সাহিত্যে ভরসা খুঁজছে টালিউড

এক দশক আগেও টালিউডের বাংলা সিনেমা মানেই ছিল দক্ষিণি ইন্ডাস্ট্রির অন্ধ অনুকরণ। সেগুলোই হইহই করে দেখত লোকে। পরবর্তী সময়ে অনেক নতুন নির্মাতা আসেন ইন্ডাস্ট্রিতে। তাঁরা মৌলিক গল্প দিয়ে বাজিমাত করেন। ইদানীং হয়তো নিজেদের গল্পের ওপর ভরসা হারিয়েছেন নির্মাতারা। তাঁদের প্রধান ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে সাহিত্য আর গোয়েন্দা গল্প। সাহিত্য থেকে উঠে আসা গোয়েন্দা চরিত্র নিয়ে সিনেমা-সিরিজ তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি এমন অনেক সিনেমা তৈরি হচ্ছে, যেগুলো বিখ্যাত লেখকের উপন্যাস অথবা গল্প অবলম্বনে।

টালিউডে এখন সবচেয়ে ঝুঁকিহীন বিষয় গোয়েন্দা গল্প। বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট চরিত্র ফেলুদা ও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট ব্যোমকেশ। একই গল্প নিয়েও ভিন্ন ভিন্ন পরিচালক একই সময়ে সিনেমা-সিরিজ বানাচ্ছেন। এ সপ্তাহেই মুক্তি পেয়েছে দেবের ‘ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য’। পাশাপাশি সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘মিতিন মাসি’, সুজন দাশগুপ্তর ‘একেন বাবু’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘শবর’, স্বপন কুমারের ‘দীপক চ্যাটার্জি’—এ গোয়েন্দা চরিত্রগুলোও পর্দায় উঠে আসছে। এ ছাড়া কল্লোল লাহিড়ীর লেখা ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দত্তা’র মতো সাহিত্যকর্ম নিয়েও কাজ হচ্ছে।

হঠাৎ করে টালিউডের সাহিত্যে ঝুঁকে পড়ার কারণ কী? এটার কারণ কি মৌলিক গল্পের অভাব, নাকি শুধুই একটা প্রবণতা? বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন টালিউডের নির্মাতারা। অরিন্দম শীল বানাচ্ছেন গোয়েন্দা গল্প ‘মিতিন মাসি’। এর আগে আরও দুই গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ ও শবরকে পর্দায় নিয়ে এসেছিলেন তিনি। অরিন্দম স্বীকার করলেন মৌলিক গল্পের অভাবের কথা। তিনি বলেন, ‘বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে মৌলিক গল্পের অভাব অবশ্যই আছে। আমাদের বাংলা সাহিত্যে যে রত্নভান্ডার আছে, সেগুলো সিনেমার জন্য খুবই উপযোগী। আমার নির্মিত সিনেমাগুলোর ৭০-৮০ শতাংশ এসেছে সাহিত্য থেকে।’

নির্মল চক্রবর্তী, যিনি শরৎচন্দ্রের গল্প নিয়ে সম্প্রতি দত্তা বানিয়েছেন, তিনি বলছেন, ‘আমি সব সময় চেয়েছিলাম কোনো ক্ল্যাসিক সাহিত্য নিয়ে সিনেমা বানাতে। দর্শক সহজেই এর সঙ্গে রিলেট করতে পারেন। এখন যাঁরা সাহিত্য নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছেন, তাঁরা হয়তো কেউ গল্পের মূল স্টোরিলাইনটা নিচ্ছেন, কেউ গল্পকে এই সময়ে বদলে দিচ্ছেন। আমি মূলটাই রেখেছি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মের ভক্ত আমি। তা ছাড়া এই উপন্যাসের বিজয়া চরিত্রটি যেকোনো নারীর জন্য অনুপ্রেরণার।’

টালিউডের আরেক নির্মাতা রামকমল মুখোপাধ্যায় মহাভারতের গল্প নিয়ে বানাচ্ছেন ‘দ্রৌপদী’ নামের সিনেমা। তিনি বলেন, ‘আমার মতে, সিনেমায় সাহিত্যকে অ্যাডাপ্ট করতে হবে, কপি নয়। সত্যজিৎ রায় আমাদের শিখিয়ে গেছেন কীভাবে সাহিত্য নিয়ে সিনেমা করতে হয়।

আমার সিনেমা দ্রৌপদী তৈরি হচ্ছে প্রতিভা রায়ের উপন্যাস অবলম্বনে। মিথোলজি নিয়ে এখন বাংলা সিনেমায় তেমন কাজ হয় না, আমি এটাকে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছি।’

নির্মাতা দেবালয় ভট্টাচার্য ব্যোমকেশ নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন, ইন্দুবালা ভাতের হোটেল নিয়ে বানিয়েছেন ওয়েব সিরিজ। এখন তিনি কাজ করছেন স্বপন কুমারের ‘বাদামি হায়েনার কবলে’ গল্প নিয়ে। দেবালয় বলেন, ‘আমার মনে হয় দর্শক এখন এমন গল্প পছন্দ করেন, যেটাতে বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। আর এটার নিশ্চয়তা শুধু সাহিত্যই দিতে পারে। সাহিত্যকর্ম নিয়ে সিনেমা তৈরি একটা স্বাস্থ্যকর প্রবণতা। এটা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধও করে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা গল্প অবলম্বনে মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছেন সুমন ঘোষ। তিনি বলেন, ‘এই দ্রুত ধাবমান আধুনিক জীবনযাপন থেকে মানুষ কখনো কখনো মুক্তি চায়। তারা ফিরতে চায় পুরোনো দিনের সমৃদ্ধ সাহিত্যে, যেটা আমাদের ঐতিহ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকদের গল্প দর্শক পর্দায় দেখতে চায়। সে কারণে আমরা সাহিত্য নিয়ে কাজ করছি।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 × two =