স্বপ্নবাজ রাফির দিন বদলের গল্প

মৌ সন্ধ্যা: কয়েকটা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সবার মন জয় করে নেন তিনি। এক মিনিট দেড় মিনিট দৈর্ঘ্যরে কাজগুলোর মধ্যে এমন আত্মবিশ্বাস আর মেধার ছাপ ছিল যা বড় প্রযোজকদের নজরে পড়ে যান রাফি। অনেকেই রায়হান রাফি’র রচনা ও পরিচালনায় নির্মিত ‘আজব বাক্স’ দেখেছেন। তাকে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি এনে দিয়েছিল এটি। বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত টেলিভিশন সিরিয়ালের কুপ্রভাবকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছিল রায়হান রাফির স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আজব বাক্স’। এরপরে আরও বেশ কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন রাফি। কিন্তু সিনেমা নির্মাণের স্বপ্ন যার মনে তাকে কী আর আটকে রাখা যায় স্বল্পদৈর্ঘ্য।

জীবন পাল্টে দিলো ‘পোড়ামন ২’
প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘পোড়ামন ২’ নির্মাণ করে সবাইকে চমকে দেন রায়হান রাফি। তার নির্মাণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় পুরো ইন্ডাস্ট্রি। এরপর তিনি মুন্সিয়ানা নিয়ে হাজির হন ‘দহন’ সিনেমায়। সেটিও দর্শক হলে টানতে সক্ষম হয়। দর্শক-সমালোচকের প্রশংসা পায়। এক মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলের হাত ধরে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি। তার গল্প ও নির্মাণের শক্তি মাতিয়ে রাখে দর্শকদের। দুটি সিনেমাতেই রাফি কাজ করেছেন সিয়াম-পূজা জুটিকে নিয়ে। অভিষেক থেকেই সবার মন জয় করে নেন সিয়াম-পূজা জুটি।

কেমন করে এমন রাফি?
রায়হান রাফি নিঃসন্দেহে এই সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক। কেমন করে এমন হয়ে উঠলেন রাফি সেই গল্প তিনি অনেকবার শুনিয়েছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে। তরুণ নির্মাতাদের জন্য এই গল্প অনুপ্রেরণা দেবে সব সময়। এক সাক্ষাৎকারে রাফি বলেছিলেন, ‘আমি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছি। সেখানে টিভি দেখা বা পত্রিকা পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু নিজের স্বপ্ন জগতে সিনেমার বিষয়গুলো সবসময় ঘুরপাক খেত। তাই চুরি করে পত্রিকা কিনে বিনোদনের নিউজগুলো পড়তাম। এসময় আগ্রহ আরো বাড়তে লাগলো। যখন সিনেমা দেখতাম তখন ছবির পরিচালকের নামের প্রতি খুব খেয়াল করতাম। এই নামটিই সব। এটি আমাকে খুব টানতো। আমি এই নাম নিয়ে ভাবতাম। আমার একটা ডায়েরি ছিল সেখানে ছবির নাম, পরিচালকের নাম লিখে রাখতাম। এভাবে নিজের মধ্যে একটা স্বপ্ন তৈরি হলো। চুরি করে বিনোদনের নিউজ পড়ার সময় একদিন তারেক মাসুদের নিউজ দেখি। পরবর্তীতে তার সঙ্গে দেখা করি। আমি যখন সিনেমা দেখতাম তখন মনে হতো আমি যদি গল্প বলি এর থেকে ভালো গল্প বলতে পারবো। আমি নিজে নিজে গল্প বানাতাম। এভাবে সিনেমার মধ্যে ঢুকে যাওয়া। তারপর মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে শর্ট ফিল্ম বানানো শুরু করলাম। আমি চেষ্টা করেছি শর্ট ফিল্মগুলো সিনেমার মতো করে বানাতে। বিগ বাজেটের শর্ট ফিল্মও তৈরি করেছি। আমার ‘বেওয়ারিশ’ নামে একটা শর্ট ফিল্ম ছিল; দেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে সেটা প্রদর্শন করা হয়েছে।

পোড়ামন ২ শুরু করার আগে একটি শর্ট ফিল্ম করি। সেটি ছিল খেলনা নিয়ে। গল্পটা এইরকম, আমাদের অনেকের বাসায় পুরোনো খেলনা আছে। সেগুলো আমরা ফেলে দেই বা কোথাও রেখে দেই। এই পুরনো ভাঙ্গা খেলনাগুলো যদি আমরা এমন মানুষকে দেই বা এমন বাচ্চাদের দেই যাদের কাছে এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাদেরকে টাকা দিলে খুশি হবে না কিন্তু এই ভাঙ্গা খেলনা দিলে খুব খুশি হবে। এই শর্ট ফিল্মটা আজিজ ভাই কারো মাধ্যমে দেখেছেন। দেখার পর তিনি তাকে বললেন, এই ছেলেটাকে আমার দরকার। ওকে নিয়ে আস। তারপর আমি দেখা করতে আসলাম। তিনি বললেন, আমি সবাইকে ইমোশনাল করে দেই। আর তুমি আমাকে ইমোশনাল করে দিয়েছ। এখন বল, সিনেমা বানাবা। আমি বললাম জি ভাইয়া, ছবিতো বানাবো এক সময়। ইচ্ছা আছে। তিনি গল্প চাইলেন। এরপর বেশ কিছু দিন পার হয়ে যায়। মাথায় কোনো ভালো গল্প আসে না। তারপর আবার একদিন আজিজ ভাই ডাকলেন। তিনি জাজের ওপর একটি ডকুমেন্টারি বানাতে বললেন। আমি কাজটি করলাম। এটা আজিজ ভাই খুব পছন্দ করলেন।

সিনেমার জন্য অনেক গল্প চিন্তা করছি কিন্তু তেমন কিছু মাথায় আসছে না। তারপর আবার বেশ কিছুদিন গ্যাপ। আমাকে গল্প দেওয়ার জন্য বলেন, কিন্তু ওই রকম গল্প আসে না। এরপর গল্প মাথায় আসলো। আজিজ ভাইকে বললাম। তিনি পছন্দ করে ফেললেন। বললেন, আমি এটাই বানাবো। নাম হবে ‘পোড়ামন ২’। আমি খুবই লাকি যে শুরুতেই জাজ মাল্টিমিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠান পেয়েছি। এখানে কাজ করার ক্ষেত্রে আমি যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। সিনেমা করতে গেলে বিভিন্ন সংকট দেখা দেয়। বাজেট সংকট বা অন্যান্য কিছু সমস্যা থাকে। কিন্তু এখানে আমি যা চেয়েছি, সবই পেয়েছি। এদিক থেকে আমি খুব হ্যাপি।’ এই হলো রায়হান রাফির শুরুর গল্প। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

রায়হান রাফির বিশেষ ও বর্তমান
রাফি পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র হলো পোড়ামন ২ (২০১৮)। এই চলচ্চিত্রের প্রধান তারকা অভিনেতা ছিলেন সিয়াম আহমেদ ও পূজা চেরি। একই বছর রাফি সিয়াম ও পূজাকে নিয়ে ‘দহন’ নামের আরেকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ২০১৯ সালে রাফি দুইটি নতুন চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। চলচ্চিত্রগুলির নাম ‘স্বপ্নবাজি’ এবং ‘পরাণ’। ২০২২ সালে মুক্তি পেয়েছিল পরাণ। বরাবরের মতো এই সিনেমাটিও প্রশংসিত হয়। রায়হান রাফির আলোচিত ওয়েব চলচ্চিত্রগুলো হলো: ‘জানোয়ার’ (২০২১), ‘দ্য ডার্ক সাইড অফ ঢাকা’ (২০২১), ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ (২০২১), ‘টান’ (২০২২), ‘৭ ফ্লোর নম্বর’ (২০২২) ‘নিঃশ্বাস’ (২০২২) ও ‘দামাল’ (২০২২)।

নতুন সিনেমার মহরত
সম্প্রতি মহরত হয়েছে রায়হান রাফির ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমার। এতে নায়ক হয়ে হাজির হতে যাচ্ছেন অভিনেতা আফরান নিশো। তার বিপরীতে অভিনয় করবেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী তমা মির্জা। সিনেমাটি যৌথভাবে প্রযোজনা করছে চরকি ও আলফা আই স্টুডিওজ। ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় শিল্পী ও কলাকুশলীদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় মহরত। খুব শিগগিরই সিনেমার শুটিং শুরু হবে জানিয়ে রায়হান রাফি বলেন, ‘সুড়ঙ্গ আমার অনেক পছন্দের একটা গল্প। অনেকদিন আগে থেকেই এই গল্পটা আমি বানাতে চাই। কিন্তু এই গল্পটা বানানোর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। কিছু কিছু গল্প শুধুমাত্র পরিচালক বা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মিলে সম্ভব নয়। স্ট্রং প্রযোজক দরকার হয়। সুড়ঙ্গের জন্য আমি এমন দুটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে পেয়েছি।’

শুভেচ্ছা ও সমাপ্তি
এতক্ষণ যে মানুষটির গল্প হলো তার জন্ম এই মার্চ মাসেই। ১৯৭৯ সালের ৩ মার্চ সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন রায়হান রাফি। তার জন্মদিনে রঙ বেরঙের পক্ষ থেকে রইলো ফুলেল শুভেচ্ছা। তার নির্মিত আরও অনেক অনেক চমৎকার সিনেমা দেখার অপেক্ষায় দর্শক।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × 3 =