অলকানন্দা মালা
গান শুধু মানুষকে বিনোদিত করে না। সাহসেরও যোগান দেয়। কখনও কখনও মেশিনগানের চেয়েও ভয়ংকর মারণাস্ত্রে রূপ নেয়। তাতে হয়তো রক্তপাত হয় না। কিন্তু কেঁপে ওঠে শাসকগোষ্ঠীর বুক। কখনও তো মসনদ ধুলায় লটায়। জুলাই বিপ্লব তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে জেগে উঠেছিল দেশের ছাত্র জনতা। সে সময় তাদের অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে বেশ কয়েকটি গান। বিপ্লব নিয়ে লেখা গানগুলো আন্দোলনকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল। শুধু কোটা আন্দোলন নয় বাংলাদেশের ইতিহাসে যতবার সংকট এসেছে ততবার ত্রাতা হিসেবে দাঁড়িয়েছে গান।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধেও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল সংগীত। দেশপ্রেমিক শিল্পীরা এক হয়েছিলেন কলকাতার ৫৭/৮ নাম্বার দোতলা বাড়িটিতে। সেখানে গড়ে তোলা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যোগাতেন যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা। তাদের গান শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন বীর যোদ্ধারা। তেমনই কয়েকটি গান নিয়ে আজকের আয়োজন।
শোনো একটি মুজিবরের থেকে
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেশপ্রেমিক বাঙালিদের মাঝে অনুপ্রেরণার আরেক নাম ছিল ‘শোনো একটি মজিবরের থেকে…’ গানটি। এটি লিখেছেন খ্যাতিমান গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তাতে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছিলেন ভারতীয় লোকসংগীত শিল্পী অংশুমান রায়। সে ১৯৭১ সালের এপ্রিলের কথা। ১৩ এপ্রিল বাজার করতে বেরিয়েছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। পথিমধ্যে বসেছিলেন চায়ের আড্ডায়। সঙ্গী ছিলেন অংশুমান রায়, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংগীতের অধ্যাপক দিনেন্দ্র চৌধুরী। তাদের সঙ্গে যোগ দেন কলকাতা আকাশবাণীর প্রযোজক উপেন তরফদার।
উপেন তরফদারের হাতে ছিল একটি টেপ রেকর্ডার। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের রেকর্ড ছিল তাতে। সে সময় জানান ভাষণটি সংবাদ বিচিত্রায় প্রচারিত হবে। কিন্তু বেশ ছোট। সঙ্গে যদি একটি গান থাকত তাহলে ভালো হতো। উপেন তরফদার বলতে যত দেরি গৌরীপ্রসন্ন কাগজ-কলম হাতে নিতে তত সময় নেননি। ওই চায়ের আড্ডায় বসেই লিখে ফেলেন শোনো একটি মজিবরের থেকে গানটি। পছন্দ হয় উপেন তরফদারের। সেদিনই রেকর্ড করেন তিনি। গানটি কণ্ঠে তোলেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন। সে রাতে সংবাদ-বিচিত্রা অনুষ্ঠানে গানটি বাজানো হয়। তখনও কেউ জানত না গানটি জলোচ্ছ্বাসের মতো ছড়িয়ে পড়বে বাংলা ভাষাভাষীদের মাঝে। সেটাই হয়েছিল। আংশুমানও গণ্ডি ছাড়ান গানটি দিয়ে। সেবারই প্রথম নিজের লোকগানের বাইরে এমন একটি গান করেন যা দুই বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে আজও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
নিজের লেখা ‘রক্তের মৈত্রী-বন্ধনে ভারত-বাংলাদেশ’ বইয়ে গানটি নিয়ে উপেন তরফদার লিখেছেন, “সেদিনের ‘সংবাদ-বিচিত্রা’ অংশুমানের গান আর বঙ্গবন্ধু মুজিবুরের রক্ত গরম করা সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কিছু অংশ নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। সেদিনের ভাষণে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আগামী দিনের লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মনে রাখবা-রক্ত যখন দিয়েছ-রক্ত আরও দেব-এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব-ইনশাল্লাহ-এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
সালাম সালাম হাজার সালাম
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আরও একটি কালজয়ী গান ‘সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে…’। এই গান মুক্তিকামী বীরজনতার কাছে ছিল মানসিক শক্তি বাড়ানোর হাতিয়ার। গানটির গায়ক কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী আব্দুল জব্বার। কথা লিখেছেন ফজল-এ-খোদা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হওয়ার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও তারও অনেক আগে লেখা হয় গানটি। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে গানটির জন্ম জড়িত। গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এটি লিখেছিলেন ফজল এ খোদা। লেখার আগে গায়ক বশির আহমেদের সঙ্গে শহীদদের স্মরণে একটি গান রচনা ব্যাপারে কথা হয় গীতিকারের। বশির আহমেদ এমন একটি গান চাইছিলেন যেখানে শহীদদের কথার পাশাপাশি বাংলার স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের কথাও থাকবে। এমন ভাবনা থেকেই কয়েকটি লাইন লিখে ফেলেন ফজল এ খোদা। ১৯৬৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল সেদিন। গানটি শুনে পছন্দ হয় বশির আহমেদের। সুর দেন তিনি। সেই সঙ্গে উর্দুতে তুলে নেন নিজের খাতায়। তবে গানটি শেষমেশ আর রেকর্ড করা হয়নি। হয়তো স্রষ্টার ইচ্ছা ছিল এই গানটি ১৯৭১ সালের অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত হবে। সেরকমই হয়েছিল। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১১ মার্চ। সেদিন রেডিওতে এসে আব্দুল জব্বার ফজলে খোদাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে একটি গান লিখতে বলেছেন। শহীদের স্মরণে হবে গানটি। আব্দুল জব্বারের মুখে এ কথা শুনে সালাম সালাম হাজার সালাম গানের কথা মনে পড়ে যায় গীতিকারের। তখনই গানটি খুঁজে বের করেন তিনি। তুলে দেন জব্বারের হাতে।
সেদিনই তাতে সুর বসান আব্দুল জব্বার। ১৪ মার্চ ধীর আলী মিয়ার সংগীতায়োজনে রেকর্ড হয়। আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে গানটি ছড়িয়ে পড়ে বাংলার দশ দিগন্তে। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এই গানটি বেজেছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদের স্মরণে। শহীদের স্মরণে লেখা এ গানটি উজ্জীবিত করেছিল গোটা জাতিকে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিত বাজানো হতো এই গান। মুক্তিকামি মানুষেরা রেডিওতে কান পেতে মন ভরে শুনতেন। এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে শহীদের স্মরণে লেখা এই গান। তবে অপ্রিয় হলেও সত্য ৫ দশক কেটে গেলেও এই গানটির জন্য কণ্ঠশিল্পী কিংবা গীতিকার কোনো ধরনের স্বীকৃতি পাননি। বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন ফজলপুত্র কবি ওয়াসিফ-এ-খোদা। তিনি টেলিভিশনকে বলেছিলেন, ‘বাবা নিজে কখনও চাইতেন না স্বীকৃতি। আপন মনে কাজ করে গেছেন সারা জীবন। কিন্তু ছেলে হিসেবে, একজন শিল্পী সুহৃদ হিসেবেও স্বীকৃতি চেয়েছিলাম। কেন মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বোধগম্য হয় না।’
বিজয় নিশান উঠছে ওই
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই…’। গানটির সুরকার সুজেয় শ্যাম। লিখেছেন শহিদুল ইসলাম। ঘটনা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের। সুজেয় শ্যাম সকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অফিসে পৌঁছেছেন। কিছুক্ষণ পরই ডাক আসে বেতারের দুই কর্মকর্তা আশফাকুর রহমান ও তাহের সুলতানের থেকে। তারা জানান অন্য সব গান বাদ। আজ বিজয়ের গান করতে হবে। কে লিখবেন সেটিও জানিয়ে দিলেন তারা। সুজেয় শ্যাম তখন তাড়া দিলেন শহিদুল ইসলামকে। গীতিকার কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থায়ীটা লিখে দিলেন। কিন্তু শুরু করতে বসে সমস্যায় পড়লেন সুজেয় শ্যাম। কেননা হারমোনিয়াম পাওয়া যাচ্ছিল না। হারমোনিয়াম না থাকলে সুর করবেন কিভাবে। অগত্যা মুখে মুখেই সুর করার চেষ্টা করলেন। অবশেষে হারমোনিয়াম মিললে কিছুক্ষণের মধ্যেই সুজেয় শ্যাম সুর বসান গানে। পরে বাকিটুকু লিখে দিলেন শহিদুল ইসলাম। গানটি সুর করতে করতেই শিল্পী নির্বাচন করেছিলেন সুজেয় শ্যাম। মনে মনে ভাবছিলেন এর নেতৃত্ব যদি শিল্পী অজিত রায় দেন তাহলে খুব ভালো হয়।
পরিকল্পনামতো অজিত রায়কে গিয়ে ধরলেন। জানালেন গানটি লিড দিতে হবে তাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান কণ্ঠে তুলতে রায় রাজি হলেন সানন্দে। মহড়া কক্ষে কণ্ঠ দিতে ততক্ষণে উপস্থিত বাকি শিল্পীরা। রথীন্দ্রনাথ রায়, প্রবাল চৌধুরী, তিমির নন্দী, রফিকুল আলম, মান্না হক, মৃণাল কান্তি দাস, অনুপ ভট্টাচার্য, তপন মাহমুদ, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, রূপা ফরহাদ, মালা খুররমসহ আরও অনেকে। শুরু হলো মহড়া। বিজয়ের গান মনের আনন্দে আয়ত্তে নিলেন সবাই। দেড় ঘণ্টার মধ্যেই স্বাধীন বাংলার প্রথম গানের সুর মহড়া সব সম্পন্ন হলো। এরপর রেকর্ডের পালা। সবাই মিলে রেকর্ড করলেন গানটি। ঐতিহাসিক সেই গানে তবলা সংগত করেছিলেন অরুণ গোস্বামী, দোতারায় অবিনাশ শীল, বেহালায় সুবল দত্ত, গিটারে ছিলেন রুমু খান। পকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন এই প্রচারের মাধ্যমে পথচলা শুরু করে শিশু বাংলাদেশ। বিজয়ের উল্লাস ছড়িয়ে পরে সুরে সুরে। শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে মুক্তির আনন্দ। একইসঙ্গে পথচলায় ইতি টানে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের। আজও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলো এ দেশের মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সুরের মূর্চ্ছনা