নাহিন আশরাফ
রান্না তো কমবেশি সবাই করতে পারেন। ছোটবেলা দাদী, নানী ও মায়েদের দেখে দেখে রান্না শিখে ফেলার ব্যাপারটা নতুন না। কিন্তু এখন আমাদের দেশের নারীরা শুধু নিজের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে না রেখে নিজের শখের রান্না পৌঁছে দিচ্ছে সবার ঘরে। এতে করে কষ্ট ছাড়াই যেমন ঘরোয়া খাবার উপভোগ করতে পারছেন সবাই তেমনি নারীরাও হয়ে উঠছে স্বাবলম্বী। রান্না তো বাঙালি নারীর প্রতিদিনের রুটিন। কিন্তু তা যদি হয়ে যায় পেশা তাহলে ক্ষতি কি! তেমনি একজন নারী নিঘাত রিয়াজ সাকী।
বেড়ে উঠেছেন ঢাকার টিকাটুলি এলাকায়। সাত ভাইবোনের মধ্যে পাঁচ নাম্বার তিনি। বাবার ভীষণ প্রিয় সন্তান তিনি। সব ভাইবোনের চাইতে তার প্রতিই যেন টানটা বেশি ছিল বাবা। তিনিও বাবাকে শ্রদ্ধা করতেন, মনে পড়ে না কখনো বাবার অবাধ্য হয়েছেন কি না। সবসময় বাবা যা করতে বলতেন তিনি তাই করতেন। বাবার কাছে খুব বেশি আবদারও করতেন না। বেশিরভাগ মেয়েদের রান্নার শেখা শুরু হয় মায়ের কাছ থেকে। কিন্তু সাকী প্রথম রান্না শিখেন তার বাবার কাছে। বাবা ভীষণ ভালো রান্না করতেন। শুধু বাবা না পরিবারের সকল পুরুষদেরই দেখেছেন রান্না প্রতি নারীদের থেকেও বেশি আগ্রহ।
কামরুন্নেসা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করে, উচ্চ মাধ্যমিকে জন্য ভর্তি হন সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে। কলেজের গণ্ডি পার করে পরিবারের ইচ্ছায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নতুন জীবনে পা রাখেন তিনি। পড়াশোনার প্রতি ছোটবেলা থেকেই ভীষণ ঝোঁক ছিল তার, তাই বিয়ের পর ইডেন কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে বেশ কিছুদিন একটা এড ফার্মে কাজ করেন। বিয়ের পর শশুরবাড়ি থেকে সবসময় সহযোগিতা পেতেন। তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হতো যেকোনো ধরনের কাজ করার জন্য। বিয়ের পর সংসার গুছিয়ে, দুই সন্তান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান সাকী। কিন্তু সংসারের ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি পড়ালেখা বন্ধ করে দেওয়ার কথা কখনো ভাবেননি। পরিবারের ইচ্ছায় মাস্টার্স শেষ করেন।
ভালো-খারাপ মিলিয়ে দিন পার হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ পৃথিবীজুড়ে দেখা দেয় করোনা মহামারি। অনেকের চাকরি চলে যায় ও ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। সাকীর স্বামী এয়ারলাইন্সে চাকরি করতেন, তিনি করোনার সময় চাকরি হারান। সাকী ছোটবেলায় শখের বসে রান্না করলেও পুরো রাঁধুনি হয়ে উঠেন বিয়ের পর। সাকীর রান্নার প্রশংসা পুরো পরিবার জুড়েই ছিল। কিন্তু স্বামীর চাকরি যাওয়ার পর তার শশুরবাড়ির সবাই তাকে উৎসাহ দেন একটি ক্যাটারিং সার্ভিস শুরু করার জন্য। তাদের অনুপ্রেরণাতেই ২০২০ সালে ফেসবুক পেইজ খুলেন ‘সাকী’স টিফিন ক্যারিয়ার’ নামে। প্রথমে পরিবার ও বন্ধুমহল থেকেই খাবারের অর্ডার পেতে থাকেন। কিছুদিন পরেই ২৫ জনের জন্য খাবারের একটি অর্ডার পান সাকী। করোনার সময় গৃহবন্দী অনেকের ঘরে তিনি রান্না করে পৌঁছে দিতেন, বিশেষ করে যারা করোনায় আক্রান্ত ছিলের। রান্না করতে ভালোবাসলেও কখনো যে এর মাধ্যমে উপার্জন করতে পারবেন তা তিনি চিন্তা করেনি। কাস্টমারদের জন্য খুব যত্ন সহকারে রান্না করেন তিনি, কখনো ফ্রিজে থাকা উপাদান দিয়ে রান্না করেন না। ফ্রেশ খাবার বানানোর জন্য তার পেইজের নিয়মাবলিতে বলে দেওয়া আছে যাতে তিনদিন আগে খাবারের অর্ডার করা হয়। এতে করে তিনি বাজার করার সময় পান ও ফ্রেশ জিনিস দিয়ে খাবার তৈরি করতে পারেন। কারণ তার কাছে কোয়ালিটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে খাবার তিনি নিজে খাবেন না কিংবা তার পরিবারকে দিবেন না সে খাবার তিনি কাস্টমারদের জন্যও তৈরি করেন না। ভালো মানের খাবার কাস্টমারদের পৌঁছে দিলে তিনি তৃপ্তিবোধ করেন। তাই তিনি সর্বোচ্চ খেয়াল রাখেন খাবারের কোয়ালিটির দিকে।
সাকী’স টিফিন ক্যারিয়ারের আরেকটি ভিন্নধর্মী আয়োজন হলো কিটো ডায়েটের খাবার। বর্তমানে কিটো একটি জনপ্রিয় ওজন কমানোর ডায়েট। ওজন কমানোর জন্য বেশিরভাগ মানুষ এখন কিটো ডায়েট অনুসরণ করছে। কিন্তু কিটো ডায়েট অনুসরণ করার জন্য খাবারের কঠোর নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। যা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। বিশেষ করে কর্মজীবী নারীদের কাজ সামলে ডায়েটের জন্য আলাদা করে খাবার তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিটো ডায়েট করে যারা ওজন কমাতে চান তাদের জন্য তিনি কিটো ফ্রেন্ডলি খাবার তৈরি করে ঘরে পৌঁছে দেন। এতে অনেকেই খুব সহজে হেলদি লাইফ স্টাইল মেন্টেন করতে পারেন। কিটো ডায়েটে যেসব খাবার খাওয়ার অনুমতি রয়েছে তিনি সেসব খাবার মজাদার উপায়ে তৈরি করে থাকেন।
তার কিচেনের কোন আইটেম সবাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রমজান মাসে তার তৈরি হালিম এবং দইবড়া সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এছাড়া তেহারি এবং শাহি রোস্ট সকলে পছন্দ করে থাকে। তার তৈরি করা জলপাই ও আমের টক-মিষ্টি আচার সকলের অনেক প্রিয়। এছাড়া তার পেইজে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের ডেজার্ট আইটেম। নাস্তার আইটেমের মধ্যে মোমো, স্যান্ডউইচ, কাবাবসহ বিভিন্ন আইটেম রয়েছে। এছাড়া তার তৈরি করা মেনু ছাড়াও ক্রেতার বিভিন্ন খাবারের চাহিদা থাকে সেসব খাবার তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তার পেইজের প্রতিটি খাবারের দাম তিনি নির্ধারণ করে থাকেন বাজার অনুযায়ী। যেহেতু বাজরে শাকসবজি, তরকারি, মাছ-মাংস ও বিভিন্ন ধরনের মশলার দাম ওঠানামা করে তাই তার আইটেমের দামও সেভাবে বাড়ে এবং কমে।
হোম ক্যাটারিংয়ের পেশায় তিনি কোন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খাবারের দাম শুনে যখন ক্রেতা যখন বলেন এতো দাম কেন, তখন তিনি খুব বেশি হতাশ হন। কারণ তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন বাজারের ভালো মানের জিনিস দিয়ে খাবার রান্না করতে। সেসব জিনিস কিনতে গিয়ে তার খরচ বেশি হয়। তাছাড়া তিনি অনেক যত্ন নিয়ে ও শ্রম দিয়ে রান্না করেন। তাই সবকিছু বিবেচনা করেই দাম নির্ধারণ করতে হয়। অপ্রয়োজনে তিনি অবশ্যই বাড়তি দাম রাখেন না। এছাড়া তিনি প্যাকেটে এমন পরিমাণ খাবার দেওয়ার চেষ্টা করেন যাতে খেয়ে সবাই তৃপ্ত হন। পরিমাণ নিয়ে কারো যাতে অভিযোগ না থাকে।
নিঘাত সবসময় ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসেন। বিয়ের পর থেকেই কখনো পড়াশোনা আবার কখনো রান্না নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। জীবনের অনেক হতাশার সময়ও তিনি থেমে থাকেননি। তিনি মনে করেন, নারীদের চলার পথে সবচেয়ে আপন হচ্ছে তার পরিবার। তিনি জীবনে যতটুকু যা করেছেন তার পুরোটাই পরিবারের জন্য। পরিবার তার সব কাজে আগ্রহ দেখিয়েছে ও তাকে সাহস দিয়েছে। যৌথ পরিবারে শশুর-শাশুড়ি ও দেবর সবাইকে তিনি সবসময় তার সকল কাজে তাদের পাশে পেয়েছেন। সন্তান সংসার সবকিছু সামলে নিজের পেইজের কাজ চালিয়ে যাবার জন্য তাকে অনেক বেশি ধৈর্য ও সময় ম্যানেজ করে চলতে হয়।
রান্নাবান্নায় গৃহকর্মী সাহায্য করলেও তিনি চেষ্টা করেন বেশিরভাগ কাজ নিজের হাতে করার জন্য। রান্নার জন্য তিনি নিজেই বিভিন্ন ধরনের বিশেষ মসলা তৈরি করে থাকেন। তিনি মনে করেন, সেসব মসলাই তার রান্নাকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে সাহায্য করে। রান্নাকে ভালোবাসা ছাড়া কোনোদিনই রান্না নিয়ে কাজ করা যায় না বলে মনে করেন সাকী। সুন্দর রান্না করতে হলে একজন রাধুনিকে অবশ্যই খাদ্যরসিক হতে হবে। সব রকমের মসলার স্বাদ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর