিভাগে প্রতিযোগিতা করেছে সিনেমাটি।
কৃষকের সংগ্রামী জীবন, নারীর মাতৃত্বের সর্বজনীন রূপ, সুরেলা জনগোষ্ঠীর সুখ-দুঃখ, মাতৃত্বহীনতা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনের চিত্র, টানাপোড়নে ঘেরা গ্রামের মানুষের জীবন, প্রাণীর প্রতি অসীম প্রেম, গ্রামীণ ঐতিহ্য, নদী পাড়ের মানুষের জীবনযাপন, রংপুর জনপদের মানুষের গল্প, প্রকৃতির নিজস্ব রূপ, অসহায়ত্ব, মানবিকতা, পরস্পরের সহযোগিতা, স্ত্রীর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা; সবকিছুর মিশেলে হাসি-কান্নায় আবর্তিত হয়েছে ‘সাঁতাও’ সিনেমার কাহিনি।
সিনেমার নাম কেন রাখা হয়েছে ‘সাঁতাও’ তা নির্মাতা স্পষ্ট করেছেন। মূলত রংপুর অঞ্চলের একটি শব্দ ‘সাঁতাও’; যার মানে হচ্ছে সাত দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টিপাত হওয়ার সময়। বৃষ্টির মধ্যে গৃহবন্দী একজন মানুষের মনোভাব ফুটে উঠেছে ‘সাঁতাও’ সিনেমায়। তাই ইংরেজিতে সিনেমার নাম রাখা হয়েছে ‘গবসড়ৎরবং ড়ভ এষড়ড়সু সড়হংড়ড়হং’। সিনেমাটিতে মূলত মাটি আর মাতৃত্বের গল্প বলা হয়েছে। সিনেমার গল্প এগিয়ে চলে একজন কৃষক এবং তার গৃহপালিত পশু ও স্ত্রীকে কেন্দ্র করে। সদ্য বিয়ে করা এক কৃষকের সারাবেলা কাটে খেতখামারে। একাকিত্ব ভর করে স্ত্রীর মাঝে। সন্তান গর্ভধারণের সময় ফুটফুটে শিশুটির মৃত্যু হয়। একাকিত্ব দূর করতে স্ত্রীর সঙ্গী হয় একটা গরু। নাম তার ‘লালু’। তাকে নিয়ে সারাবেলা কেটে যায়। কৃষক আর কৃষকের বউ, সঙ্গে একটা গৃহপালিত পশু; তাদের ঘিরেই এগিয়ে চলে সিনেমা।
সিনেমায় অনেক শিল্পীর আগমন ঘটেনি। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফজলুল হক ও আইনুন পুতুল। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার মাধ্যমে বড় অভিনেত্রী হিসেবে পর্দায় অভিষেক হয়েছে আইনুন পুতুলের। দীর্ঘদিন থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত এই অভিনেত্রী। সিনেমায় অনবদ্য পারফরম্যান্স করেছেন। রংপুর অঞ্চলের নারীদের ক্যারেক্টর ধারণ করেছেন নিজের মাঝে। কথা বলার ভঙ্গিমায়, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, হাঁটাচলা, অভিনয়ে যার ছাপ দেখা গিয়েছে। মনে হয়েছে সেই অঞ্চলের একজন নারী আইনুন পুতুল। তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’ সিনেমায় রুহুল চরিত্রে অভিনয় করা ফজলুল হককে দীর্ঘদিন পর দেখতে পেলাম বড় পর্দায়। মূল চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন। চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। পর্দায় ফুটিয়ে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে সময় নেননি। প্রতিটি সিকুয়েন্সে নিজের পরিপক্বতার ছাপ রেখেছেন। বেশ কিছু সিকুয়েন্সে ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন ছিল অসাধারণ। সংলাপ প্রয়োগে জড়তা দেখা যায়নি। রংপুর অঞ্চলের ভাষা রপ্ত করেছেন দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে তা টের পাওয়া যায়। স্বল্প সময়ের জন্য ফজলুল হকের সঙ্গে দেখা যায় সাক্ষ্য শাহীদকে। সিনেমার একটা নেগেটিভ দিক হচ্ছে অনান্য চরিত্র গুলোকে স্টাবলিশ করা হয়নি। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা দুজন শিল্পীকেই সিংহভাগ স্ক্রিন টাইম দেওয়া হয়েছে।
‘সাঁতাও’ সিনেমার টেকনিক্যাল পার্ট নিঃসন্দেহে চমৎকার। বেশ কিছু সিকুয়েন্স চোখে লেগে থাকার মতো। বিশেষ করে মাছ ধরার দৃশ্যটা অসাধারণ। পাখির চোখে দৃশ্যটা যখন পর্দায় দেখানো হচ্ছিল, মনে হলো মাছ ধরার দৃশ্যটা একদম কাছ থেকে দেখছি। রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে শুটিং হয়। উত্তরবঙ্গের সৌন্দর্য ক্যামেরার বন্দী করেন সিনেমাটোগ্রাফার। গ্রামবাংলার দৃশ্য গুলো চোখে তৃপ্তি দিয়েছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আবহের সঙ্গে মিল রেখে করা হয়েছে বলতে হয়। কালার গ্রেডিং সুন্দর হয়েছে। এডিটিং খারাপ বলার সুযোগ নেই।
সবচেয়ে অসাধারণ ছিল সিনেমার গান নির্বাচন। ভাওয়াইয়া গান বাংলা চলচ্চিত্রে ফিরিয়ে আনার একটা প্রয়াস চালিয়েছেন নির্মাতা। কামরুজ্জামান রাব্বির কণ্ঠে ‘মনটায় মোর পিঠা খাবার চায়’ শিরোনামের গান এতটাই রিলেট করা সম্ভব হয়েছে যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বাঙালির পিঠার প্রতি যে আলাদা টান তা ফুটে উঠেছে গানের কথায়। অনেকদিন পর গ্রামীণ বাংলার শাশ্বত রূপ দেখা গেল বাংলাদেশের সিনেমার গানে। ভাওয়াইয়া ধাঁচের এই গানে কৃষকের ধান কাটা থেকে শুরু করে পিঠা বানানো, ধৈর্য ধরে পিঠা তৈরির প্রক্রিয়ার সাথে জুড়ে থাকা, আগুনের আঁচে শীত পোহানো, আগুনের পাশে বসে গান শোনা; সব পরিচিত দৃশ্যাবলী দেখা যায় গানের দৃশ্যায়নে। নুরুল ইসলাম জাহিদের লেখা এই গানের সংগীত আয়োজন করেছেন মাহামুদ হায়াত অর্পণ, যিনি নাট্যনির্মাতা ভিকি জাহেদের বেশিরভাগ প্রোডাকশনে কাজ করে বেশ প্রশংসিত হয়েছেন। রংপুরের বিয়ের গীত ব্যবহার করায় আলাদা মাত্রা যোগ করেছে সিনেমার মিউজিক ডিপার্টমেন্টে। সিনেমার সবচেয়ে দুর্বলতার জায়গা হচ্ছে গল্প। সাদামাটা গল্প। চিরচেনা গল্প। বর্তমান সময়ে এসে এরূপ ঘরানার গল্প আমজনতার কাছে ভালো না লাগাটা স্বাভাবিক। চিত্রনাট্য কোনো টুইস্ট নেই বললেই চলে। খুবই ধীরগতিতে এগিয়ে চলে সিনেমার গল্প। গল্পের দিকে নির্মাতা আরেকটু জোর দিতে পারতেন।
গণঅর্থায়নে নির্মিত চলচ্চিত্র হিসেবে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা স্বীকার করতেই হবে। ‘সাঁতাও’ সিনেমায় অবশ্যই সংশোধনের জায়গা রয়েছে। নির্মাতা খন্দকার সুমনের স্ট্রাগল অস্বীকার করা যাবে না। নির্মাতার আসনে বসে সিনেমাটা দর্শকদের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে লড়াই করেছেন তা এই জেনারেশনের দর্শকদের কতটা স্পর্শ করবেন জানা নেই। নিঃসন্দেহে একজন বীরের মতো লড়াই করে সিনেমাটা নির্মাণ করেছেন নির্মাতা খন্দকার সুমন। নিজের নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সবকিছু মিলিয়ে একবারে অখাদ্য তা বলার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এই সময়ের অসংখ্য নির্মাতার চেয়ে হাজার গুণে ভালো সিনেমা নির্মাণ করেছেন তিনি। ইতিপূর্বে ‘সাঁতাও’ নির্মাতা খন্দকার সুমন ‘পৌনঃপুনিক’ ও ‘অঙ্গজ’ নামে দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃতও হয়েছে ‘পৌনঃপুনিক’। নির্মাতার বড় পর্দায় ভালো কিছু করার প্রয়াস চালিয়েছেন তাকে সাহস দেওয়ার জন্য সিনেমাটি হলে গিয়ে উপভোগ করা প্রয়োজন।
সিনেমা: সাঁতাও। নির্মাতা: খন্দকার সুমন। দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। অভিনয়: আইনুন পুতুল, ফজলুল হক, মো. সালাউদ্দিন, সাবেরা ইয়াসমিন, সাক্ষ্য শাহীদ, শ্রাবণী দাস রিমি, চিনু, আবদুল্লাহ আল সেন্টু প্রমুখ।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে ক্লিক করুন: সিনেমালজি