সালেক সুফী
সদ্য সমাপ্ত দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম ( সাফ) ফুটবল প্রতিযোগিতায় শক্তিশালী নেপালকে ওদের মাঠে ২-১ গোলে পরাজিত করে শিরোপা অক্ষুন্ন রেখেছে বাংলাদেশ মেয়েদের ফুটবল দল। উপর্যুপরি সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা খেলাধুলোয় মেয়েদের অধিকার সমুন্নত করেছে। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে উজ্জ্বল করেছে। প্রথম ম্যাচে পরিবর্তিত শক্তিশালী পাকিস্তান দলের সঙ্গে ১-১ ম্যাচ ড্র করার পর দ্বিতীয় ম্যাচে শক্তিশালী ভারতকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দারুন ভাবে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। সেমি ফাইনালে ভুটানকে ৭-১ ব্যাবধানে গোল বন্যায় ভাসিয়ে স্বাগতিক নেপালের বিরুদ্ধে ফাইনাল খেলে। কাঠমুন্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে উপস্থিত ১৫,৫০০ নেপালি দর্শকের মুহুর্মুহু নেপাল নেপাল ধোনি উপেক্ষা করে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে ২-১ ব্যাবধানে শিরোপা জয় করে বাংলাদেশ। রূপনা চাকমা দ্বিতীয় বারের মত দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গোল রক্ষকের পুরুস্কার জিতেছে। ফাইনালে বিশ্বমানের গোল এবং টুর্নামেন্ট জুড়ে অসাধারণ ফুটবল খেলে ঋতুপর্ণা চাকমা পেয়েছে সেরা খেলোয়াড় উপহার।
২০২২ সালে একই প্রতিদ্বন্দীর বিরুদ্ধে ৩-১ ব্যাবধানে ম্যাচ জয় করে প্রথম বার শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। সেবারে দলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় সানজিদা আক্তারের অভিপ্রায় অনুযায়ী খোলা বসে ছড়িয়ে ঢাকা বিমান বন্দর থেকে বিএফএফ কার্যালয়ে এনে অভিনন্দন জানায় হয়। কাল একই ভাবে এবারের বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। কোনো খেলার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপর্যুপুরি শিরোপা অর্জন একটি বিরল ঘটনা। আর এই কৃতিত্ব অর্জন করে সাবিনা, রূপনা, তহুরা, মনিকা, ঋতুপর্ণা, মারিয়া, প্রান্তি সহ গোটা দোল বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে অরুন আলোতে উদ্ভাসিত করেছে। নিজেদের থেকে উচ্চতর রাংকিং এবং অধিকতর সুযোগ সুবিধা পাওয়া ভারত, নেপাল দলকে মাঠের খেলায় পৰ্যদস্ত করে প্রমান করেছে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা এবং ক্রমাগত শক্তিশালী দলগুলোর বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ পেলে অচিরেই বাংলাদেশ ফুটবল দল এশিয়া এমনকি বিশ্ব পর্যায়ে নিজেদের অবস্থান করে নিতে পারবে।
আমরা সবাই জানি রক্ষলশীল সমাজে নানা বাধা বিপত্তির অচলায়তন পেরিয়ে বাংলাদেশ কিশোরী মেয়েদের ফুটবল খেলতে হয়। তদুপুরি অধিকাংশ মেয়েরা এসেছে প্রান্তিক পরিবার থেকে। টাঙ্গাইলের কাল সিন্দুর অথবা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি মেয়ে সহ দলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের খেলা শুরু এবং জীবন যুদ্ধ রীতিমত রূপকথার কাহিনী। সমাজের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা বৈরী প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে উঠে এভাবে শিরোপা জয় মেয়েদের অদম্য সহজ আর ইস্পাত কঠিন মনোবলের প্রতিফলন। সাবিনা, ঋতুপর্ণা। মনিকা, রূপনারা নিঃসন্দেশে “আমরাও পারি” প্রমান করেছে। ওদের সাফল্যের ধারবাহিক পথে মেয়েদের খেলাধুলা বিশেষত ফুটবলকে এই নিতে হলে ছাদ খোলা বসে একদিনের অভিনন্দন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্বর্ধনার পাশাপাশি মেয়েদের খেলার সঠিক অবকাঠামো এবং যথাযথ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা জরুরি।
আমি বাফুফের মহিলা কমিটিকে নিঃসন্দেহে সাধুবাদ দিবো মেয়েদের বাফুফে ভবনে রেখে দীর্ঘসময়ে অনুশীলন সুযোগ করে দেয়ার জন্য। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত, নেপাল এমনকি পাকিস্তান, ভুটানের মত পর্যাত সুযোগ সুবিধা নেই মেয়েদের জন্য। সামান্য মাসিক বেতন দেয়া হয়। সেটাও অনিয়মিত। দেশে নিয়মিত স্থানীয় লীগ খেলা হয় না। আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা সম্ভব হয় না অর্থের অভাবে। এতো কিছুর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এবারে বাংলাদেশ দল ভালো খেলেই জিতেছে শিরোপা। ওদের এই বিজয় আরো উন্নত পরিবেশ, স্থায়ী অনুশীলন, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, দেশব্যাপী মেয়েদের খেলাধুলার উন্নত ব্যবস্থা সংরক্ষনের দাবি প্রতিষ্ঠিত করেছে। ছেলেদের দলে গোড়ার পাশাপাশি কেন বসুন্ধরা, আবাহনী, মোহামেডান সহ বড় দলগুলোর মেয়েদের দল থাকার বাদ্ধবাধকতা থাকবে না। কেন দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মেয়েদের স্থায়ী প্রণোদনা দিতে বাড়বে না?
দেশে এখন দল নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সরকার প্রধান নিজেও ক্রীড়াপ্রেমিক। বিএফএফ নতুন কমিটি পরিবর্তনের শুভ বার্তা নিয়ে এসেছে। মেয়েদের অনাবিল সাফল্যকে পুঁজি করে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ফুটবল এগিয়ে যাক সেই প্রত্যাশা করতেই পারি আমরা যারা মেয়েদের ফুটবলের হামা গুড়ি দেয়া শিশুকাল দেখেছি। মেয়েদের এই দলটি কিন্তু জাতীয় ঐক্যের প্রতীক বদলে যাওয়া বাংলাদেশের আলোর দিশারী।