হর্ন উৎসব

মাহবুব আলম

এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হর্ন উৎসব হয়। সারারাত এই উৎসব হয় কোনো বড় ধরনের বিজয়, আনন্দ-উল্লাসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সে ফুটবল খেলাই হোক বা কোনো নির্বাচন অথবা সরকারবিরোধী আন্দোলন হোক। সে ক্ষেত্রে ইউরোপের রাস্তায় একযোগে ৫/৭ বা একটানা ১০ মিনিট ধরে চলে এই উৎসব। কখনো কখনো থেমে থেমে ঘণ্টাব্যাপীও হয় এই আনন্দ আয়োজন, হর্ন উৎসব। এছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশে বছরের নির্দিষ্ট দিনে বা নির্দিষ্ট সপ্তাহ জুড়েও এই উৎসব হয়। একটানা দিনরাত নয়, দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়, নির্দিষ্ট স্থানে একটা গণজমায়েতে। সুইজারল্যান্ডে এমন এক উৎসবের নাম আলপাইন হর্ন উৎসব। এটা বছরে একটা নির্দিষ্ট দিনে ওই দেশের বিভিন্ন স্থানে গণজমায়েত করে হয়। এই উৎসবে একসঙ্গে সহস্রাধিক বাদ্যযন্ত্রের হর্নে সবাই উল্লাসে ফেটে পড়ে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের নাগাল্যান্ড, মনিপুরে হর্নবিল নামের বাদ্যযন্ত্রে বিকট আওয়াজ করে একটানা অনেকক্ষণ ধরে চলে এই হর্ন দেওয়া। হর্নবিল উৎসব ভারতের এই রাজ্যে ডিসেম্বরের শেষে নববর্ষের আগমন উপলক্ষ্যে সপ্তাহব্যাপী হয়। এর সঙ্গে অবশ্য খানাপিনা, পরস্পর শুভেচ্ছা ও উপহার বিনিময়ও থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে এই উৎসব চালু আছে। তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে খেলাধুলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের অভিনন্দন জানাতে। আবার কখনো কখনো খেলার মাঠে স্বপক্ষের দলকে উৎসাহ জোগাতেও এই হর্ন উৎসব হয়। আর তাইতো দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় স্টেডিয়াম মাত করে রেখেছিল বিশেষ ধরনের বাঁশি। যা হর্নের অনুরূপ।

আমাদের নিজ দেশ বাংলাদেশেও বাঁশি বাজিয়ে, ভেঁপু বাজিয়ে উৎসব করা অনেক পুরনো রীতি। উৎসবের মৌসুমে আমাদের দেশে প্রায় সর্বত্রই রাস্তায় রাস্তায় বাঁশি ভেঁপু বিক্রি হয়। কমবয়সী ছেলে-মেয়েরা ভেঁপু বাজিয়ে আনন্দ করে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালি’র ৩০তম অধ্যায়ে ‘আম আঁটির ভেপু’ নামে একটি পরিচ্ছেদ আছে। আজ থেকে ৪০/৫০ বছর আগে আম আঁটির ভেঁপু বাজান গ্রামের ছেলে-মেয়েদের একটা প্রিয় খেলা ছিল। সেই সময় এবং এখনো স্থান-কালের কথা না ভেবে অনেক ছেলে-মেয়ে বিশেষ করে কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা রাস্তাঘাটে চলাচলকারী লোকজনদের অসুবিধার তোয়াক্কা না করে ওদের কাছে গিয়ে হঠাৎ করে ভেঁপু বাজায়।

সম্প্রতি বাংলা নববর্ষে খোদ ঢাকা মহানগরীতেই আমরা এই চিত্র দেখছি, কখনো দূর থেকে কখনো একেবারে কাছ থেকে। অবশ্য নগরীর এই বাঁশির ধরন ভিন্ন। এটা প্লাস্টিকের তৈরি। তাইতো হওয়ার কথা। নগরে কোথায় তালপাতার বাঁশি আর আমের আঁটি পাওয়া যাবে? সেই যাই হোক বিষয়টা একই। এতো এক শব্দ উৎসব, হর্ন উৎসব। এতে আপত্তির কিছু নেই। বরং আছে নির্মল আনন্দ-বিনোদন শিশু-কিশোরদের জন্য। এই আনন্দ বিনোদন অনেক সময় বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই তো অনেক সময় ওই কম বয়সী ছেলে-ছোকরারা উচিত শিক্ষাও লাভ করে। বিশেষ করে যদি পাড়ার রাগি বুড়োদের কানের কাছে অথবা তাদের বাড়ি সামনে জোরে জোরে বাঁশি, ভেঁপু বাজায় তাহলে তো কথাই নেই। নির্ঘাত কানমলা তো আছেই। সেইসঙ্গে দু’একটা চড়-থাপ্পড়ও বাদ পড়ে না। তারপরও আমাদের সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে মিশে গেছে এই বাঁশি ও ভেঁপু। কিন্তু তাই বলে সারাদিন, সারা বছর? না, তা কি করে হয়? হয় না, হওয়ার কথাও না।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই বাঁশি ও ভেঁপুর চাইতেও জোরালো হর্নের উৎসব হচ্ছে সারা দিন, ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। একদিন দুদিন নয়, বছরের ৩৬৫ দিনের ৩৬৫ দিনই। আর উৎসব করছে আমাদের শহরের বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কারের চালকরা। সেই সঙ্গে রিকশা-ভ্যান চালকরা তো আছেই। কমবেশি ছেলেদের বাঁশি ভেঁপুতে কখনো কখনো বিরক্তি লাগলেও ওতে এক ধরনের আনন্দ আছে। কিন্তু কার, বাস, ট্রাক চালকদের হর্ন উৎসবে আনন্দ তো নেই যা আছে তা হলো বিপদ। এটা ছোটখাটো বিপদ নয়, বড় ধরনের বিপদ। বধির হয়ে যাওয়ার বিপদ। হার্ট অ্যাটাকের বিপদ।

বিষয়টা একটু খোলসা করে বলি। ঢাকা শহরে সকাল থেকে প্রাইভেটকার, বাস, ট্রাকের চলাচলের সময় ওদের মধ্যে হর্ন দেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কে কত বেশি হর্ন দেবে এই প্রতিযোগিতা চলে নগরীর সড়ক, অলিগলিতে। সেক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির কোনো বালাই নেই। সর্বত্র কারণে-অকারণে হর্ন দিয়েই যাচ্ছে চালকরা। সামনে দেখছে জ্যাম, গাড়ি নড়ছে না। তার পরেও পিছনের গাড়ি একটানা হর্ন দিয়ে যাচ্ছে। আবার কখনো কখনো ওই চালকরা মনের আনন্দে হর্ন দিতে দিতে সাঁ সাঁ করে গাড়ি ছুটিয়ে চলে। বিষয়টা এমন যেন, দেখ আমি যাচ্ছি, তোমরা দেখো। কেন দেখবা না। দেখতে না চাইলেও যাতে দেখে তাইতো জোরে হর্ন বাজায়। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা বেআইনি ও দণ্ডনীয় অপরাধ। তারপর ওই চালকদের মুখে তৃপ্তির হাসি, যেন ওরা একটা কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। সফল হয়েছে একটা মহান কাজ করতে।

বাস, মিনিবাস, ট্রাক, কার চালকদের সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্ত হয়েছে মোটরসাইকেল চালকরা। ওরা আরও বেশি বেপরোয়া, আরো বেশি ন্যাক্কারজনক কাণ্ড করে। তাইতো ঢাকা নগরী এখন শব্দ দূষণে বিশ্বের শীর্ষ নগরীর তকমা পেয়েছে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। অবশ্য লজ্জার চাইতেও বিপদের দিকটাই বেশি। কারণ শব্দ দূষণে শুধু শ্রবণশক্তি হ্রাস পায় না, অনেকের কানের পর্দা ফেটে বধির হয়ে যায়। এছাড়াও এই শব্দ দূষণে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও বিপদ ডেকে আনে তা উল্লেখ করেছি। তারপরও বলি, শব্দ দূষণে নগরীতে মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে, মানুষ উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা ও উগ্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে পড়ছে, অনেকের মানসিক রোগি হবার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বাড়ছে মানুষের মধ্যে মানসিক উত্তেজনা আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীর হর্ন উৎসবে শিশুদের মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তা কিন্তু বিপদ নয়, মহাবিপদ। রীতিমতো দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এই বিষয়ে সরকার-প্রশাসন একেবারে নির্বিকার। দেখে শুনে মনে হচ্ছে এই হর্ন উৎসবে ইতিমধ্যে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বধির, অন্ধ, কালা হয়ে গেছে। তাই যদি না হবে তাহলে এই অবস্থা চলে কি করে বছরের পর বছর ধরে।

কয়েক বছর আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচিবালয় এলাকা নীরব এলাকা ঘোষণা করে ওই এলাকার হর্র্ন বাজানো নিষেধ করে শাস্তির বিধান জারি করা হয়। বলা হয়, এই এলাকায় কেউ হর্র্ন বাজালে তার এক মাস কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। ওই একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে তাকে ৬ মাস কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। কিন্তু প্রশাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রকাশ্যে দিনের বেলায় রীতিমতো হর্ন বাজাতে বাজাতেই ছোটে বাস-মিনিবাস, ট্রাক, কার, প্রাইভেটকার এমনকি সচিবালয়ের নিজস্ব গাড়ি বহরের মোটরযানগুলোও। তারপরও শাস্তি দেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে কেউ দেখেনি কেউ শুনেনি। শুধু সচিবালয় নয়, নগরীতে আরো নীরব এলাকা রয়েছে। এগুলো হলো হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অন্যান্য অফিস-আদালত ও আবাসিক এলাকাগুলো। এজন্য আইনে শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই। আর নেই বলে চালকরা তাদের ইচ্ছামতো হর্ন বাজিয়ে যায়। আইনের প্রয়োগ নেই বলে ওরা বেপরোয়া।

অবশ্য, বিষয়টা শুধু চালকের নয়, বিষয়টা মালিকদেরও। প্রাইভেটকারে চালক চালায় কিন্তু মালিক তো গাড়িতেই থাকে। তিনি কি করেন? তার ভূমিকা কী? বাসের চালক বাস চালায় ওই বাসে তো যাত্রীরাও থাকে, তাদের ভূমিকা কি? অথবা বাস মালিক, ট্রাক মালিকদের ভূমিকা কি? রাস্তায় প্রায়শই ট্রাফিক পুলিশ, পুলিশ সার্জেন্টের গাড়ি থামাতে দেখা যায়। ওরা কি করে? এটা দেখার প্রথম ও প্রধান দায়িত্বতো ওদেরই। যাই হোক নগরবাসী হর্ন উৎসব দেখতে চায় না। এই উৎসব বন্ধ করতে হবে। যত দ্রুত এই উৎসব বন্ধ হবে ততই মঙ্গল। অন্যথায় দেশ ও জাতিকে বড় রকমের মাশুল দিতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মেধাশূন্য অসুস্থ রুগ্ন হয়ে যাবে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো রুগ্ন দেশ ও জাতি রুগ্ন হয়ে যাবে। যা একটা জাতির জন্য মহাবিপদ সংকেত। তারপরও যদি আমরা এই উৎসবে মেতে থাকি; তা থাকতেই পারি। তা না হলে আর আমরা আত্মঘাতি বাঙালি কেন?

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: রম্য রচনা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twelve − four =