সিনেমার বয়স ৩০ বছর

মৌ সন্ধ্যা

এরইমধ্যে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার বয়স হয়ে গেছে ৩০ বছর। ঢাকাই সিনেমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ এই সিনেমা। ত্রিশ বছর আগে ১৯৯৩ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় কেয়ামত থেকে কেয়ামত। চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন সোহানুর রহমান সোহান। এই সিনেমাটির কাছে ঢালিউড পেয়েছে অনেক কিছু।

সিনেমার অজানা কথা

নব্বই দশকের সফল এই সিনেমার পেছনের গল্প ক’জনইবা জানেন। সেই সময়ের দর্শক শ্রোতারা জানেন হয় তো! জানা গেছে, আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড হিন্দি ‘সনম বেওয়াফা’, ‘দিল’ ও ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এর কপিরাইট নিয়ে সোহানুর রহমান সোহানকে প্রস্তাব দেন, যেকোনো একটির রিমেক বানাতে। নায়ক-নায়িকা খুঁজে না পেয়ে নতুন মুখ দিয়ে ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন তারা। নায়িকা হিসেবে মৌসুমীকে চূড়ান্ত করেন। নায়ক হিসেবে প্রথমে তৌকীর আহমেদ ও পরে নোবেলকে প্রস্তাব দিলে তারা ফিরিয়ে দেন। তখন নায়ক আলমগীরের সাবেক স্ত্রী খোশনুর আলমগীর ‘ইমন’ নামের এক ছেলের সন্ধান দেন। প্রথম দেখাতেই তাকে পছন্দ হয় পরিচালকের, সনম ‘বেওয়াফা’ রিমেকের প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইমন চাইছিলেন, ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ হোক। কারণ, ছবিটি তিনি ২৬ বার দেখেছেন। শেষ পর্যন্ত পরিচালক সোহান ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ইমনের নাম পরিবর্তন করে সালমান শাহ রাখেন।

যেভাবে নায়িকা মৌসুমী

নব্বই দশকে আনন্দ বিচিত্রা ফটোসুন্দরী নির্বাচিত হয়ে টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন মৌসুমী। ১৯৯৩ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক। কিভাবে এই সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন নায়িকা মৌসুমী। বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎকারে গণমাধ্যমের কাছে সেই গল্প শুনিয়েছেন মৌসুমী। এক সাক্ষাৎকারে নায়িকা বলেন, “আমার সিনেমার প্রস্তাবগুলো আসত গুলজার (পরিচালক মুশফিকুর রহমান) ভাইয়ের মাধ্যমে, তখন তিনি সাংবাদিকতা করতেন। সাক্ষাৎকার নিতে একদিন ঢাকায় আমাদের মোহাম্মদপুরে হুমায়ূন রোডের বাসায় এসেছিলেন, সঙ্গে ভাই-বন্ধু হয়ে এসেছিলেন সোহান ভাই। চলচ্চিত্রে আগ্রহী কি না, কৌশলে জানতে চান। তখন আমি মডেলিং করি। মধ্যবিত্ত পরিবার, তাই নাটকে অভিনয়ের চেষ্টা করিনি। গুলজার ভাই বললেন, ‘ধরুন, হিন্দি ছবি কেয়ামত সে কেয়ামত তক যদি বাংলায় রিমেক হয়, আপনি জুহি চাওলার চরিত্রটা করবেন, আমির খানের চরিত্রে নোবেল, তৌকীর আহমেদ কিংবা জাহিদ হাসানও হতে পারেন।’ তারা জানতেন, তৌকীর ভাই আর নোবেল ভাইয়ের ভক্ত আমি। তখন কিছুটা আগ্রহী হলাম। কারণ, সহশিল্পী হিসেবে পছন্দের শিল্পীরা থাকবেন। এরপর স্বপ্ন দেখা শুরু করি। কিভাবে বাসায় বলা যায়, উপায় খুঁজি। এরপর আরও অনেক ছবির প্রস্তাব পেয়ে আমি দ্বিধায় পড়ে যাই। মনে মনে বাছাই করতে থাকি, কার ছবি করব? ঘুরে ফিরে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমাতেই মনটা পড়ে থাকলো।”

আড়ালের ও প্রকাশ্যের মানুষেরা

এই সিনেমার আড়ালে ও প্রকাশ্যে যারা কাজ করেছেন তারা প্রত্যেকেই ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন। ১৯৮৮ সালে ভারতে মুক্তি পায় ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’। হিন্দি চলচ্চিত্রের কাহিনী লিখেছেন নাসির হোসেন খান, যার বাংলা চিত্রনাট্য লিখেছেন সোহানুর রহমান সোহান ও সংলাপ লিখেছেন আশীষ কুমার লোহ। চলচ্চিত্রটির প্রযোজক সুকুমার রঞ্জন ঘোষ এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন মৌসুমী, সালমান শাহ, রাজিব, আহমেদ শরীফ, আবুল হায়াত, খালেদা আক্তার কল্পনা প্রমুখ। এটি মৌসুমী ও সালমান শাহ অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র। এই ছবিতে আরও অভিষেক হয় কণ্ঠশিল্পী আগুনের।

কী আছে সিনেমায়

এই সিনেমায় দেখা যায়-মির্জা ও খান পরিবার একই গ্রামে দুটি প্রভাবশালী পরিবার। খান পরিবারের ছেলে খান বাহাদুর কবিরউদ্দিন মির্জা পরিবারের মেয়ে ডিম্পলের সাথে অবৈধ মেলামেশা থেকে ডিম্পল গর্ভবতী হয় পড়ে। জানাজানি হয়ে গেলে বড় মির্জা খান বাহাদুর রইসউদ্দিনের কাছে তাদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। কিন্তু কবিরউদ্দিন ভয়ে মিথ্যা বলে। বড় মির্জা ক্ষুদ্ধ হয়ে ফিরে আসে। কবির উদ্দিন ডিম্পলকে অস্বীকার করেছে জানার পর ডিম্পল আত্মহত্যা করে। মির্জা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ডিম্পলের মৃতদেহ নিয়ে খান বাড়িতে যায় এবং কবিরউদ্দিনকে খুন করে। সালাউদ্দিনের জেল হয়ে যায়। আর বড় মির্জা সবাইকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। বিশ বছর পর সালাউদ্দিন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তার ছেলে রাজের কলেজে গিয়ে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে। সালাউদ্দিন রাজকে গ্রামে একটি কাজের জন্য পাঠায়। সেখানে তার রেশমির সাথে দেখা হয়। পরে শহরে এসে তাদের আবার দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকে এবং সেই থেকে প্রেম। তাদের প্রেমের বিষয় জানাজানি হয়ে গেলে রেশমির বাবা খান বাহাদুর নাজিমউদ্দিন ও রাজের বাবা মির্জা মোহাম্মদ সালাউদ্দিন তাদের সামর্থ্যরে মধ্যে যা কিছু করতে পারে করবে বলে একে অপরকে শাসায়। কিন্তু রাজ রেশমি একে অপরকে খুব ভালোবাসে এবং তাদের সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য বিয়ের আসর থেকে রাজ রেশমিকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এভাবেই এগিয়ে যায় কাহিনী।

সংগীত

কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার প্রতিটি গান হিট করেছিল। বাবা বলে ছেলে নাম করবে, চাঁদনি রাতে তুমি আছো পাশে, এখন তো সময়, ও আমার বন্ধু গো শিরোনামের গানগুলো এখনো মানুষের মুখে ঘোরে ফেরে। চলচ্চিত্রটির সংগীত পরিচালনা করেন আনন্দ চিত্রগুপ্ত-মিলিন্দ চিত্রগুপ্ত ও আলম খান। গীতিকার ছিলেন মনিরুজ্জামান মনির। গানে কণ্ঠ দেন রুনা লায়লা ও খান আসিফ আগুন। গানের রেকর্ডিং হয় অনুপম রেকর্ডিং স্টুডিওতে।

৩০ বছর হওয়ায় যা বলেছিলেন নির্মাতা

সম্প্রতি না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান। সিনেমাটি নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘৩০ বছরে এসে কেউ আয়োজন করে আমার সিনেমার কথা স্মরণ করছেন, এটা তো অবশ্যই ভালো লাগার। আমাদের চলচ্চিত্রের জন্যও খুব ভালো দিক। তবে খুব বেশি করে ৩০ বছর আগের দিনটা মনে পড়ছে। কিভাবে ছবিটা মুক্তি পেল, কীভাবে ব্যবসা করল, আমি কিংবা আমার ছবির শিল্পীরা এ ছবির বদৌলতে কিভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন।’

শেষ কথা

চলচ্চিত্রটি ১৯৯৩ সালের ঈদুল ফিতরে মুক্তি পায়। সিনেমার পোস্টার বানানো হয়েছিল অন্যরকমভাবে। পোস্টারের লেখাগুলো তুলে ধরা হলো: উপমহাদেশের সাড়া জাগানো প্রেমকাহিনির ছবি। আসিতেছে ঈদুল ফিতরের শ্রেষ্ঠ ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। যে ছবি দেখার জন্য এখন থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি পরিলক্ষিত হচ্ছে দর্শকদের মধ্যে। সুধী দর্শকেরা বলছেন, এ ছবিই হবে ৯৩-এর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ফটোসুন্দরী মৌসুমী ও ‘লাভার বয়’ সালমান শাহ অভিনীত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবি ঝড় তুলবেই।

মুক্তির আগে এমন কথা লিখে পোস্টার ছাপায় দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহ। আজ সিনেমা মুক্তির ৩০ বছর পরে এসেও বলা যায় পোস্টারের সেই কথাগুলো সত্য হয়ে গেছে। সব সিনেমার পোস্টারের লেখা স্লোগান সাধারণত সত্য হয় না।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × five =