স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট

ময়ূরাক্ষী সেন

অনেক পরিবারের সদস্যরা ক্রমাগত অসুস্থ হতে থাকে কিন্তু তাদের অসুস্থতার কারণ সহজে খুঁজে বের করা যায় না। ডায়রিয়া, জন্ডিস, কলেরা কিংবা ছত্রাক সংক্রমণের সমস্যা দেখা দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগের সূত্রপাত কোথায় হচ্ছে তা ধরা যায় না। কিন্তু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে সে পরিবারের টয়লেট যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়। আমাদের অজান্তে ঘরের টয়লেট নানা রকম রোগ জীবাণু ছড়িয়ে দেয়।

বরাবরই এই স্থানটি বেশ অবহেলিত হয়ে থাকে। অনেকেই ঘরের অন্যান্য রুম কিংবা রান্নাঘর, বারান্দা যেভাবে পরিষ্কার করে টয়লেট পরিষ্কারের ক্ষেত্রে ততটা গুরুত্ব দেয় না। আর এতেই শুরু হয় নানা ধরনের রোগ বালাই। রোগ জীবাণু ভাইরাস ইত্যাদির কারখানা বলা হয় টয়লেটকে। প্রতিবছর ১৯ নভেম্বর বিশ্ব টয়লেট দিবস পালন করা হয়। জাতিসংঘের নির্দেশে এই দিবসটি পালন করা হয়। জাতিসংঘ এই দিবসটির কেন্দ্র করে একটি থিম রাখে যেমন পরিছন্নতা, পানির ব্যবহার ইত্যাদি। অনেকের মনে হতে পারে টয়লেট দিবস পালন করার আবার কি আছে? কিন্তু জাতিসংঘ ২০০১ সাল থেকে বেশ গুরুত্ব সহকারে এই দিবসটি পালন করে আসছে।

পৃথিবীকে বসবাসের জন্য নিরাপদ করে তৈরি করার জন্য জাতিসংঘ বেশ কয়েকটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে থাকে, যাকে বলা হয় সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল। শহরে কিংবা উন্নত স্থানে থেকে টয়লেট দিবস পালন কিংবা টয়লেট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুত্ব অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের অনেকের হয়তো অজানা যে বিশ্বে প্রতিবছর শুধুমাত্র টয়লেট অপরিষ্কার রাখার জন্য বিভিন্ন রোগে অনেক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কিছু রোগের মূল উৎসই অপরিষ্কার টয়লেট। পুরো পৃথিবীতে ৩.৬ মিলিয়নের বেশি মানুষ এই সমস্যার মধ্যে আছে।

২০২৪ সালে এসেও অনেক মানুষ এখনো খোলা স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ করে। যা সেই ব্যক্তি এবং পরিবেশ উভয়ের জন্য ভীষণ অস্বাস্থ্যকর। বিশেষজ্ঞদের মতে শুধুমাত্র টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। তাই জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে সবাই যেন নিরাপদ টয়লেট পায়, সে উদ্দেশ্যে কাজ করছে। অপরিষ্কার টয়লেট ব্যবহার করে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর পুরো বিশ্বে হাজার হাজার শিশু মারা যায়।  পৃথিবীতে এত মানুষ শুধুমাত্র নিরাপদ টয়লেট না পাওয়ার জন্য রোগাক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে; তাই ব্যাপারটি অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার মতোই একটি বিষয়।

শুরু থেকে পুরো বিশ্বকে জাতিসংঘ নিরাপদ স্যানিটেশন সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করছে। অনেকের কাছে আশ্চর্যজনক মনে হলেও পৃথিবীতে অনেক মানুষ নিরাপদ সেন্সেশন ছাড়াই জীবন যাপন করছে। তাদের কাছে টয়লেট কিংবা শৌচাগার কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এর ফলে নারী ও শিশুদের নানা রকম অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। বিশেষ করে গ্রামে এ ধরনের চিত্র দেখা যায়। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা চেষ্টা করে যাচ্ছে মানুষের কাছে টয়লেটের গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করার। বিশ্ববাসীকে সচেতন করা হচ্ছে, তারা যদি নিজেদের টয়লেট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না রাখে ও সঠিকভাবে ব্যবহার না করে তাহলে ঘরের অন্যান্য স্থান যতই পরিষ্কার হোক না কেন, রোগ মুক্ত কখনোই হওয়া যাবে না। বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকেরা ডায়রিয়া ও অন্যান্য রোগের একমাত্র কারণ মনে করে টয়লেটকে। দিন দিন ছত্রাক সংক্রমণের সংখ্যা বেড়েই চলছে। শরীরের ছত্রাক সংক্রমণ হলে বেশ ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়। ছত্রাক সংক্রমণ হওয়ার কারণও টয়লেট অপরিষ্কার থাকা। এর ফলে ছত্রাকের মতো বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। টয়লেট পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি টয়লেটের সঠিক ব্যবহার ও পানি ব্যবহার সম্পর্কেও সতর্ক থাকা জরুরি।

অনেকের কাছে টয়লেট দিবস বিষয়টি তুচ্ছ মনে হলেও পুরো বিশ্বে যেভাবে শুধুমাত্র টয়লেটের জন্য রোগ ছড়াচ্ছে ব্যাপারটি মোটেও তুচ্ছ করে দেখার মতো নয়। কেন এত ঘটা করে বিশ্ব টয়লেট দিবস পালন করা হয় তা তো জানা গেল। পাশাপাশি জানা প্রয়োজন কিভাবে টয়লেট পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যায়।

অনেকেই টয়লেট পরিষ্কার করার সঠিক পদ্ধতি জানেন না, ফলে তারা যতই পরিষ্কার করুক সঠিকভাবে তা পরিষ্কার হয় না। রোগ জীবাণুমুক্ত চকচকে টয়লেট চাইলে অবশ্যই তা নিয়ম অনুসারে পরিষ্কার করতে হবে। শুধুমাত্র পানি ও সাবান দিয়ে টয়লেট জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব না। জেনে নেওয়া যাক টয়লেট পরিষ্কার করা সঠিক পদ্ধতি :

টয়লেট ঝকঝকে পরিষ্কার করে তোলার জন্য বেকিং সোডা ও ভিনেগারের ভূমিকা রয়েছে। এটি ব্যবহারে খুব সহজেই টয়লেটের কমোড, বেসিন, টাইলস চকচকে করে তোলা সম্ভব। কমোড পরিষ্কারের ক্ষেত্রে জীবাণুনাশক স্প্রে ব্যবহার করতে হবে। স্প্রে ব্যবহার করে পরবর্তীতে ব্রাশ দিয়ে ভালো করে মেজে নিতে হবে। টয়লেটের দেয়াল পরিষ্কারের ক্ষেত্রে অনেকের অবহেলা থাকে। কিন্তু দেয়ালেও প্রচুর জীবাণু থাকতে পারে। তাই ভালো করে বেকিং সোডা দিয়ে টয়লেটের দেয়াল পরিষ্কার করে নিতে হবে। পুরো টয়লেটে বেকিং সোডা দিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট রেখে দিতে হবে। এরপর ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে।

টয়লেট সঠিকভাবে পরিষ্কার না করার ফলে পিচ্ছিল থাকায় অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে শিশুরা এবং বৃদ্ধরা এ ধরনের দুর্ঘটনার কবলে বেশি পড়ে। টয়লেটের মেজে ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। টয়লেটের স্যাতস্যাতে ভাব দূর করার জন্য লেবুর রস ব্যবহার করা যেতে পারে। লেবুর রস ব্যবহার করলে মেঝের ময়লাও কিছুটা উঠে আসবে। টয়লেট পরিষ্কারের ক্ষেত্রে গরম পানি এবং লবণও ব্যবহার করা যেতে পারে। গরম পানি টয়লেটের কোণায় লুকিয়ে থাকা পোকামাকড় ও রোগ জীবাণু ধ্বংস করে ফেলবে। তাই চেষ্টা করতে হবে মাঝেমধ্যে বেসিনে ও কমোডে গরম পানি দেওয়ার।

টয়লেটের আয়না পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে টুথপেস্ট, এ ছাড়া ভিনেগার দিয়েও আয়না পরিষ্কার করা সম্ভব। বাজারে এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের টয়লেট ক্লিনার পাওয়া যায়। ঝামেলা এড়াতে সেসব ক্লিনার ব্যবহার করেও টয়লেট পরিষ্কার করা সম্ভব। তবে বাথরুম পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো মানের ব্রাশ ব্যবহার করতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি বাথরুম অনেক ধরনের রোগ বালাই থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে।

জাতিসংঘ এবং সরকারের পক্ষ থেকে টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুত্ব সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও যার যার নিজের জায়গা থেকেও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নিজেদের আশেপাশে এবং গ্রামগঞ্জে সকলকে সচেতন করতে হবে যে, একটি মানুষের জীবনে টয়লেট কত গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। সেই গুরুত্বপূর্ণ স্থান যদি স্বাস্থ্যসম্মত না হয় তাহলে আমাদের মৃত্যু ঝুঁকি অব্দি রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ও নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে গ্রামাঞ্চলে ভালো টয়লেট গড়ে তুলতে হবে। এই যুগে এসেও বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের মানুষ এখনো খোলা স্থানে মলত্যাগ করে। এ বিষয়ে সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

seventeen − 6 =